১৭ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ১:৩১

খাল দখলেই ডুবছে ঢাকা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : খাল দখলের কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে রাজধানী ঢাকা। গত শুক্রবার মাত্র ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিতে যেভাবে রাজধানীতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে তাতে খাল দখলকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, খালগুলো দখল, ভরাট ও ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকায় পানি সরতে পারছে না। ফলে প্রতিবারই যখন বৃষ্টি হয় তখন অলিগলি ছাপিয়ে প্রধান সড়কেও জমে হাঁটু পরিমাণ পানি। দীর্ঘসময় ধরে সড়কে পানি জমে থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। বর্ষা মওসুমে খাল উদ্ধার নিয়ে নানা তৎপরতা থাকলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শেষ পর্যন্ত সেগুলো থাকে ফাইলবন্দী। রাজনৈতিক নেতাসহ দখলকারীদের কাছে যেন অসহায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

খালের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, আমাদের ডিএসসিসি এলাকায় ছয়টি খাল রয়েছে। এগুলো পরিষ্কার ও দখলমুক্ত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। খাল দখলকারী কিছু কিছু অবৈধ স্থাপনায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেখানে আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাব। পানিবদ্ধতা নিরসন করতে হলে অবশ্যই পুরনো খালগুলো দূষণ-দখলমুক্ত করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি জানান।

বৃষ্টি হলেই পথঘাট তলিয়ে বিতিকিচ্ছি হয়ে যায় রাজধানী, কাদাপানি-ময়লা-আবর্জনায় নাকানি-চুবানি খায় নগরবাসী, এসব কথা কতবার যে বলা হয়েছে গণমাধ্যমে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। সেসব কথা যেন কানে পৌঁছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। কানে তুলা দিয়ে, হাত গুটিয়ে বসে থাকে তারা। বিশেষজ্ঞরা যতই বলেন, ঢাকা শহরের বুকে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খালগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত করে আর বেদখল হওয়া খালগুলোতে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না। বিশেষজ্ঞদের এই একটি ফর্মুলাই আমলে নেয় না ওই সংস্থাগুলো। ঢাকার প্রাণ-প্রবাহ এই খালগুলো হয়ে আছে মালিকবিহীন মূল্যবান সম্পত্তির মতো। তাই যার যেভাবে খুশি, এগুলোর ওপর চালিয়ে যাচ্ছে দখল-উৎসব। এভাবে দিন দিন ২০০ ফুট প্রস্থের খালগুলোও এখন পরিণত হয়েছে সরু ড্রেনে। বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনাও দেদারছে ফেলা হচ্ছে খালে। সরকারি কোষাগার থেকে খনন আর পরিষ্কারের নামে কোটি কোটি টাকা ওয়াসার মাধ্যমে খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে এর সুফল মিলছে না।

রাজধানী ঢাকাকে নিয়ে একসময় প্রবাদ ছিল ‘বায়ান্ন গলি তেপ্পান্ন বাজারের শহর’। তেমনী এটাও সত্য ছিল, প্রতিটা বাজার ও গলির সাথে ছিল খালের সখ্যতা। আজ বাজার বা গলিগুলোর সন্ধান পাওয়া গেলেও হারিয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার অহংকার অর্ধ শতাধিক খাল। হারিয়ে যাওয়া খালগুলোর বর্তমান অবস্থা এমন যে, দেখে বুঝার উপায় নেই যে এখানে নিকট অতীতে খাল নামক কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল। কাগজে-কলমে এখনো যেগুলো আছে সেগুলোর অবস্থাও মৃত প্রায়। প্রভাবশালীদের হাত থেকে রাজধানীর খালগুলো উদ্ধারের ঘোষণা একাধিকবার এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। সংশ্লিষ্ট দফতর গুলোও বলছে খাল উদ্ধার ও সংস্কারের কথা। সর্বশেষ গত মার্চ মাসের শুরুতে দেশের সর্Ÿোচ্চ আদালত রাজধানীর চারপাশের নদনদীসহ ঢাকার খালগুলো দখলমুক্ত করতে একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু অবস্থা এমন যে, কে শোনে কার কথা। সবাই যারযার অবস্থান থেকে খাল গুলোকে সংস্কার ও দখলমুক্ত করার কথা বললেও কার্যত সেগুলো বক্তৃতা আর কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। একদিকে খালগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করা হচ্ছে অন্যদিকে সেগুলো আবার দখল হচ্ছে। সবার চোখের সামনে ভরাট হয়ে যাচ্ছে রাজধানীর খালগুলো। কখনও ট্রাক স্ট্যান্ড, কখনও গরুর খামার, কখনও বা থানা ভবন নির্মাণের নামে ভরাট করে ফেলা হয়েছে খালের বিশাল অংশ। চলছে হাউজিং কোম্পানির দখলবাজি। এর সাথে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব স্থাপনা থেকে ভাড়াবাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীর অধিকাংশ খালই ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ। অনেক খাল রয়েছে যেগুলো পরিস্কারই করা হচ্ছেনা। খাল রক্ষায় তেমন কোনও ভূমিকাই রাখতে পারছে না ঢাকা জেলা প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্টরা।

