২২ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ১১:১১

বেহাল সড়কে বন্যার ধাক্কা

সারাদেশে সাড়ে ৮ হাজার কিলোমিটারই ভাঙাচোরা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই অংশে অসংখ্য খানা খন্দকের সৃষ্টি হয়েছে। এ খানা খন্দক সংস্কারে দেয়া ইটের টুকরা উঠে ছড়িয়ে আছে মহাসড়কের মাঝখানে। দুর্ঘটনা ও ক্ষতি এড়াতে গতি কমিয়ে সাবধানে চলাচল করতে হচ্ছে যানবাহনকে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) বলছে, ভারি বৃষ্টিপাত ও ওভারলোডের কারণে মহাসড়কটির এ অবস্থা হয়েছে।

দেশের অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মোট দৈর্ঘ্য ১৯২ কিলোমিটার। এর মধ্যে বড়দারোগার হাট থেকে ধুমঘাট ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশ মীরসরাইয়ে অবস্থিত। এ অংশ এখন ছোট-বড় গর্তে ভরে গেছে। কয়েক দিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে এসব গর্ত আরো বড় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে কার্পেটিংয়ের পাশাপাশি ভেতরের ইট-বালি বেরিয়ে এসেছে। কয়েকদিন আগে সওজের কর্মীরা সৃষ্টি হওয়া গর্ত ইট-বালি দিয়ে ভরাট করেন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই গাড়ির চাকার সঙ্গে লেগে ইট-বালি উঠে যেতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও ইটের টুকরা ছড়িয়ে আছে মহাসড়কের মাঝখানে। এতে মহাসড়কের এ অংশে যানবাহনকে ধীরগতিতে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে পথ পাড়ি দিতে স্বাভাবিকের চেয়ে সময় বেশি লাগছে।

সওজের এইচডিএম প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটার অংশ রয়েছে ফেনী সড়ক বিভাগের অধীনে, যার ২৭ কিলোমিটারই খারাপ অবস্থায় আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে আসন্ন ঈদ যাত্রায় এ অংশ ঘরমুখো যাত্রীদেরকে ভোগান্তিতে ফেলবে।

নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের বেহাল প্রায় অর্ধেক অংশের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছিল গতএপ্রিলে। গত জুনে এ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও তা করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। এ অবস্থায় চলমান বর্ষায় মহাসড়কটিতে দুর্ভোগ বেড়েছে। ছোট-বড় অসংখ্য খানাখন্দে ঘটছে দুর্ঘটনা।

নাটোর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৩২ কিলোমিটার নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ১৪ কিলোমিটার সংস্কারের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সড়ক বিভাগ। এ কাজের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ১৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে কার্যাদেশের পর এপ্রিলে কাজ শুরু করে ঠিকাদার। এরই মধ্যে গত জুনে সংস্কারকাজ সম্পন্নের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়নি, উল্টো ঠিকাদার নতুন করে আগামী জুন পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করেছে।

গত ঈদুল ফিতরের ১০ দিন আগেই সড়কের সংস্কারকাজ শেষ করতে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা ছিল। একই সঙ্গে স্থানীয় সড়ক বিভাগ থেকেও ঈদুল ফিতরের আগে সড়কের অধিকাংশ স্থান সংস্কারের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। এখন আবার ঈদুল আজহা আসন্ন। ঈদের আগে মহাসড়কটির সংস্কারকাজ শেষ না হলে ভোগান্তির মাত্রা বাড়বে।

