২০ জুলাই ২০১৯, শনিবার, ৪:১৭

হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবের অনিয়ম

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল যত্রতত্র হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ল্যাব গড়ে উঠছে। মানসম্মত হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার জন্য একশ্রেণির অসৎ ব্যক্তি এবং চিকিৎসাবণিক রোগীদের সঙ্গে প্রতারণায় জড়িত। এমন অভিযোগ পুরনো হলেও সাম্প্রতিক এদের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডাক্তারি পড়েননি এমন লোকও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেজে চিকিৎসা প্রদানসহ ক্লিনিক ও হাসপাতাল খুলে বসছেন। এসব রিপোর্ট কেবল আমাদের স্তম্ভিতই করে না। আমাদেরকে সমাজের সভ্য মানুষ ভাবতেও দ্বিধান্বিত করে। মেট্রোপলিটন সিটি ঢাকাতেই নয়, এর বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, দিনাজপুর, রংপুরসহ অন্য মফস্বল শহরগুলোতেও এদের দাপট বেড়েছে বলে পত্রিকার খবর ও টিভি রিপোর্টে প্রকাশ। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাবে প্রায়শ র‌্যাব ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে জেল-জরিমানা করলেও একশ্রেণির চিকিৎসাবণিকের লাগাম টেনে ধরা যেন সম্ভব হচ্ছেই না। এমনকি এপোলো, স্কোয়ার, ইউনাইটেডের মতো বিশেষায়িত হাসপাতালেও অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, মেডিকেল পরীক্ষার রিএজেন্ট, কেমিকেল পাওয়া যাচ্ছে। গতবছর ঢাকা মহানগরীর ধানম-ির পপুলার ডায়াগনস্টিক ল্যাবে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এজন্য সংশ্লিষ্টদের ২৫ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়। এরপরও এসব হাসপাতাল বা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রের অনিয়ম বন্ধ হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও চিকিৎসাসেবার নামে জমজমাট বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। ম্যাক্স হাসপাতাল নামক একটি চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুলে এক সাংবাদিকের আড়াই বছর বয়সের শিশু মারা যায় গতবছর। সামান্য গলাব্যথা আর ঠা-াকাশি নিয়ে শিশুটিকে ঐ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আউটডোরে উপযুক্ত চিকিৎসা দিলেই যেখানে ঠা-াকাশি ভালো হয়ে যাবার কথা, সেখানে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করেও সুচিকিৎসা দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল। শেষপর্যন্ত বাচ্চাটি মারাই যায়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্টসহ থানায় মামলা হলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তাররা ক্ষুব্ধ হন এবং কোনও সাংবাদিকের সন্তানের চিকিৎসা করবেন না বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। চিকিৎসকরা যেহেতু মানুষ। তাই কোনও চিকিৎসকের ভুল হতেই পারে। উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে রোগীর আত্মীয়স্বজনের ক্ষুব্ধ হবারও যৌক্তিক কারণ থাকে। এমনকি মামলা হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার রোগীর ক্ষুব্ধ আত্মীয়স্বজনদেরও বাড়াবাড়ি হতে পারে। সবই আপেক্ষিক ও তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই বলে কোনও কমিউনিটির সন্তানের চিকিৎসা বন্ধ করে দেবার হুমকি কোনও ডাক্তার দিতে পারেন কি? কোনও চিকিৎসকের কারুর চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেবার হুমকি প্রদান শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, চরম অমানবিকও। বলাবাহুল্য, আলোচ্য ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টেও সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। ঐসময় উচ্চ আদালতের মন্তব্য ছিল এরকম, ‘ভুলের বৈধতা দিতে ধর্মঘট ডাকা অন্যায় এবং ডাক্তারি এখন দুর্বৃত্তের পেশায় পরিণত।’ হ্যাঁ, এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের! একশ্রেণির ডাক্তারও ধর্মঘট ডেকে বিপন্ন রোগীদের জিম্মি করতে পারেন। তবে সব ডাক্তার, হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক ল্যাবকে আমারা দোষ দেই না। নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও ভালো চিকিৎসা হয়। অনেক রোগী সেরে ওঠেন। এমন উদাহরণও যথেষ্ট আছে এদেশে।

উল্লেখ্য, গতবছর রাইফা নামে এক শিশুর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু নিয়ে হৈচৈ হলে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করতে গেলে নানা অনিয়ম পাওয়া যায়। হাসপাতালটির লাইসেন্সের মেয়াদও দুই বছর আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তার আগে সেটি নিয়মমাফিক নবায়নও করা ছিল না। মানে যাকে বলা যায়, অনিয়মের সীমাহীন ধারাবাহিকতা! এসব কারণে ম্যাক্স কর্তৃপক্ষকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল আদালত। এর প্রতিবাদে প্রাইভেট হাসপাতালের মালিকরা ধর্মঘট ডেকে বন্দরনগরীর সব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য প্রশাসনের আশ্বাসে ধর্মঘট স্থগিত হয়েছিল। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে কি আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাবে না? বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সবগুলোই যে অনিয়ম করছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সবগুলোকে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেছে তাও নয়। তাহলে কি লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ল্যাব সবই চলবে? হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসাসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কি অনুমোদন ও নিয়মনীতি ছাড়া চলা উচিত? নিশ্চয়ই না। তাই মানুষের স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথা সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি, ডায়াগনস্টিক ল্যাবে যাতে কোনও অনিয়ম আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায় এবং রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলতে কোনও পক্ষ যাতে দুঃসাহসী না হতে পারে সে ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনিক নজরদারি জরুরি।

https://www.dailysangram.com/post/383406