১৮ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:৩১

ভুট্টা রফতানিতে পোলট্রি শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা

বাংলাদেশের ভুট্টা নেপালের বাজারে রফতানি হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পে ভুট্টার চাহিদার তুলনায় দেশে অর্ধেক উৎপাদন হওয়ায় ওই রফতানি কার্যক্রম দেশীয় এই শিল্প অস্থিরতার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমনিতে নিজেদের প্রয়োজনে ব্রাজিলসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশ থেকে ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। এরপরেও যদি দেশের ভুট্টা বিদেশে রফতানি করা হয় তাহলে আমদানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। ফলে ভুট্টা থেকে উৎপাদিত প্রধান পণ্য পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে যাবে। এতে দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে পোলট্রি মুরগি ও ডিম।

জানতে চাইলে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ইহতেশাম বি শাহজাহান নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে পোলট্রি ও মাছের খাবার তৈরির প্রধান উপকরণ ভুট্টা। আর প্রাণিজ ওইসব খাদ্যের বাজার দ্রুত সম্প্রসারণের কারণে সেটার প্রভাব পড়েছে ভুট্টার চাহিদা ও দামে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফসলের ভালো দাম পাওয়ায় এখন কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভুট্টাচাষ। কিন্তু বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে তা আমাদের চাহিদার তুলনায় অর্ধেকেরও কম। এগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর পর যদি এটি রফতানি করা হয় তাহলে পোলট্রি মুরগি, ডিম, গরু, ছাগলে দাম বেড়ে যাবে। ফলে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে এই সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে এটি রফতানি বন্ধ করা উচিত।

জানতে চাইলে নারিশ পোলট্রি অ্যান্ড হেচারির পরিচালক রফিকুল ইসলাম বাবু নয়া দিগন্তকে বলেন, কোনো পণ্য দেশের চাহিদা পূরণের পর সেটি রফতানি করা যেতে পারে। ভুট্টা উৎপাদন যতটুকু হচ্ছে তাতে আমাদের দেশের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। আমাদের নিজেদেরই আমদানি করতে হচ্ছে। এর পর যদি এটি রফতানি করা হয় তাহলে সেটা দেশের জন্য সাঙ্ঘাতিক হবে। এখন ১২০ টাকা মুরগি পাওয়া যায়। যেখানে অন্যান্য গোশতের দাম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। এ ছাড়া দেশের পুষ্টির চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হচ্ছে আমাদের পোলট্রি শিল্পের মাধ্যমে। এ জন্য দেশের স্বার্থে ভুট্টা রফতানি বন্ধ হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো: এছরাইল হোসেন বলেন, ভুট্টা অধিক লাভজনক ফসল হওয়ায় চাষিরা অলাভজনক অন্য আবাদ ছেড়ে দিন দিন ভুট্টার দিকে ঝুঁকছেন। দেশে সরাসরি ভুট্টা খাওয়ার খুব একটা প্রচলন না থাকলেও প্রাণিজ খাদ্য উপকরণ হিসেবে ভুট্টার চাহিদা ব্যাপক। এ কারণে এর দামও ভালো পাচ্ছেন কৃষক। যা ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধির প্রথম কারণ। সরকারের নীতি সহায়তার পাশাপাশি বেশ কিছু উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার জাতের কারণে ভুট্টার ফলন আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এতে অন্য ফসলের তুলনায় একই জমিতে ভুট্টা চাষে বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষক।

রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ভুট্টা মানুষের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য তালিকায় এখনো জায়গা করে নিতে পারেনি। দেশে উৎপাদিত বেশির ভাগ ভুট্টা পোলট্রি ও গোখাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভুট্টা পুড়িয়ে খই ছাড়া এর ব্যবহার তেমন নেই। ভুট্টা থেকে তৈরি হতে পারে রুটি, খিচুড়ি, ফিরনিসহ নানা পুষ্টিকর খাবার।

এটি উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষক ভুট্টা চাষে আগ্রহী। তবে এটি ভাঙানোর আধুনিক ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল। সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে ভুট্টার উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক সময় দেশের হাতে গোনা কয়েকটি জেলায় ভুট্টার চাষ করা হতো। কিন্তু এখন প্রায় সব অঞ্চলেই কম-বেশি ভুট্টার চাষ করা হয়। গত ১০ বছর আগে যেখানে ভুট্টা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ লাখ ৫২ হাজার টন, বর্তমানে সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৩৮ লাখ ৯৩ হাজার টন। অর্থ্যাৎ, উৎপাদন বেড়েছে ২৩ লাখ ৪১ হাজার টন। পাশাপাশি অটুট রয়েছে ভুট্টার গুণগত মানও।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে দেশে মোট ভুট্টা উৎপাদন হয়েছিল ৭ লাখ ৩০ হাজার টন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০১০-২০১১ অর্থবছরে এর উৎপাদন দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৫২ হাজার টনে। এরপর ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৫৪ হাজার টন, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ২১ লাখ ৭৮ হাজার টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৫ লাখ ১৬ হাজার টন, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৬১ হাজার টন, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ২৭ লাখ ৫৯ হাজার টন। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ভুট্টার উৎপাদন ৩০ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। আর ২০১৮ সালে এ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ লাখ ৯৩ হাজার টনে। অর্থাৎ গত ১০ বছরের ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৬৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

নাটোরের ভুট্টাচাষি শরিফুল ইসলাম বলেন, ধানের আবাদের চেয়ে ভুট্টার আবাদ অনেক লাভজনক হওয়ায় তার দেখাদেখি অনেকেই এ ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হলেও ৩৫ থেকে ৪০ মন পর্যন্ত ভুট্টা উৎপাদন সম্ভব। ভুট্টার শুকনো গাছ ও ভুট্টা মাড়াইয়ের পর তা জ্বালানি হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/426171