২১ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ৩:৪৮

উত্তরাঞ্চলে বন্যার উন্নতি, মধ্যাঞ্চলে অবনতি

ঘরছাড়া লাখো মানুষ

চার জেলায় আরও ১০ জনের মৃত্যু, নিখোঁজ ১ * নবাবগঞ্জে পানিবন্দি ১২ গ্রাম চরভদ্রাসনে সাপ আতঙ্ক * ১৬ নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে

উত্তরের জেলাগুলো থেকে নেমে আসছে বন্যার পানি। সেই পানি জমছে মধ্যাঞ্চলে। এ কারণে দিন দিন মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। পানি নেমে আসায় উত্তরের জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে এখনও পুরোপুরি বন্যামুক্ত নয় কোনো জেলা। বরং আরও এক সপ্তাহ ধরে উত্তরের বিভিন্ন জেলা বন্যার পানির নিচে থাকবে। আবহাওয়া ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা এসব কথা জানিয়েছেন।

এদিকে বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে লাখো মানুষ বাড়িঘরছাড়া। সীমাহীন দুঃখ-কষ্টে দিন কাটছে তাদের। অনেকে সহায়-সম্বল নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র, বাঁধ বা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ বা বাঁশের মাচা তৈরি করে তার ওপর অবস্থান নিয়েছেন। বন্যার্ত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গবাদি পশু ও গো-খাদ্য নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।

প্রকৃতির ডাক এলেই চরম ভোগান্তিতে পড়েন বানভাসি নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। অনেকে পানিতেই সারছেন প্রাকৃতিক কাজ। এর ফলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে চার জেলায় আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া নিখোঁজ হয়েছেন একজন।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। এ সময়ের মধ্যে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। গঙ্গা-পদ্মার অন্যান্য পয়েন্টে পানি বাড়ছে। পাশাপাশি বানের পানি নেমে আসায় পদ্মা এবং যমুনার বিভিন্ন শাখা নদীতে পানির স্তর বাড়ছে। সুরমা-কুশিয়ারার পানির স্তর কমছে। কিন্তু উজান থেকে পানি নেমে আসায় মেঘনা অববাহিকার বিভিন্ন শাখা নদীতে বাড়ছে পানির স্তর। এসব কারণে ঢাকার আশপাশের নদীতে পানি বাড়ছে। শনিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে লক্ষ্যা নদী বিপদসীমা পার করেছে। আজ মুন্সীগঞ্জে ধলেশ্বরী বিপদসীমা পার করতে পারে বলে আশঙ্কা আছে।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বানের পানি এবং বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হয়েছে এ বন্যা। তবে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে বৃষ্টি কমে গেছে। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে আছে- কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, শেরপুর জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়। শনিবার বন্যার পানি ঢুকে নারায়ণগঞ্জে। তবে এফএফডব্লিউসির মতে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় বগুড়া, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

শনিবার এফএফডব্লিউসির দেয়া বুলেটিনে বলা হয়, ১৪ নদ-নদীর পানি ২১ স্টেশনে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হয়েছে। তবে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত নদী ও স্টেশনের সংখ্যা আরও বেশি বলে যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। এফএফডব্লিউসি বলছে, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন সুরমা, তিতাস, মেঘনা, ধরলা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, ধলেশ্বরী ও পদ্মা বিপদসীমার ওপরে আছে। শনিবার নতুন করে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র জামালপুর এবং চকরহিমপুরে করতোয়া বিপদসীমার ওপরে চলে গেছে।

যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানান, কংশ, গুর, বাঙালি, ছোট যমুনাও বিপদসীমার ওপরে আছে। বিপদসীমার কাছে অবস্থান বালু নদ ঢাকার ডেমরা পয়েন্টে। শেরপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধীরাইতে পুরাতন সুরমা, নওগাঁয় ছোট যমুনাও বিপজ্জনকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে জামালপুরের একটি অংশ, পদ্মার কারণে শরীয়তপুরের মানুষও বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে আগামী ২৪ ঘণ্টায়। চাঁদপুর, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় বন্যার পানির চাপ বাড়বে।

ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

ফরিদপুর ও চরভদ্রাসন : পানি বৃদ্ধির ফলে ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুরে নিুাঞ্চলের পানিবন্দি মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান জানান, তার ইউনিয়নের ৩শ’ একর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। আসন্ন কোরবানির ঈদ সামনে রেখে অনেকেই গরু পালন করেছেন। গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। এদিকে চরভদ্রাসন উপজেলার চরাঞ্চলে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে সাপ আতঙ্ক। স্রোতের টানে ভেসে আসা কচুরিপানার সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে চন্দ্রবোড়া সাপ।

ইতিমধ্যে এ সাপের দংশনের শিকার উপজেলার চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের সেলিম হোসেন ও মিয়াজান ফকির। তারা দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শনিবার উপজেলার বন্যাদুর্গত এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের মাঠি জমিতে ৭৩০টি পরিবার পানিবন্দি। প্রতিটি পরিবার বসতঘরে বাঁশের চালা তৈরি করে তার ওপর দিন কাটাচ্ছে।

গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি ধীরগতিতে কমছে। তবে করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া শনিবার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া, জুমারবাড়ী ও ঘুড়িদহ ইউনিয়নে ২ হাজার পরিবারের মধ্যে চাল, চিড়া, মুড়ি, গুড়, স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানির বোতল বিতরণ করেন। সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি এমপির উদ্যোগে ও পৌর আওয়ামী লীগের সহায়তায় গাইবান্ধা শহরে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে রুটি বিতরণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

একই দিন সদর উপজেলার বল্লমঝারসহ ঘাগোয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ ঘাগোয়া দাখিল মাদ্রাসা আশ্রয় কেন্দ্র ও তালতলা বাজার সংলগ্ন ঘাঘট রক্ষাবাঁধে আশ্রিত ৬শ’ বানভাসি মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেন জেলা ও উপজেলা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা।

সিলেট ও বালাগঞ্জ : বন্যায় গোয়াইনঘাট উপজেলায় রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার পাকা ১৬৯ কিলোমিটার সড়কের ৯০ কিলোমিটার পানির নিচে ছিল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সারিঘাট-গোয়াইনঘাট, সালুটিকর-গোয়াইনঘাট, হাতির পাড়া-ফতেহপুরসহ উপজেলার সিংহভাগ সড়ক। ডৌবাড়ী কাপনা নদীর ওপর নির্মিত হাকুর বাজার ব্রিজের অ্যাপ্রোচ ভেঙে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত বালাগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে উপজেলা প্রশাসনের অফিস পাড়াসহ পুরো বালাগঞ্জ বাজার। বানের পানিতে বিপুল পরিমাণ আউশ-আমন ফসল ও বীজতলা তলিয়ে গেছে। কাঁচা-পাকা সড়ক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কুমিল্লা : পাহাড়ি ঢলে জেলার আদর্শ সদর উপজেলার গোলাবাড়ী, সাহাপুর, পাঁচথুবী, আলেখারচর, বুড়িচং উপজেলার ষোলনল, পীরযাত্রাপুর ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম, দেবিদ্বার উপজেলার ১৭টি গ্রাম, মুরাদনগর উপজেলার ৯টি গ্রাম, তিতাস এবং দাউদকান্দি উপজেলার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের কয়েক হাজার কৃষকের ফসলি জমি ও শাকসবজি নদীর জলে ভেসে গেছে। গোমতী নদীর বেড়িবাঁধের ভেতরে এবং চরে বসবাসরত লাখ লাখ বাসিন্দা পানিবন্দি। হঠাৎ এ পাহাড়ি ঢলে চরের বাসিন্দা এবং কৃষকরা চরম বিপাকে পড়েছেন। কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হলেও কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না ক্ষতিগ্রস্তরা।

শরীয়তপুর : জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার নিুাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নিুাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় শাকসবজি ও আউশ-আমন ধান ঝুঁকির মুখে পড়েছে। দুই উপজেলার বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে।

শেরপুর : জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুরনো ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবল বেগে প্রবেশ করায় প্রতি মুহূর্তে চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্রের শাখা মৃগী নদীর পানির প্রবল চাপে সদর উপজেলার বেতমারি-ঘুঘুরাকান্দি ইউনিয়নের বেতমারি বেড়িবাঁধ প্রায় ২০০ ফুট ভেঙে গেছে। এতে বেতমারি, চরখারচর, ঘুঘুরাকান্দিসহ আশপাশের ৫ গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েন।

বন্যার পানিতে খুনুয়া-ঘুঘুরাকান্দি সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় এবং কয়েকটি স্থানে ভাঙনের কারণে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এদিকে শনিবার বন্যার পানিতে ডুবে যুগিনিমোড়া গ্রামে নূপুর (৭) ও কুলুরচর বেপারিপাড়া গ্রামে হারুন (৪০) মারা গেছেন। এর আগে শুক্রবার বিকালে ও রাতে নতুন ভাগলগড় এলাকায় রুবেল হোসেন (১৩) নামে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র, চরবাবনা নামাপাড়া এলাকায় শিশু শামীম (৬) ও সাতপাকিয়া এলাকার খুশি (৬) পানিতে ডুবে মারা যায়।

টাঙ্গাইল, ভূঞাপুর, নাগরপুর ও কালিহাতী : জেলায় বন্যার পানি কিছুটা কমলেও বাড়ছে পানিবাহিত রোগব্যাধি। নাগরপুর উপজেলার কলমাইদে পানিতে ডুবে কলমাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিশুশিক্ষার্থী রাকিবুলের মৃত্যু হয়েছে। সে কলমাইদ গ্রামের আমিনুরের ছেলে। পানি আটকে থাকায় ভূঞাপুর-টাঙ্গাইল সড়?কের শ্যামপুরে নির্মাণাধীন সেতুর পাশে তৈরি ডাইভারসন কেটে দিয়েছে পানিবন্দি মানুষ। এতে টাঙ্গাইলের সঙ্গে ভূঞাপুরের সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

শনিবার দুপুরে সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম। এদিকে ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক মেরামত কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী।

