২২ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ১১:১৬

ছেলেধরা-মাথাকাটা গুজবে ভাসছে দেশ ॥ আতঙ্ক

* মব সাইকোলজি, বিচারহীনতা ও সহনশীলতার সংস্কৃতিই মূল কারণ
* শিকার হচ্ছেন মানসিক প্রতিবন্ধী, ভবঘুরে ও নারীরা
* গ্রামাঞ্চলে রাতে চলাচল সীমিত, স্কুলে উপস্থিতি কম
* আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না : পুলিশ
* আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর হওয়া প্রয়োজন

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : ছেলেধরা-মাথাকাটা গুজবে ভাসছে দেশ। এ গুজবকে কেন্দ্র কওে দেশের আনাচে কানাচে ঘটছে গণপিটুনীর ঘটনা। এ ছাড়া গুজবে কান দিয়ে আতংকে ভুগছেন দেশবাসী। গত দু’সপ্তাহ ধরে চলা এ গুজবের শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। তাদের অধিকাংশই মানসিক প্রতিবন্ধী ,ভবঘুরেসহ নারীরা। গুজব আতংকে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের চলাচলের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো। যার কারণে স্কুল-মাদরাসায় উপস্থিতির হার গেছে কমে।

ছেলেধরা-মাথাকাটা আর গলাকাটাই হোক-এসব স্রেফ গুজব বলছে আইনশৃংখলাবাহিনী। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে ২/১টি শিশুর ওপর আক্রমণের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি চক্র এমন গুজব ছড়িয়েছে। বর্তমানে কেউ ইচ্ছাকৃত কিংবা উদ্দেশ্যহীনভাবে গুজব ছড়াচ্ছে। 

জানা গেছে , গুজবে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম অঞ্চলে মানুষ রাতে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সন্তানদের স্কুলে পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে কেউ কেউ। তবে তারা কেউ ছেলেধরা কিংবা গলাকাটার ঘটনা দেখেনি, একে অন্যের কাছে শুনেছে বলে জানিয়েছেন। এ গুজবেই ছেলেধরা সন্দেহে প্রায় প্রতিদিন এক বা একাধিক মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। দু‘সপ্তাহে অন্তত ১০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ, শনিবার ছেলেধরা সন্দেহে ঢাকার বাড্ডায় অজ্ঞাত এক নারী, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একই দিন ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনিতে অন্তত ১০ জন গুরুতর আহত হয়। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী, পাগল, ভবঘুরে এবং সহজ-সরল নারীরা। পুলিশ গুজব ছড়ানোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। গুজব ছড়ানো একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছেলেধরা গুজবে সবচেয়ে বেশি বিপদের মধ্যে রয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী, পাগল, ভবঘুরে এবং নারীরা। মানসিক প্রতিবন্ধী দেখলেই ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় ছিন্নমূল, বাস্তুহারা, পাগল প্রকৃতির মানুষ দেখলেই তাদের ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপক মারধর শুরু করছে স্থানীয় লোকজন। মানসিক প্রতিবন্ধী ও নারীরা আতঙ্কে নিজের পরিচয় সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছে না। ফলে মানসিক প্রতিবন্ধীরা ছেলেধরা সন্দেহে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনিতে হত্যা ও মারধরের শিকার হচ্ছে। বিভ্রান্তিতে পড়ে অতি উৎসাহী এক ধরনের মানুষ এ ধরনের অপরাধী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। শনিবার অন্তত ৮ জন মানসিক প্রতিবন্ধী, পাগল এবং নারীকে গণপিটুনি দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

শনিবার ঢাকায় নিহত নারীর উদ্দেশ্য ছিল তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করা’, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকেই গণপিটুনির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ। তদন্ত করা হচ্ছে গণপিটুনির ইন্ধনদাতাদের শনাক্তে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ১০জন। আহত হয়েছেন ২২ জন।