খাল দখল এবং উদ্ধার প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, রাজধানীর খালগুলোর সংস্কার কাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগের থেকে অবৈধ স্থাপনা এখন অনেক কমে গেছে। তারপরও আমরা অভিযান অব্যাহত রাখবো। তিনি বলেন, রাজধানীর দৃশ্যমান খালগুলোর সংস্কার কাজ চলমান থাকবে। তিনি বলেন, আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন জনগণ যদি সচেতন না হয় তাহলে খালগুলোর অস্তিস্ত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা। একইসাথে তিনি খাল উদ্ধার ও সংস্কারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেও দায়ী করেন।

ঢাকা ওয়াসার হিসাবেই নগরীতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫৪টি খালের অস্তিত্ব ছিল। বেশিরভাগ খালের সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া চারটি নদীর সঙ্গে। ২০০০ সালের জুলাই মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় রাজধানীতে খাল ছিল ৪৪টি। বর্তমান হিসাব মতে রাজধানীতে ৩৫টি খাল শুকিয়ে গেছে বা দখল হয়ে গেছে। তবে একাধিক প্রতিবেদনে রাজধানীতে ৫৮টি খালের কথা বলা হয়েছে। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ঢাকা ওয়াসার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে দেখা যায় খালের সংখ্যা ৩২। বর্তমানে এর ১৯টি আছে শুধু নকশায়, বাস্তবে নেই। বাকি ১৩টি খালের প্রস্থ ২০/১০ ফুটের বেশী নয়। প্রতি বছর মে-জুন মাস তথা বর্ষা মওসুম শুরুর আগে কোটি টাকা খরচ করে খাল পুনরুদ্ধার এবং অবৈধ দখলের কাজ করা হয়। কিন্তু সুষ্ঠু তদারকির অভাবে বছর না যেতেই সে গুলো আবার দখলে চলে যায়।

সূত্র মতে, রাজধানীর অন্যতম দুটি খাল হচ্ছে রামচন্দ্রপুর ও কাাঁসুর খাল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ৩০ বছর আগেও মোহাম্মদপুর ও রায়েরবাজারের পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ছিল রামচন্দ্রপুর ও কাাঁসুরের দুই খাল। বসিলা এলাকায় খাল দু’টি সংযুক্ত হয়ে পশ্চিম দিকে তুরাগ নদীতে গিয়ে মিশেছে। দেখা গেছে, বসিলা থেকে গাবতলীমুখী সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে একটি ট্রাক স্ট্যান্ড। দুই বছর আগেও এই ট্রাক স্ট্যান্ডের পাশে ছিল রামচন্দ্রপুর খাল। এখন আর নেই। রাবিশ মাটি দিয়ে খালের প্রায় এক হাজার ফুট অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। কয়েকজন ট্রাক চালক বলেন, আশেপাশে কোথাও ট্রাক রাখার জায়গা নাই। আগে মোহাম্মদপুর আল-করীম মসজিদের সামনে ট্রাক রাখা হতো। সেখান থেকে বসিলায় পাঠানো হয়। বসিলায় কবরস্থান হওয়ায় ট্রাক স্ট্যান্ড পাঠানো হয়েছে এই জায়গায়। এই স্ট্যান্ডে প্রায় দুই শতাধিক ট্রাক থাকে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ট্রাক স্ট্যান্ডের পশ্চিম দিকে খাল দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করেছে স্থানীয়রা। এখানে খালের জমিতে বস্তিও নির্মাণ হয়েছে বিনা বাধায়। ট্রাক স্ট্যান্ডের উত্তর পাশে রয়েছে ডেইরি ফার্ম। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই ফার্মের মাধ্যমেই রামচন্দ্রপুর খালের দখল শুরু হয়। সামান্য জমির মালিক হয়ে ডেইরি ফার্ম মালিক দখল করেছেন খালের বিশাল অংশ। এ বিষয়ে ফার্ম মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, খালের কিছু জমি আমার দখলে আছে। সরকার চাইলে দিয়ে দেব। এর পাশেই খাল ভরাট করে দোকানপাট নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালীরা। নবীনগর হাউজিং ও দয়াল হাউজিং কোম্পানির মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছে খাল দখলের।

