১৯ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ১১:২১

পদ্মা-যমুনায় পানি বৃদ্ধিতে ফেরি চলাচল ব্যাহত

বানভাসিদের হাহাকার বাড়ছে

বিভিন্ন জেলায় ঘরহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ; পানি কমার সাথে সাথে বাড়ছে নদীভাঙন ; হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে

বন্যা শুরুর এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। বরং পদ্মা ও যমুনায় পানি আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে এসব নদী পারাপারে সঙ্কটে পড়ছে ফেরিসহ অন্যান্য যানবাহনগুলো। পানি বৃদ্ধি ও বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে বানভাসি মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও বেশির ভাগ মানুষ হাঁটুপানি, কোমর পানির মধ্যেই নিজেদের বসতভিটায় রয়ে গেছেন। তবে সব এলাকাতেই খাদ্য-পানি ও ওষুধের সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। ত্রাণের জন্য তাই হাহাকারও ক্রমে বাড়ছে। বন্যার পানিতে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান, পাট, সবজিসহ ভিন্ন ফসলের ক্ষেত বিনষ্ট হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা। এদিকে টাঙ্গাইলে বন্যার পানিতে ডুবে দুই বোন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

বগুড়া অফিস জানায়, জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও উপজেলার ১৯টি ইউনিয়নের ১২৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ৩১ হাজার ৫৮৫টি পরিবারের ১ লাখ ২৪ হাজার ২২০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও তা একেবারেই অপর্যাপ্ত। এ দিকে ধুনটের সহড়াবাড়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশের রাস্তা ভেঙে দেড়শতাধিক বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে। এ পর্যন্ত বন্যাকবলিত ২ হাজার ২৫০টি পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে এবং ৬৫০টি পরিবার অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। তিন উপজেলার ৮৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত জেলায় ৮ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমির পাট, আউশ, শাকসবজি, মরিচ ও আমনবীজতলা পানিতে ডুবে গেছে। বন্যায় ২ হাজার ৩৩০ টি ল্যাটট্রিন ও ২ হাজার ৭৩৬টি নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বেড়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার নদীবেষ্টিত এলাকাগুলোতে ২২ হাজার ২১২টি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পাঁচ উপজেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় দেড়লাখ মানুষ। জেলার প্রায় ছয় হাজার ৪০০ হেক্টর জমির পাট, রোপা আমন,আউশ ও সবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। অন্য দিকে, যমুনা নদীর প্রবল ¯্রােতে মঙ্গলবার রাতে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার মেঘাই এলাকায় যমুনা নদী সংলগ্ন রিং বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার ধসে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে যায়। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়ে পাঁচ শতাধিক পরিবারের মানুষ।
কাজিপুরে যমুনার পেটে গেল খাসরাজবাড়ী বাজার

কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, চোখের সামনে ভাইসা গেল আমার দোকান ঘর। চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই কইরবার পারিলাম না। কথাগুলো বলছিলেন সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের খাসরাজবাড়ী বাজারের ব্যবসায়ী হোসেন আলী। বৃহস্পতিবার দুপুরে কোনো কিছু বুঝে উঠবার আগেই ওই বাজারের হোসেন মিয়াসহ কোব্বাত, রহিম, নরু, মিথুনদের ব্যবসায়িক দোকান ঘরগুলো যমুনার পেটে চলে যায়।
খাসরাজবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম জানান, তিন দিন ধরে ওই বাজারের ঘরগুলোতে পানি উঠেছিল। গতকাল দুপুরে ঘরগুলো নিচের দিকে দেবে যায়। ফলে ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ওই গ্রামের গ্রামপুলিশ কার্তিক চন্দ্র জানান, সকালে আমি কাজে বাড়ির বাইরে যাই। দুপুরে ফিরে এসে দেখি আমার বাড়ি নাই। দুই দিন আগে আমার পরিবারকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে ছিলাম বলে তারা রক্ষা পেয়েছে। ব্যবসায়ী কোব্বাত ব্যাপারি জানান, পানির নিচ দিয়ে কখন ভাঙন শুরু হয়েছে, তা বুঝতে পারিনি। ঘরের সাথে দোকানে মালামাল সব নদীতে ভেসে গেছে।

এ দিকে মাইবাড়ী ইউনিয়নের ঢেকুরিয়া বাজারসংলগ্ন ওয়াপদা বাঁধ চুইয়ে পানি বের হচ্ছে। যেকোনো সময় ওই স্থানে ঘস নামতে পারে বলে জানান, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আবদুস সালাম। তিনি আরো জানান, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

কাজিপুরের ৬টি ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলসহ ৪টি ইউনিয়নের ২৮ হাজার ৫৮৫ পরিবারে এখন খাবার-পানি কিছুই নেই। এসব পরিবারের এক লাখ ২৮ হাজার ৬৩০ জন মানুষ তাদের গবাদি পশুসহ অবর্ণনীয় কষ্টে দিন পার করছেন। এদের বেশির ভাগ মানুষই বন্যার থই থই পানির মাঝে বাড়িতে নৌকায় ও ঘরের ভেতর মাচা উঁচু করে অতিকষ্টে দিন-রাত যাপন করছেন। যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তারাও পড়েছেন নানা দুর্ভোগে। কোথাও কোথাও বন্যাদুর্গতদের আশ্রিত স্থানেও হানা দিয়েছে বন্যার পানি।

গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। এতে গাইবান্ধা পৌর এলাকাসহ চারটি উপজেলার নতুন নতুন এলাকা পাবিত হয়েছে। পানিবন্দী মানুষ এবং বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত বন্যার্ত মানুষেরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এ দিকে ত্রিমোহিনী থেকে বোনারপাড়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় রেললাইনের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত অব্যাহত থাকায় লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে গাইবান্ধার ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বোনারপাড়া জংশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। অপর দিকে, গাইবান্ধার বিভিন্ন সড়কে পানি ওঠে যাওয়ায় সেখানে সব যানবাহন ও পথচারীদের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

এ দিকে চরাঞ্চলের পানিবন্দী মানুষ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। গবাদি পশুর খাদ্য সঙ্কটও দেখা দিয়েছে।

টাঙ্গাইল সংবাদদাতা জানান, কালিহাতী উপজেলার চরদুর্গাপুর গ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে সহোদর দুই বোনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলোÑ আবু সাঈদের মেয়ে তানজিলা (৮) ও লিমা (৫)। স্থানীয় একটি স্কুলে তানজিলা তৃতীয় শ্রেণী ও লিমা প্রথম শ্রেণীতে পড়ত। দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আনোয়ার হোসেন প্রামাণিক জানান, বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে খেলার সময় তারা দুই বোন ¯্রােতে ভেসে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। বেলা ২টার দিকে বাড়ির পাশেই তাদের লাশ ভেসে উঠে। এ দিকে গত বুধবার টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ঝিনাই নদীতে ডুবে কেরামত ওরফে কিপু (৭৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি কালিহাতী উপজেলার হরিপুর গ্রামে। জামালপুর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে সন্ধ্যায় ওই বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে।

মাদারীপুর সংবাদদাতা জানান, পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে ফেরি পারাপারে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটছে। বিআইডব্লিউটিসি কাঁঠালবাড়ি ঘাট সূত্রে জানা যায়, পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শিমুলিয়া-কাঠালবাড়ি নৌরুটে গত বুধবার তীব্র ¯্রােতের গতিবেগ আরো বেড়ে যায়। মূল নদী থেকে লৌহজং টার্নিংয়ে প্রবেশমুখে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ ঘূর্ণাবর্ত। ¯্রােতের গতিবেগ বৃদ্ধি পেলে ¯্রােতের সাথে চলতে না পারায় এ রুটের সব ডাম্ব ফেরিসহ ১১টি ফেরি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। বাকি ৬টি ফেরি ঝুঁকিপূর্ণভাবে দীর্ঘসময় ব্যয় করে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে। এতে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ৬ শতাধিক যানবাহনসহ উভয় পাড়ে সহ¯্রাধিক যানবাহন আটকে পড়ে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির বেশ উন্নতি রয়েছে। তবে পানি কমার সাথে সাথে তিস্তা-ধরলা নদী সংলগ্ন অনেক গ্রামে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ গ্রামের পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ওই সব দুর্গত এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সবমিলে দুর্ভোগে রয়েছে জেলার পাঁচ উপজেলার বানভাসীরা। বন্যাকবলিত এলাকার পানি ধীরগতিতে নামায় এখনো বন্ধ রয়েছে অর্ধশতাধিক বিদ্যালয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও ভাঙনরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।

মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, পদ্মা-যমুনায় প্রবল স্রোতের কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটে ফেরি চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন তিনগুণ সময় বেশি লাগছে। ফলে প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাক ঘাট পার হতে দুই-তিন দিনও লেগে যাচ্ছে। বিআইডব্লিউটিসি আরিচা এরিয়া অফিসের ডিজিএম মো: আজমল হোসেন জানান, এ মুহূর্তে পাটুরিয়া ঘাটের দুটি টার্মিনালে চার শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আটকে আছে। বাসগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফেরি সঙ্কটের পাশাপাশি ফেরিগুলো বেশ পুরনো হওয়ায় স্রোতের বিপরীতে চলাচল করতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে অপেক্ষমাণ গাড়ির যাত্রী ও চালকরা। অন্য দিকে বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাটের মেরিন বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো: আব্দুস সোবাহান জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীতে দ্রুত পানি বৃদ্ধি ও প্রবল স্রোতের কারণে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। পদ্মা-যমুনায় পানি বৃদ্ধির সাথে সাথেই জেলার দৌলতপুর, ঘিওর, শিবালয় ও হরিরামপুর উপজেলার নদী-তীরবর্তী এলাকায় শুরু হয়েছে ব্যাপক ভাঙন।

কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি কমতে শুরু করলেও টানা ৯দিন ধরে পানিবন্দী মানুষ রয়েছে চরম দুর্ভোগের মধ্যে। সীমিত আকারে ত্রাণ শুরু হলেও অনেক জায়গার মানুষই ত্রাণ পায়নি বলে জানিয়েছে। ফলে বানভাসি মানুষ রয়েছে খাদ্য সঙ্কটে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৭ সেমি কমে গিয়ে এখন ১২৫ সেমি এবং ধরলা নদীর পানি ১১ সেমি কমে গিয়ে ১০৫ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার রাতে চিলমারী উপজেলার কাচকল এলাকায় বাঁধ ভেঙে গোটা উপজেলা পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলায়। তিন উপজেলায় সব ধরনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। কোমর পানিতে তলিয়ে আছে উপজেলা প্রশাসন, থানা, হাসপাতালসহ গোটা এলাকা। এখন পর্যন্ত বন্যায় ৫৬টি ইউনিয়নের ৫৭৮টি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে সাড়ে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
এদিকে উলিপুরের ধামশ্রেণী ইউনিয়নের মধ্যনাওড়া গ্রামে বাবলু মিয়ার কন্যা ববিতা খাতুন (১৬) পানি ভেঙে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ডোবা রাস্তা ধরে বাড়িতে আসার পথে খালে পড়ে মারা যায়। এ নিয়ে গত ৯ দিনে জেলায় পানিতে ডুবে মারা গেল ১৪ জন।

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, তাহিরপুর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে দক্ষিণ শ্রীপুর ও তাহিরপুর ইউনিয়নের বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এসব এলাকায় তেমন কোনো ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের বলাইকান্দি গ্রামের অজুফা বেগম ও সবুজ আলী জানান, তাদের বাড়ি পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পাইনি। পাঠাবুকা গ্রামের রুজনা বেগম, নতুনপাড়ার মজু মিয়া জানান, ঘরের ভিতরে পানি। খুবই কষ্টের মাঝে আছি। কিন্তু কই কেউ ত আমার খবর লইল না। আমরারে কেরে ত্রাণ দেয় না।

এ উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্দী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশুদ্ধ পানি, গোখাদ্য ও খাবার সঙ্কট দেখা দিয়েছে পানিবন্দী পরিবারগুলোতে। বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে অবস্থানকারী মানুষ ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় আছে। ত্রাণ না পাওয়ায় সেখানে হাহাকার বিরাজ করছে। তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন জানান, তার ইউনিয়নে যে পরিমাণ ত্রাণের চাহিদা রয়েছে সরকারিভাবে তার মাত্র দুই শতাংশ সহযোগিতা করা হয়েছে।

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বকশীগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফলে দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসি মানুষ। জানা গেছে, পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ এবং দশানী নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার ৭ ইউনিয়নের ১৬০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রাম ও পৌরসভার প্রায় এক লাখ লোক পানিবন্দী হয়ে পড়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চুলা পানির নিচে চলে যাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে বানভাসি মানুষের। বিশেষ করে এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু বলেন, তার ইউনিয়নের পুরোটাই পানির নিচে। অথচ যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তিনি পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন।

দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, দেওয়ানগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র মতে, শত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পানি এখন ব্রহ্মপুত্র-যমুনায়। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত যমুনার বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমা ১৬৬ সেমি উপরে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। দেওয়ানগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ গামারিয়া গ্রামে বুধবার ১টি বেড়িবাঁধ ভেঙে ৮ গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষেতের ফসল, বাড়িঘর ও পুকুরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার দেওয়ানগঞ্জ ইউনিয়নের গামারিয়া-তিলকপুর বেড়িবাঁধটি গত বুধবার দুপুরে বন্যার পানির তীব্র স্রোতে ধসে যায়। দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভাসহ ৮ ইউনিয়ন পানির নিচে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। পানিবাহিত আমাশয়, জ্বর, চোখের সমস্যাসহ নানা রোগব্যাধিও দেখা দিচ্ছে। এ দিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দেওয়ানগঞ্জে দুই ব্যক্তি মারা গেলে দাফনের জন্য শুকনা জায়গা না পাওয়ায় অন্যত্র নিয়ে দাফন করা হয়েছে।

নবাবগঞ্জ (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে পানি। এর ফলে তলিয়ে যাচ্ছে মিনি কক্সবাজার খ্যাত মৈনটঘাট। এ ছাড়া ধীরে ধীরে প্লাবিত হচ্ছে দোহার ও নবাবগঞ্জের চরসহ নিম্নাঞ্চল। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পদ্মার ভাগ্যকুল পয়েন্টের দোহার সীমানায় বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন মিনি কক্সবাজার খ্যাত মৈনটঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ীকে তাদের টং দোকানগুলো ঘোড়ার গাড়িতে করে সরিয়ে নিতে দেখা যায়।

নারিশা ইউপি চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন দরানী জানান, দীর্ঘ দিন ধরে দোহার উপজেলার বেশির ভাগ অংশ পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। নতুন করে পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙনের মুখে পড়ে মৈনটঘাট বিলীনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/426346