গনপিটুনীর ঘটনাগুলো :
সর্বশেষ চার জেলায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে ১৩ জনকে গণপিটুনি দেয়ার খবর এসেছে । নওগাঁ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও লালমনিরহাটে ছেলেধরা সন্দেহে ১৩ জন গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। শনিবার ও গতকাল রোববার এই ঘটনাগুলো ঘটে।

স্থানীয় একাধিক সুত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে , নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে গতকাল রোববার ছেলেধরা সন্দেহে ছয় ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গণপিটুনির শিকার ছয় ব্যক্তি হলেন নওগাঁ সদর উপজেলার খাগড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন, তসলিম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আবদুল মজিদ আকন্দ ও আনিছুর রহমান এবং সদর উপজেলার ফারতপুর গ্রামের রেজাউল করিম।

স্থানীয় বাসিন্দা ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৮টার দিকে এই ছয়জন উপজেলার বুড়িদহ গ্রামের রণজিৎ কুমার চৌধুরীর পুকুরে চুক্তিভিত্তিক মাছ ধরতে যান। পুকুরের মালিকের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি ছিল যে তরা শুধু ছোট মাছ ধরবেন। কিন্তু তরা কয়েকটি বড় মাছও ধরে ফেলেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে পুকুরমালিকের কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে পুকুরের মালিক ও গ্রামের লোকজন ছয় জেলেকে মারধর করতে শুরু করেন। তরা নিজেদের বাঁচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় গ্রামের লোকজন ‘ছেলেধরা’ বলে চিৎকার করতে শুরু করলে আরও লোকজন ছুটে গিয়ে প্রথমে সাদ্দাম হোসেন নামের এক জেলেকে আটক করেন। ‘ছেলেধরা’ পালিয়ে গেছে খবর রটে গেলে পাশের খুদিয়াডাঙ্গা গ্রামের লোকজন অন্য পাঁচজন জেলেকে আটক করে পিটুনি দেয়।

মান্দা থানার ওসি মোজাফফর হোসেন বলেন, পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্ধের জেরে গ্রামবাসী ‘ছেলেধরা’ গুজব রটিয়ে ছয় ব্যক্তিকে মারধর করেছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তারা এখন থানা হেফাজতে আছেন। ঘটনা তদন্তে তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ইকবাল হোসেন বলেন, ‘এটা পুরোপুরি গুজব। এ ধরনের গুজবে কাউকে কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’

টাঙ্গাইলে ছেলেধরা সন্দেহে তিনজন গণপিটুনিতে আহত হয়েছেন। শহরের শান্তিকুঞ্জ মোড়, সদর উপজেলার কান্দিলা ও কালিহাতী উপজেলার সয়াপালিমা গ্রামে পৃথক এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, সকালে সদর উপজেলার কান্দিলা বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে একজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। তর নাম আকাশ (৪২)। বাড়ি গাজীপুর। দুপুরের দিকে কালিহাতী উপজেলার সয়াপালিমা গ্রামে গণপিটুনির শিকার হন অজ্ঞাত এক যুবক। তাঁকে পুলিশ উদ্ধার করে কালিহাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। এ ছাড়া শনিবার রাত ১১টার দিকে শহরের শান্তিকুঞ্জ মোড় এলাকা থেকে গণপিটুনির শিকার একজনকে পুলিশ উদ্ধার করে। টাঙ্গাইল সদর থানার পুলিশ (পরিদর্শক) মো. সালাউদ্দিন বলেন, কাউকে অপরাধী বলে সন্দেহ হলে পিটুনি না দিয়ে পুলিশে দেওয়ার জন্য প্রচার চালানো হচ্ছে।

কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার দুতিয়ার দিঘির পাড় এলাকায় এক নারীসহ তিনজনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা। তরা হলেন জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রামের আবদুস সালাম (৭০), তার স্ত্রী রত্না বেগম (৪০) ও একই গ্রামের রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন (৩০)। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় নেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত তিনজন ব্যক্তি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাম ও রত্না দম্পতি রিকশা নিয়ে আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলি ইউনিয়নের দুতিয়ার দিঘি এলাকায় যান। একটি বাড়ির সামনে গিয়ে স্কুলগামী এক শিশুকে কথা আছে বলে ডাক দেন। তখন আশপাশের বাসিন্দারা বিষয়টি টের পেয়ে চিৎকার করেন। এই সময়ে তারা রিকশা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে জনতা তাদের ধরে পিটুনি দেন। পরে পুলিশে খবর দিয়ে তাদের সোপর্দ করা হয়। কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে শনিবার কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভার পেয়ারাপুর এলাকায় রফিকুল ইসলাম (৪৩) নামের এক ভিক্ষুককে ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনি দিয়ে তার পা ভেঙে দেন এলাকাবাসী। তিনি বর্তমানে লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।

এসপি সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেধরা সন্দেহে কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। কোথাও ভিন্ন কিছু চোখে পড়লে পুলিশকে জানান। গুজবে কান না দেবেন না।’

ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে লালমনিরহাট শহরের খোঁচাবাড়ি মৌজার ডাইলপট্টি এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে (৪৫) আটক করে এলাকাবাসী পিটুনি দেয়। সংবাদ পেয়ে ওই নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে লালমনিরহাট সদর থানার এসআই জিল্লুর রহমান আহত হন। বর্তমানে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। লালমনিরহাট সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এরশাদুল আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। লালমনিরহাটের এসপি এস এম রশিদুল হক বলেন, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নিলে বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটালে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এর আগে শনিবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছেলেধরা সন্দেহে অন্তত তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার প্রেক্ষাপটে এই অপরাধ সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করেছে পুলিশ। শনিবার রাতে পুলিশ সদরদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে ‘গণপিটুনি’ না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার সকালে ঢাকার উত্তর বাড্ডায় একজন নারী ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। এরপর মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আরেকজনকে।

এদের বাইরে গাজীপুরে মানসিক ভারসাম্যহীন একজন নারী এবং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আরেক তরুণীকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে একই সন্দেহে।

এর আগে শুক্রবার রাতে ঢাকার কেরাণীগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে দুই যুবককে পিটুনি দেওয়ার পর তাদের একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে এসেছে।

এরমধ্যে বৃহস্পতিবার নেত্রকোণা শহরে এক যুবকের ব্যাগ তল্লাশি করে ‘শিশুর মাথা’ পাওয়ার পর তাকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। এই ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে দলবেঁধে বিভিন্ন জনের আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।

ঢাকার বাড্ডায় শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উত্তর বাড্ডার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শিশু চোর সন্দেহে তসলিমা বেগম রেনু (৪২) নামে এক নারীকে পিটিয়ে আহত করে স্থানীয়রা। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করেন বলে বাড্ডা থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইয়াছিন গাজী জানান। তিনি বলেন, প্রথমদিকে কালো বোরকা পরা এই নারীর পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তার এক স্বজন এসে পরিচয় নিশ্চিত করেন।“ওই স্বজন জানিয়েছেন, রেনুর দুই ছেলে-মেয়ে। মহাখালী এলাকায় থাকে। দুই বছর আগে স্বামী তসলিম হোসেনের সাথে তালাক হয়ে গেছে। দুই সন্তানের মধ্যে মেয়েটা তার কাছে থাকে।“তার সন্তানদের স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে স্কুলে গিয়েছিলেন বলে তার বোনের ছেলে নাসির উদ্দিন টিটো জানিয়েছন।”তসলিমার গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুরের রায়পুরে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা ইয়াছিন। এই ঘটনায় তসলিমার ভাগ্নে টিটো কারও নাম উল্লেখ না করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

শনিবার সকালে নগরীর সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে মো. সিরাজ (২৮) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে জনতা। সিরাজ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুর রশিদের ছেলে।

এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লায় পিটিয়ে আহত করা হয়েছে শারমিন বেগমকে (২৫)। শারমিন পটুয়াখালী সদর উপজেলার মরিচ বুনিয়া গ্রামের সালমান শাহর স্ত্রী। ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায় তিনি ভাড়া থাকেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, সকাল ৮টার দিকে মিজমিজি আলামিন নগর এলাকার আইডিয়াল ইসলামিয়া স্কুলের প্লে শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া (৭) স্কুলে যাচ্ছিল। পথে অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবক সাদিয়াকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (অপরাশেন) জসিম উদ্দিন বলেন, “সাদিয়া আমি ‘স্কুলে যাব’, ‘স্কুলে যাব’ বলে কাঁদছিল। ঘটনাটি আশপাশের লোকজনের সন্দেহ হলে যুবকটিকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে অসংলগ্ন কর্থাবার্তা বললে সন্দেহ বাড়ে।“এক পর্যায়ে সাদিয়ার বাবা সোহেল খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। এরইমধ্যে এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে যুবকটিকে পিটুনি দেয়।”খবর পেয়ে পুলিশ এসে ওই যুবককে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
অপর ঘটনাটি ঘটে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায়।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে পরিদর্শক জসিম বলেন, স্থানীয় একটি বাড়িতে শারমিন প্রবেশ করলে বাড়ির ভাড়াটিয়ারা তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দিতে না পারায় সন্দেহ হয়।“এক পর্যায়ে নারী-পুরুষ মিলে ওই নারীকে মারধর শুরু করে। তাকে পাশের আল বালাগ আদর্শ ক্যাডেট স্কুলের ভিতর নিয়ে জনতার রোশানল থেকে রক্ষা করেন কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি।”পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে খানপুর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থানায় নিয়ে যায় বলে জানান জসিম।

শনিবার রাত ১০টার দিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আনুমানিক ৫০ বছরের এক ব্যক্তিকে।

কমলগঞ্জ থানার ওসি মো. আরিফুর রহমান জানান, লোকটি এ এলাকার নন। সন্দেহ হলে চা শ্রমকিরা তাকে আটক করে নাম-পরিচয় জানতে চাইলে তিনি সঠিক জবাব দিতে পারেননি। পরে ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনিতে তিনি আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

সকালে গাজীপুরে ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে এলাকাবাসী পিটিয়ে আহত করে। ৪৫ বছর বয়সী এই নারীর বাড়ি নেত্রকোণার দুর্গাপুর এলাকায়। তাকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

গাজীপুরের বাসন থানার ওসি একেএম কাউসার বলেন, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ওই নারী এক দম্পতির কাছে গিয়ে তাদের শিশুকে আদর করতে গেলে তারা তাকে আটক করেন। পরে স্থানীয়রা তাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে আহত করে পুলিশে দেয়। “তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।” হাসপাতালের চিকিৎসক প্রণয় ভূষণ দাস বলেন, “তার শরীরে নীলা ফুলা জখম রয়েছে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত।”

এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নেত্রকোনা শহরের নিউ টাউন পুকুরপাড় এলাকায় সাত বছর বয়সি এক শিশুর কাটা মাথা ব্যাগে ভরে নিয়ে যাওয়ার সময় এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। নেত্রকোনা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম আশরাফুল ইসলাম জানান, গলাকাটা ওই শিশুর নাম সজীব মিয়া। তার বাবা রইস উদ্দিন পেশায় রিকশাচালক। গলাকেটে নিয়ে যাওয়া খুনি যুুবক মাদকাসক্ত ছিল। ছেলেধরার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তার। ১৩ জুলাই রাজধানীর আদাবর এলাকায় গণপিটুনিতে মারা যায় এক যুবক। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, স্থানীয় নবোদয় হাউজিং এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরার সময় তাকে ছেলেধরা হিসেবে আখ্যায়িত করে মারধর করলে তিনি মারা যান। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুর ঘোনার কাঁঠালিয়া বাজারে ১০ জুলাই রাতে ছেলেধরা সন্দেহে লোকজন অজ্ঞাত এক বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। ডুমুরিয়া থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বিপ্লব জানান, নিহত ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন। ৯ জুলাই রাত আটটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের চাঁদগেটে ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে (২৫) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা শহরে ছেলে ধরা সন্দেহে অজ্ঞাত ৩০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি গণপিটুনিতে মারা গেছে।
চট্টগ্রামের পটিয়াতে শুক্রবার রাত ১২টায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের নতুন বাইপাস সড়কের ভাটিখাইন ইউনিয়নে মো. মাসুদ (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে গণধোলাই দেওয়া হয়। সে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার কুতুবপুর গ্রামের আবু সিদ্দিকের ছেলে বলে জানা গেছে। তবে সে প্রতারক বলে সন্দেহ করছেন থানা পুলিশ। পটিয়া থানার ওসি বোরহান উদ্দিন বলেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ছেলেধরা সন্দেহে এক ব্যক্তিকে জনতা গণপিটুনি দেয়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সে চোর কিংবা প্রতারক। শনিবার শিশু নিয়ে পালানোর সময় চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে রেহেনা বেগম (৪৫) নামের এক নারীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী। স্থানীয়রা জানায়, আরফাতুল ইসলাম সিফাত (৫) নামের শিশুটি ঘরের বাইরে খেলা করার সময় এক মহিলা সিফাতকে কোলে তুলে মুখে জ্ঞাননাশক ওষুধ লাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় গণপিটুনি দেয়। নারীটি রোহিঙ্গা বলে ধারণা করছে। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে মুন্ডু কাটা ব্যক্তি সন্দেহে এক মানসিক ভারসাম্যহীন লোককে গণপিটুনি দেয় জনতা। শুক্রবার রাতে উপজেলার গফরগাঁও ইউনিয়নের গড়াবেড় বাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। গণপিটুনির শিকার ওই ব্যক্তির নাম মনোরঞ্জন বর্মণ (৪০)। সে ঢাকার কেরানিগঞ্জ থানার পাইনা গ্রামের অমরণ চন্দ্র বর্মণের ছেলে বলে পুলিশ জানিয়েছে। গফরগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে লোকটিকে মানসিক ভারসাম্যহীন (পাগল) বলেই মনে হচ্ছে। তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। মৌলভীবাজারের বড়লেখায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে সিলেট দক্ষিণ সুরমা থানার মৃত সত্তার মিয়ার ছেলে মানিক মিয়া (২৮) ও বিয়ানিবাজার ফতেপুর গ্রামের মৃত মতসিন আলীর ছেলে শাহানুর আলমকে (২৭)। বড়লেখা থানার ডিইটি অফিসার এসআই তরুণ মজুমদার জানান, আটককৃতরা ছেলেধরা নয়, তারা মদ খেয়ে মাতলামি করছিল। এসময় এলাকাবাসী ছেলেধরা সন্দেহে তাদের আটক করে গণধোলাই দেয়। ‘কল্লা কাটা’ আতঙ্কে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর শ্রীমন্তপুরে এক প্রতিবন্ধী নারীকে পুলিশে সোপর্দ করেছেন মহরøাবাসী। গোদাগাড়ী থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মানুষের মধ্যে ‘কল্লা কাটা’ গুজবের ফলে ওই নারীকে আটক করে এলাকাবাসী। পরে তাকে পুলিশের কাছে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই নারী একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। তার ছেলে সোনালী ব্যাংকে কর্মরত। ছেলের কাছেই তাকে দেওয়া হয়েছে। লাকসামে পৌরশহরের পেয়ারাপুর ছেলেধরা সন্দেহে রফিকুল ইসলাম (৪৩) নামে এক ভিক্ষুককে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। এতে ওই ভিক্ষুকের পা ভেঙে যা।