খিলগাঁও জোড়পুকুর মাঠের কাছ থেকে খিলগাঁও-বাসাবো খালের শুরু। সেখানে একটি পিলারে ঢাকা ওয়াসার খিলগাঁও-বাসাবো খালের নাম উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার ওই পিলারের গা ঘেঁষেই বসানো হয়েছে ৩০ থেকে ৪০টি ফার্নিচারের দোকান। অবৈধ দখলদাররা এভাবে দোকানসহ নানা স্থাপনা গড়ায় বাস্তবে খালের চিহ্নও নেই। অথচ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় পুরো খিলগাঁও, তিলপাড়া, গোড়ান ও সিপাহীবাগ এলাকার লাখ লাখ মানুষের ভরসা ছিল এই খাল। ওয়াসার নথিপত্রে খালটির প্রশস্ততা স্থানভেদে ১৬ থেকে ৩২ ফুট। বাস্তবে সেটা কোথাও পাওয়া যায় না। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি খালই স্থানীয় বাসিন্দা ও সিটি করপোরেশনের আবর্জনা ফেলার স্থানে পরিণত হয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। খালগুলোতে যে যার মতো ময়লা-আবর্জনা ফেললেও তা দেখার কেউ নেই। এসব খাল রক্ষণাবেক্ষণের নামে ঢাকা ওয়াসা বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা খরচ করলেও বাস্তবে তেমন ফল আসছে না।

ঢাকার খালগুলো এভাবে দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, প্রাকৃতিক খালগুলো সংরক্ষণ করতে না পারলে ঢাকায় বিপর্যয় নেমে আসবে। এ কারণে আমরা বারবার বলছি খালগুলো রক্ষা করতে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীও আন্তরিক। কিন্তু কেন যেন দখলদারদের ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, রামচন্দ্রপুর খাল আমিও দেখেছি। খুব খারাপ অবস্থায় আছে খালটি। এখনই এটাকে সংরক্ষণ করা না হলে এই খাল আর পাওয়া যাবে না।

সূত্র মতে, রাজধানীর খালগুলো সংস্কারসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ঢাকা ওয়াসাকে একাধিকবার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মরহুম আনিসুল হক। তিনি রাজধানীর খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করার পাশাপাশি এগুলোর সংস্কার কাজ শেষ করা না হলে সিটি করপোরেশন এর দায়িত্ব নিবে বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু এই ঘোষণার কিছুদিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তখন খালের উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটি জানায়, প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে তারা অবৈধ স্থাপনা তুলে দিতে পারেননা। এছাড়া আদালতে মামলার বিষয়টিও তারা তুলে ধরেন। এছাড়া প্রয়োজনমত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও পাওয়া যায়না বলে তারা অভিযোগ করেন।

খাল দখল বা ভরাটের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশকে দায়ী করলেন ওয়াসার এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, তারা খাল সংরক্ষণ না করে খাল ভরাট করে তার উপর রাস্তা নির্মাণ করে ডিসিসি। মানিক নগরে ৩টি স্থানে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করে সেগুনবাগিচা খাল, খিলগাঁও-বাসাবো ডাউনে ক্রসরোড করে জিরানি খাল, মান্ডা, কদমতলা মাদারটেক ব্রিজের ওপর মোট ১০টি আড়াআড়ি ও লম্বা রাস্তা খালের ওপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সেগুনবাগিচা থেকে মানিকনগর পর্যন্ত ৩ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেগুনবাগিচা খালের অস্তিত্ব এখন দৃশ্যায়ন হয়না। ধানমন্ডি খালের অস্তিত্ব এখন বিলীন প্রায়। এক দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পরিবাগ খালের অবস্থাও একই রকম। গোপীবাগ খালের উপর নির্মিত হয়েছে রাস্তা। বরাট হয়ে গেছে রূপনগর খাল, পলাশনগর বাউনিয়া খাল, কালশী খাল, বাইশটেকি খাল, দুয়ারী পাড়া খাল। এসব খালের ওপর নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানীর বিল্ডিং। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কমলাপুর স্টেডিয়ামের দক্ষিণের সীমানা তৈরি করেছে সেগুনবাগিচা খালের ওপর। মাদারটেক ব্রীজ থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত অপর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা রেখেই নন্দীপাড়া খালের ওপর এপ্রোচ রোড নির্মাণ করা হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বনানী ও গুলশান রেকের
ওপর দিয়ে ক্রসরোড তৈরি করেছে। মান্ডা ব্রীজ থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ জায়গায় নতুন করে দখল হয়ে গেছে। এসব জায়গায় গজিয়ে উঠছে টংঘর, দোকানপাট, টিনের চালা ও বস্তি। বেগুনবাড়ি খালের ভেতরে গড়ে উঠেছে বিজিএমইএ ভবন।