সারা দেশে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীন সড়কগুলোর ৮ হাজার ৬৬২ কিলোমিটারই ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। সড়কগুলোর খারাপ অংশের কোথাও পুননির্মাণ, কোথাও সংস্কার, কোথাও পিচ ঠিক করা আবার কোথাও ডাবল বিটুমিনাস সারফেস ট্রিটমেন্ট’ (ডিবিএইচ) করা জরুরি বলে উঠে এসেছে মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) বিভাগের বিশ্লেষণে। এই ভাঙাচোরা সড়ক মহাসড়কে দেশের মধ্যাঞ্চলে আবার ধাক্কা মেরেছে বন্যার পানি। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আক্রান্ত এলাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ। এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১১টি মহাসড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে মহাসড়ক ডুবে থাকায় কোনো কোনো অঞ্চলে যান চলাচল বন্ধ আছে। আবার অনেক জায়গায় পানি নেমে গেলেও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক। দুর্গত এলাকার জেলা ও গ্রামীণ সড়কও চলে গেছে বেহাল দশায়।
সারা দেশে সওজের অধীন সড়কের পরিমাণ ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ৩ হাজার ৮১২ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪ হাজার ২৪৬ ও পজলা সড়ক ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার।

এইচডিএমের হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছর সওজের মালিকানাধীন ৮ হাজার ৬৬২ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণে ব্যয় হবে ১০ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। বন্যার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এর সাথে যুক্ত হয়ে খরচের পরিমান আরও অনেক বেড়ে যাবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের তথ্য মতে, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগের আওতাধীন খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি-বান্দরবান আঞ্চলিক মহাসড়কটির কয়েকটি অংশ পানিতে ডুবে আছে। একই অবস্থায় রয়েছে কেরানীহাট-বান্দরবান জাতীয় মহাসড়কও। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি জাতীয় মহাসড়কটির ৫৮তম কিলোমিটারে কলাবাগান নামক স্থানে মাটি ধসে গেছে। এখানে সাময়িক তৎপরতার অংশ হিসেবে এসক্যাভেটর দিয়ে পানির গতিপথ পরিবর্তন ও প্যালাসাইডিং স্থাপন করে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানটি ঝুঁকিমুক্ত করেছে রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগ।

সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের কয়েকটি স্থান পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় যান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে পার্শ্ববর্তী নেয়ামতপুর-তাহিরপুর ও কচিরঘাটি-বিশ্বম্ভরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কেও। সিলেট মৌলভীবাজারের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়কটি তিন থেকে চারটি স্থানে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কের পোড়ার দোকান নামক স্থানে সড়কের প্রায় তিন ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বন্যার পানি। এ অংশটিতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। পারাপারে নৌকা ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা।

সিলেট-গোয়াইনঘাট মহাসড়কের ১১তম কিলোমিটারের বারকিপুরে বন্যায় একটি বেইলি ব্রিজ ভেঙে গেছে। এ পথে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। ক্ষতিগ্রস্ত সেতুটি মেরামতের জন্য বন্যার পানি কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীরা। কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে শ্যামপুর-দুর্গাপুর মহাসড়কও।