কী কারণে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনাগুলো ঘটছে
গুজবকে কেন্দ্র করে গণপিটুনির মতো সহিংস ঘটনা ঘটছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। গত কয়েকদিনে ছেলেধরা সন্দেহে এমন বেশ কয়েকটি গণপিটুনির খবর সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যারা নিহত হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ ওই এলাকায় অনেক দিন ধরে বসবাস করতেন। কিন্তু হঠাৎ করে দেশব্যাপী এই গণপিটুনির ঘটনা কেন ঘটছে। মানুষের এতো অসন্তোষের কারণ কি? আতঙ্ক বা নিরাপত্তাহীনতা সহিংস মানসিকতার জন্য দায়ী বলছেন বিজ্ঞজনরা।

মব সাইকোলজি
মনোরোগবিদ মেহতাব খানম এই গণপিটুনির মানসিক প্রবণতাকে "মব সাইকোলজি" হিসেবে উল্লেখ করেন। তার মতে, যখন একটি সমাজে নির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে আতঙ্ক বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় তখন তারা এক ধরণের মানসিক অবসাদে ভোগে। সেই থেকেই মানুষের মধ্যে এ ধরনের সহিংসতা দেখা দেয়।

খানম বলেন, "মানুষ ইদানীং ছেলেধরার অনেক খবর পড়েছে, দেখছে। তো এই বিষয়টা তার মধ্যে একধরণের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। এ ব্যাপারে যখন সে কোন সহায়তা পাচ্ছেনা তখন তার মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি হয়। তখন মানুষ পেটাতে দেখলে সে তার ওই বেসিক ধারণা থেকে ক্রোধ বা রাগ ঝাড়তে নিজেও সহিংস হয়ে ওঠে।"

মব সাইকোলজির বৈশিষ্ট্য হল, যারা গণপিটুনি দেয়, তাদের উচিত অনুচিত বোঝার মতো বিবেক কাজ করেনা। কেউ সত্যতা যাচাই-এর চেষ্টা করেনা। তারা জানতেও চায়না কি কারণে মারামারি হচ্ছে। তারা তাৎক্ষণিক সেখানে অংশ নিয়ে তাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
বিচারহীনতা

অপরাধ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই গণপিটুনির পরিস্থিতিকে তিনটি উপাদানে ব্যাখ্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারহানা রহমান।সেগুলো হল: পুলিশ, আদালত এবং কারাগার। ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের এই তিনটি উপাদান সমাজে অনুপস্থিতিকে এমন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

রহমান বলেন, "বাংলাদেশে কয়েক বছর আগেও ডাকাত সন্দেহে অনেক মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। কারণ দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপরে মানুষের আস্থা নেই। তারা মনে করে এই লোকটাকে ছেড়ে দিলে পরে তাকে আর আইনের আওতায এসে সাজা দেয়া সম্ভব হবেনা। এজন্য তারা আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।""দেখা গেছে যে পুলিশ অপরাধীদের আটক করলেও আদালত তাদের খালাস দিয়ে দিচ্ছে বা জামিন মঞ্জুর করছে। আবার আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারলেও পুলিশ তাদের আদালতের সামনে আনতে পারছেনা।"এর পেছনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, মানসিক অস্থিরতা এবং মাদকাসক্তিসহ নানা কারণ জড়িত বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সহনশীলতার সংস্কৃতি নেই
চট্টগ্রাম বিশ্ব সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদের মতে, পরিবেশ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানান, "আমরা এখন খুব অস্থির সময়ের মধ্যে বাস করছি। বেকারত্ব, সুস্থ বিনোদনের অভাব, সহনশীলতার অভাব মানুষকে অস্থির করে তুলছে। আর এ কারণেই গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই অসহনশীলতা মানুষকে নানা অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে। তখনই মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।"

এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি । তার মতে, শুধুমাত্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেই পরিস্থিতি বদলাবেনা। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক অগ্রগতির জায়গাগুলো সুসংগঠিত করা।যেন সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্মান ও সহনশীলতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর ভূমিকা নিলে গণপিটুনি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর হওয়া প্রয়োজন
বর্তমানে ছেলেধরার যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর জেরে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন পুলিশর সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা ।তিনি বলছেন "এটা সত্যি যে ছেলেধরা বিষয়টি মানুষের মধ্যে একটি আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ছেলে মেয়ে হারিয়ে গেলে একটি পরিবারের ওপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যায় সেটা শুধু ভুক্তভোগীরাই বোঝে। সে কারণেই হয়তা লোকজনের বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। এখন এটা গুজব নাকি সত্যি সেটা যাচাই করবে আদালত।" "তাই বলে আইন তো নিজের হাতে নেয়া যাবে না। আতঙ্ক তৈরি হলে আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিজেদের হাতে তুলে নেয়া কোন সময় সমর্থনযোগ্য হবেনা।"এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। এজন্য গোয়েন্দা ইউনিটের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।"পুলিশ বাহিনীর কাজ হবে, এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে, এলাকা ভিত্তিতে তৎপর হয়ে কাজ করা, খোঁজখবর রাখা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া।""এজন্য ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্সকে আরও কঠোর হতে হবে। কোথায় এ ধরণের ঘটনা হতে পারে বা হচ্ছে, কোথায় এ ধরণের অপরাধ প্রবণতা আছে, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।"

কিছুদিন আগে ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবের কারণে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এরপর সরকারি বেসরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়। সেইসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমগুলো গুজব ঠেকাতে নানা ব্যবস্থা নেয়। এ ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের ওপরেও জোর দেন তিনি।

কুমিল্লা অফিস : কুমিল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে মহিলাসহ তিন জনকে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয়েছে। রবিবার সকাল সাড়ে ১০ টায় জেলার সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের ধুতিয়া দিঘীর পাড় এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

গণপিটুনিতে আহতরা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে একজন মহিলা এবং দুইজন পুরুষ। মহিলার বয়স আনুমানিক ৫০ এবং দুই পুরুষের বয়স আনুমানিক ৬০ বছর হবে।
ছেলেধরা সন্দেহে বিষয় সাংবাদিকদের আমড়াতলী ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হোসেন জানান, রবিবার সকালে ওই তিন ব্যক্তি জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রাম থেকে আমড়াতলী স্কুলের সামনে আসেন। পাশের একটি বাড়ির সামনে গিয়ে একটি ছোট শিশুকে ডাক দিলে ছেলেধরা সন্দেহে মহিলাসহ ওই তিন বয়স্ক ব্যক্তিকে এলাকাবাসী আটক করে এবং গণপিটুনি দেয়। দ্রত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

কুমিল্লা ছেলেধরা সন্দেহে মহিলাসহ তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি কুমিল্লা কোতয়ালী মডেল থানার ছত্রখিল পুলিশ ফাঁড়ির এস আই তপন কুমার বাকসী জানান, ধুতিয়া দিঘীর পাড় ছেলেধরা সন্দেহে মহিলাসহ তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে প্রথমে থানায় নেয়া হয়। পরে তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

নাটোর সংবাদদাতা : নাটোরে ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দেয়ার সময় উদ্ধার করেছে পুলিশ। নাটোর থানার ওসি কাজী জালাল উদ্দিন জানান, দুপুরে শহরের হাফরাস্তা তালতলা এলাকায় এক যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখে এলাকাবাসী তাকে ধরে গণপিটুনি শুরু করে। খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ জানায় উদ্ধারকৃত ব্যক্তি একজন মানষিক প্রতিবন্ধি। এসব ঘটনায় আইন নিজের হাতে না নিয়ে পুলিশের সহায়তা নেয়ার আহবান জানিয়েছেন নাটোর থানার ওসি কাজী জালাল উদ্দিন। উদ্ধারকৃত যুবকের পরিচয় জানতে পারেনি পুলিশ।

https://www.dailysangram.com/post/383643