জানা গেছে, পুরনো বিমানবন্দর রানওয়ের উত্তর পাশ থেকে কচুক্ষেত সড়ক পর্যন্ত ইব্রাহিমপুর খাল উদ্ধার করা হয়েছিল। উদ্ধার করা হয়েছিল প্রগতি স্বরণী থেকে মুর্তিটোলা পর্যন্ত শাহজাহানপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, কাাঁসুর খাল। এসব খাল গুলো পুনঃখননের কথা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তদারকির অভাবে এসব খাল আবারো দখল হয়ে গেছে। কল্যাণপুরের ইব্রাহিমপুর খালের বড় অংশ দখলদারদের কবলে। চিড়িয়াখানা ঢাল থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পূর্ব পাশ দিয়ে যে খালটি নদুয়ারীপাড়া স্লুইস গেটে পৌঁছেছে সেটিও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পশ্চিম পল্লবীর ওয়াসার কোয়ার্টার সংলগ্ন খালের অবস্থাও মৃত প্রায়। জিরানী খালের প্রশস্ততা ১২ মিটার থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৫ মিটার। মগিদা থেকে কদমতলা পর্যন্ত জায়গায় নির্মিত হয়েছে রাস্তা। নন্দন কানন হাউজিং এলাকায় খাল ভরাট করে বসানো হয়েছে পাইপ। জানা যায়, কাঁটাসুর খালে রয়েছে ৩০টি কাঁচাঘর, ২২টি আধাপাকা ঘর, তিনটি দ্বিতলা দালান। আবদুল্লাহপুর খালের ভেতরে ৫টি মাছের ঘের, মহাখালী খালে রয়েছে ২৩ অবৈধ স্থাপনা, ইব্রাহিমপুর খালে ৩৬টি স্থাপনা।

বাইশটেকী খালের অবস্থা একেবারেই নাজুক। দখল আর দূষণের ফলে পানিবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে পুরো এলাকায়। আবর্জনা পড়ে অনেক স্থানেই প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো অংশে খাল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ খালটি কালশী রোডের পাশ দিয়ে সাংবাদিক আবাসিক এলাকা হয়ে ভাসানটেক-ইব্রাহিমপুর খালের সঙ্গে মিশেছে। ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লক এলাকায় ১ নম্বর এভিনিউর পাশে বক্স কালভার্টসংলগ্ন স্থানে খালের বেশ কিছু অংশ বেদখল হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও রূপনগর খালটি ছিল বেশ বড় আকৃতির। এখন একটি ড্রেনের মতো রেখে বাকিটা দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী মহল। দোলাইরপাড়ের দেবধোলাই খালটি একসময় ছিল ৬০ ফুট প্রশস্ত। এটি ছোট হয়ে এখন বিলীন হওয়ার অপেক্ষায়। আবর্জনার স্তূপ ও দখলের কবলে হারিয়ে যেতে বসেছে এ খালটি। দীর্ঘদিন জমে থাকা আবর্জনার ওপর দিয়ে হেঁটে চলাচল করা যায়। হাজারীবাগ খালে দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে বলে জানা যায়। উত্তরার দক্ষিণ আজমপুর থেকে শুরু হয়ে কসাইবাড়ী হয়ে মোল্লারটেক গিয়ে শেষ হওয়া কসাইবাড়ী খাল এখন আর চেনার উপায় নেই। ছোট একটি ড্রেনে পরিণত হয়েছে খালটি।

রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী খালের অবস্থা আরো নাজুক। এ খালে অবৈধ দখল তুলনামূলক কম থাকলেও দূষণের ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খালটির মেরাদিয়া বাজার অংশে বিশাল ময়লার ভাগাড় রয়েছে। পুরো বনশ্রীর বাসাবাড়ির ময়লা ফেলা হচ্ছে খালের মধ্যে। নন্দীপাড়া খালে গিয়েও দেখা যায় করুণ অবস্থা। বিশাল আকৃতির খালটি ময়লা আর দখলের কবলে মৃতপ্রায়। খালের মধ্যে খুঁটি পুঁতে বিপুলসংখ্যক দোকান বসানো হয়েছে। পরিষ্কার না করায় খালটিতে পানির প্রবাহ নেই। খিলগাঁও-বাসাবো খালের অস্তিত্ব বাসাবো অংশে চোখে পড়লেও খিলগাঁও অংশে হারিয়ে গেছে।