২০১৭ সালের বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রংপুর-কুড়িগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক। পরবর্তী সময়ে মহাসড়কটি সংস্কার করা হলেও সা¤প্রতিক বন্যায় কাউনিয়া এলাকায় ফের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থান দিয়ে ছোট ছোট যানবাহন কোনো রকমে চলাচল করলেও ভারী যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
বন্যায় পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত সেতুর এক প্রান্তের এক্সপ্যানশন জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই স্থানটি এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা পরিদর্শন করেছেন। এর বাইরে বন্যায় নির্মাণাধীন যশোর-খুলনা জাতীয় মহাসড়কটিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর-তারাকান্দি সড়কের একাংশ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এ কারণে সড়কটি দিয়ে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সড়কটি মেরামতে সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব মহাসড়ক ছাড়াও দুর্গত এলাকার জেলা ও গ্রামীণ সড়কগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো বন্যাদুর্গত ২১ জেলার অনেক গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে ডুবে রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাইবান্ধা শহরের পিকে বিশ্বাস রোড, সান্তারপট্টি রোড, স্টেশন রোডের কাচারীবাজার থেকে পুরনো জেলখানা পর্যন্ত, ভিএইড রোড, ডেভিড কোম্পানী পাড়ার দুটি সড়ক, মুন্সিপাড়া শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়ক, ব্রিজ রোড কালিবাড়ি পাড়া সড়ক, কুটিপাড়া সড়ক, পূর্বপাড়া সড়ক, একোয়াস্টেটপাড়া সড়ক, বানিয়ারজান সড়ক, পুলিশ লাইন সংলগ্ন সড়ক পানিতে ডুবে রয়েছে। কুড়িগ্রামে ৭২ কিলোমিটার কাঁচা ও ১৬ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এইচডিএমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার, পুনর্বাসন, পুননির্মাণ করতে হবে কুমিল্লা জোনে। এ জোনের সব মিলিয়ে ১ হাজার ১৫০ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণ করতে হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। একইভাবে রাজশাহী সড়ক জোনের সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে ব্যয় হবে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। কুমিল্লা, রাজশাহীর পর সবচেয়ে বেশি সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণের প্রয়োজন হবে সওজের চট্টগ্রাম জোনে। এ জোনের বান্দরবান সড়ক বিভাগে ২১৪ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগে ২৯৮ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার, কক্সবাজারে ১৪৪ দশমিক ৭১ কিলোমিটার, দোহাজারী সড়ক বিভাগে ১৭৭ দশমিক ৮১ কিলোমিটার, খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগে ২১৬ দশমিক ১৭ কিলোমিটার ও রাঙামাটিতে আরো ৭৪ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণ করতে হবে। এসব কাজে ব্যয় হবে ১ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা।

সওজের রংপুর জোনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ বগুড়ায় ২৩২ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার, দিনাজপুরে ১৫৬ দশমিক ১২ কিলোমিটার, গাইবান্ধায় ৩৪ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার, জয়পুরহাটে ৩৯ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার, কুড়িগ্রামে ৮৩ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার, লালমনিরহাটে ৮৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার, নীলফামারীতে ৬৯ দশমিক ২২ কিলোমিটার, পঞ্চগড়ে ২৮ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, রংপুরে ১০৪ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৭৩ দশমিক ১২ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণ প্রয়োজন হবে। এসব কাজে ব্যয় হবে ৮৪৬ কোটি টাকা।

খুলনা সড়ক জোনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৯০২ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণের প্রয়োজন হবে। এতে ব্যয় হবে ৬৪৩ কোটি টাকা। ৯৯৫ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণ করতে হবে ময়মনসিংহ সড়ক জোনে। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা। একইভাবে ঢাকা সড়ক জোনের গাজীপুরে ১৩০ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার, ঢাকা সড়ক বিভাগে ১৬১ দশমিক ৪১ কিলোমিটার, মানিকগঞ্জে ৭৭ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার, মুন্সীগঞ্জে ১১৫ দশমিক ৭২ কিলোমিটার, নারায়ণগঞ্জে ১২৩ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার ও নরসিংদীতে ১৯২ দশমিক ৪১ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করতে হবে। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা।
অন্যদিতে সিলেট জোনে ভাঙাচোরা সড়ক আছে ৫৮৫ কিলোমিটার। এগুলো মেরামত করতে ব্যয় করতে হবে ৯০৮ কোটি টাকা। এছাড়া বরিশাল জোনে সব মিলিয়ে ৫৭৬ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণ করতে হবে। এতে ব্যয় হবে ৫৬০ কোটি টাকা।

ভুক্তভোগিদের মতে, প্রতি বছরই বর্ষা এলেই সওজের সংস্কারের তৎপরতা দেখা যায়। ঈদকে সামনে রেখে এ তৎপরতা বাড়ানো হয় কয়েক গুণ। ঈদযাত্রা নির্বিঘেœর নামে জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে সংস্কার কাজ করা হয়। যা প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজে আসে না। অথচ মে মাসের আগেই সব ধরণের সংস্কার কাজ শেষ করার নিয়ম আছে। সে নিয়ম মানা হয় না কখনওই।

https://www.dailyinqilab.com/article/221968/