২০ জুলাই ২০১৯, শনিবার, ৪:১৫

শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকা গায়েব

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: দিন যতই যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর পরিমাণও বাড়ছে। গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবসেই দেশের পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। তার আগের সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবসেই দরপতন হয়। এমন টানা দরপতনে দুই সপ্তাহে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক হারিয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাওয়া হয়ে গেছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। লেনদেন খরা দেখা দিয়েছে। বাজারের এমন দুরবস্থায় কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজার ভয়াবহ দরপতনের কবলে পড়েছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হতাশা। তবে অতীতের বহু বারের মতো চলমান দরপতনেরও যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে এ মন্দা অবস্থার জন্য কারসাজি চক্রকে দায়ী করা হচ্ছে। ফলে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা এসব বিনিয়োগকারী শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দারস্থ হয়েছেন। দিয়েছেন ১৫দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি।

ভয়াবহ দরপতনের প্রতিবাদে দিনের পর দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করতে থাকা বিনিয়োগকারীরা গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের নামে দেয়া এ স্মারকলিপিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানসহ পুরো কমিশনারদের অপসারণ করে কমিশন পুনর্গঠন করাসহ ১৫ দফা দাবি জানানো হয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। যা আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৪ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। আর দুই সপ্তাহ আগে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে দুই সপ্তাহে ১৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা বাজার মূলধন হারিয়েছে ডিএসই।

বাজার মূলধনের বড় পতনের পাশাপাশি গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৫৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের মধ্যে ৬৬টির দাম আগের সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে। অপরদিকে দাম কমেছে ২৭২টির। আর দাম অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫টির। অর্থাৎ লেনদেনে অংশ নেয়া ৭৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে। আগের সপ্তাহে দরপতন হয় ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের।

সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতনের সঙ্গে মোটা অঙ্কের বাজার মূলধন হারানোর পাশাপাশি ডিএসইর সব সূচকের বড় পতন হয়েছে। গত সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৯১ দশমিক ৬০ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগের সপ্তাহে এ সূচকটি কমে ১৫৮ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ দুই সপ্তাহের মধ্যেই ডিএসই প্রধান মূল্য সূচক হারিয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।

প্রধান মূল্য সূচকের পাশাপাশি বড় পতন হয়েছে অপর দুটি মূল্য সূচকের। এর মধ্যে গত সপ্তাহে ডিএসই-৩০ আগের সপ্তাহের তুলনায় কমেছে ২৮ দশমিক ১৩ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৫১ শতাংশ। আগের সপ্তাহে এ সূচকটি কমে ৫২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর গত সপ্তাহে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক কমেছে ১৮ দশমিক ৪৬ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আগের সপ্তাহে এ সূচকটি কমে ৩৮ দশমিক ৭৯ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

পুঁজিবাজারের এমন পতনের বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, কারসাজি চক্রের খপ্পরে পড়ে বাজারে প্রতিনিয়ত দরপতন হচ্ছে। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে একটু একটু করে নিঃশেষ হচ্ছেন। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা কোনো উপায় না পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছি। আশা করি প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজারের অসহায় বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়াবেন।

এদিকে দরপতনের পাশাপাশি বাজারে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৩২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ৪২২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন কমেছে ৯৫ কোটি ২২ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৬৩৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় ২ হাজার ১১২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোট লেনদেন কমেছে ৪৭৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
দরপতনের সঙ্গে লেনদেন খরা দেখা দেয়ায় বিনিয়োগকারীরা বলছেন, দিনের পর দিন দরপতন হচ্ছে। মুনাফা তো দূরের কথা আসল পুঁজির অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। দিন যত যাচ্ছে বাজারের চিত্র ততই করুণ হচ্ছে। দরপতনের সঙ্গে এখন দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। বাজারের এ পরিস্থিতিতে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর দিশেহারা অবস্থা। শেয়ারবাজার থেকে বেরিয়ে যাব সে উপায়ও নেই। রাতে ঘুমাতে গেলে খালি ভাবি কেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে এসেছিলাম। হতাশায় রাতে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারি না।

এদিকে দরপতন ও লেনদেন খরার সঙ্গে ভালো কোম্পানি বা ‘এ’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। গত সপ্তাহে মোট লেনদেনের ৮০ দশমিক ১১ শতাংশ ছিল ‘এ’ গ্রুপভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের। তার আগের সপ্তাহে মোট লেনদেনের ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল এ গ্রুপের দখলে। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ভালো কোম্পানির শেয়ার লেনদেন ৩ শতাংশের ওপরে কমেছে।

ভলো কোম্পানির শেয়ার লেনদেন কমার মধ্যে পঁচা কোম্পানি বা ‘জেড’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ‘বি’ গ্রুপের লেনদেন। গত সপ্তাহের মোট লেনদেনের ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছিল ‘বি’ গ্রুপের দখলে, যা আগের সপ্তাহে ছিল ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। মোট লেনদেনে ‘জেড’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের অবদান বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ৯১ শতাংশ, যা আগের সপ্তাহে ছিল ১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। আর ‘এন’ গ্রুপের অবদান ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ফরচুন সুজের শেয়ার। কোম্পানিটির ৯৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যা সপ্তাহজুড়ে হওয়া মোট লেনদেনের ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশনের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা সপ্তাহের মোট লেনদেনের ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। ৩৫ কোটি ৬১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে গ্রামীণফোন। লনদেনে এরপর রয়েছে- সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স, সী-পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বিকোন ফার্মাসিউটিক্যাল, মুন্নু সিরামিক এবং ঢাকা ইন্স্যুরেন্স।

https://www.dailysangram.com/post/383424