জানা গেছে, রাজধানীতে যেসব খালের অস্তিত্ব এখনো পাওয়া যায় সেগুলোও ভরাট ও দখল হওয়ার পথে রয়েছে। বাসাবো খালে ৬০ ফুট প্রশস্ততার পরিবর্তে আছে ২৫ ফুট, বেগুনবাড়ি খালে শতাধিক ফুটের জায়গায় আছে ৬০ ফুট, মহাখালী খালের ৬০ ফুটের পরিবর্তে রয়েছে ৩০ ফুট, রামচন্দ্রপুর খালে ১১০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬০ ফুট, দ্বিগুণ খালে ২০০ ফুটের পরিবর্তে আছে ১৫০ ফুট, আবদুল্লাপুর খালে ১০০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬৫ ফুট, কল্যাণপুর খালে ১২০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬০ ফুট। এছাড়া গুলশান বনানী, কাঁটাসুযর, ইব্রাহিমপুর, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ি, কল্যাণপুরখাল-ক, খ, ঘ, ঙ ও চ, শাহজাদপুর খালের অবস্থা নাজুক। এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও খালগুলো এখন ভূমিদস্যু ও দখলদারদের কারণে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া খাল সম্পর্কে ওয়াসা সূত্র জানায়, কল্যাণপুর শাখা খাল-গ, বাইশটেকি, হাউজিং, পরিবাগ, রাজারবাগ, হাজারীবাগ, চরকামরাঙ্গীচর, সেগুনবাগিচা, আরামবাগ, গোপীবাগ, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও-বাসাবো, মান্ডা, দক্ষিণগাও-নজীপাড়া, রাজারবাগ-কান্দিপাড়া,মুতিতোলা, বাউশার, গোবিন্দপুর ও ডুমরি খালের অস্তিত্ব এখন বিলীন।

সামান্য বৃষ্টি হলেই এখন পানিবদ্ধতা দেখা দেয় রাজধানীতে। রাজপথ থেকে অলিগলি তলিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে রাজধানীর চারপাশে যেসব খাল দিয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতো সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ভবন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। যে যেভাবে পেরেছে দখল করেছে। এ তালিকায় রাজনীতিক, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, পাড়া-মহল্লার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তারাও রয়েছেন। অনেক জায়গায় খাল দখলের পর তার ওপর স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। উদ্ধারের প্রসঙ্গ তুললেই কর্তৃপক্ষ বারবার খাল দখলমুক্ত করার আশ্বাস দেয়। আর বছরের পর বছর ধরে এ কাজের জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপায়, কিন্তু খাল উদ্ধার হয় না।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, যে দেশ যত বেশি সভ্য সে দেশে আইন তত কঠোর। আমাদের খাল দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত রাখতে কঠোর আইনের প্রয়োগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। খালগুলো পরিষ্কার করে পুরো শহরের চেহারা পরিবর্তন করা সম্ভব। হাতিরঝিলের দিকে তাকালেই আমরা তা দেখতে পারি। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, খালগুলো দেখিয়ে ওয়াসা শুধু বিদেশ থেকে অর্থ আনে। আর কী কাজে খরচ করে তারাই জানে। বৃষ্টি হলে নগরবাসী পানিবদ্ধতায় হাবুডুবু খায়। সার্বিকভাবে খাল ঠিক রাখতে হলে তা সিটি করপোরেশনকে দিয়ে তাদের সব ধরনের সাপোর্ট দিতে হবে।

জানা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড, এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান মূলত খালের দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু খাল রক্ষণাবেক্ষণ, পুনরুদ্ধারসহ প্রয়োজনীয় সব কাজে সমন্বয়ের অভাবে ঢাকার খালগুলো একের পর এক দখল হয়ে যাচ্ছে। খাল দেখভালের জন্য ওয়াসার ড্রেনেজ (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) নামে একটি সার্কেল রয়েছে। তারা গত কয়েক বছরের মধ্যে কোটি কোটি টাকা খালের নামে বরাদ্দ নিয়ে খরচ দেখালেও বাস্তবে কোনো সুফল মেলেনি।

https://www.dailysangram.com/post/383061