কুড়িগ্রাম, চিলমারী ও নাগেশ্বরী : জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত হলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। নেই খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি। নেই শৌচোকর্ম সারার সুব্যবস্থা। প্রকৃতির ডাক এলেই চরম ভোগান্তিতে পড়েন নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। কারও ঘরে ভাত রান্না হলেও নেই তরকারি। ফলে শুকনো ভাত লবণ দিয়ে খাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। এ দুর্ভোগ জেলার প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বানভাসি মানুষের। চিলমারী উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি স্থানীয়দের।

চিলমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বীরবিক্রম বলেন, তার জানামতে গত ১০০ বছরে এত পানি চিলমারীর মানুষ দেখেনি। উপজেলার ৩০ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ২৪ ঘণ্টায় পানির তোড়ে অষ্টমীর চর ইউনিয়নের ৭৮টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। শনিবার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে খামার বাঁশপাতারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

রমনা রেলস্টেশনের উত্তরে রেললাইনের নিচ থেকে ১৫০ মিটার এলাকার মাটি পানির তোড়ে সরে যাওয়ায় রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। চিলমারী উপজেলা সদরের থানাহাট ইউনিয়নের খড়খড়িয়া গ্রামের আবুহার আলী (৫০) বলেন, স্ত্রী-ছেলেমেয়েসহ ৬ জনের পরিবার নিয়ে গত ৭ দিন পানিবন্দি জীবন। আজ পর্যন্ত সরকারি কিংবা বেসরকারি ভাবে কোনো খাদ্য সহায়তা মেলেনি। ঘরে চালের যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে অল্প অল্প করে রান্না করলেও ছিল না কোনো তরিতরকারি।

হালুয়াঘাট ও ফুলপুর (ময়মনসিংহ) : শনিবার বন্যার পানিতে ডুবে দুই চাচাতো ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বেলা ১১টার দিকে উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের চকেরকান্দা গ্রামের হজরত আলীর ছেলে জিহাদ (৪) এবং আইয়ুব আলীর ছেলে তানজিল (৪) বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে একজন পা ফসকে পানিতে পড়ে যায়। অন্যজন তাকে বাঁচাতে পানিতে নামলে দু’জনই স্রোতে ভেসে যায়। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা। এদিকে ফুলপুরের বনগাঁও গ্রামে শনিবার দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে সুনিয়া খাতুন (১৩) নামে এক কওমি মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সে নগুয়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে।

বকশীগঞ্জ : ব্রহ্মপুত্র ও দশানী নদীর পানি বেড়ে দু’কূল উপচে বকশীগঞ্জ পৌরসভার ৫টি ওয়ার্ডসহ, বগারচর, সাধুরপাড়া, মেরুরচর নিলাক্ষিয়া, বাট্রাজোড় ও কামালপুর ইউনিয়নের ১৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় পৌর শহরের সীমারপাড় এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সুজন মিয়া (৩০) উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নের ঘুঘুরকান্দি গ্রামে বানের পানি দেখতে গিয়ে দশানী নদীতে পড়ে নিখোঁজ হন। শনিবার বিকাল পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি। একই দিনে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের আইরমারী খানপাড়া গ্রামে রাশেদ খানের শিশু সাকিব খান (৫) পানিতে ডুবে মারা যায়।

নবাবগঞ্জ : ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকার ১২টি গ্রামের প্রায় ২৫শ’ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব এলাকার বাসিন্দাদের বসতভিটা, কৃষিজমি, মসজিদ, মন্দির, স্কুল ও হাটবাজারে পানি প্রবেশ করেছে। কৃষি ফসল তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ডুবে গেছে গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক ও ৪টি সেতু। বন্যাকবলিত গ্রামবাসী নৌকায় যাতায়াত করছেন। বালেঙ্গা, ঘোসাইল ও রায়পুর বাজারের অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে ঘরবাড়ি রেখে পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তারা এখনও কোনো সরকারি ত্রাণ বা কর্মকর্তার দেখা পাননি। বন্যাকবলিত আশয়পুর গ্রামের নির্মাণ শ্রমিক শামসুল হক বলেন, ১০ দিন ধরে আমরা পানিবন্দি। আমার ৫ বিঘা পাট ও শাকসবজির ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

জামালপুর ও দেওয়ানগঞ্জ : বানভাসিদের ৮টি বড় ঘর আগুনে পুড়ে ছাই এবং ৬টি গবাদি পশু দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। শনিবার দুপুরে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা চর আমখাওয়া ইউনিয়নের সানন্দবাড়ী পশ্চিম পাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন জানান, গো-খাদ্য হিসেবে খুদ রান্না বসিয়ে পাশের বাড়িতে গেলে রান্নাঘরে আগুন ধরে যায়। আশপাশের লোকজন বিদ্যুতের কারণে আগুন ধরেছে এমন ধারণায় ভয়ে আগুন নেভাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। এদিকে ইসলামপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির উদ্যোগে যমুনা তীরবর্তী বন্যার্তদের মাঝে গত দু’দিনে ১ হাজার ২০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/201408