১৭ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ১:০৬

হাসপাতালে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের ভিড়

ডেঙ্গু জ্বরে কাঁপছে রাজধানীবাসী। আতঙ্কে ভুগছেন মানুষ। ঢাকা শহরের প্রায় ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করছে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২১৪ জন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছেন প্রায় ৯ জন। এ হিসাবে প্রতি ৭ মিনিটে কমপক্ষে একজন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

১৫ই জুলাই ঢামেকে একজন মারা গেছেন। এবছর চিকিৎসকসহ এই পর্যন্ত চারজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে বিভিন্ন সূত্র বলছে।

রাজধানীর বাইর থেকেও ডেঙ্গু রোগীর খবর আসছে। তবে ডেঙ্গু রোগী নিয়ে সরকার যে হিসাব দিচ্ছে, বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। মারা যাওয়ার সংখ্যাও বেশি। চলতি জুলাই মাসে গড়ে প্রতিদিন ১৭৩ জনের উপরে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন। সরকারি হিসাবে এই মাসে ১৬ই জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৭৬৭ জন। বেসরকারি হিসাবে এটা কয়েকগুণ বেশি। জুন মাসে ১৭৬১ জন ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত এই বছর ৪ হাজার ৮৫২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ২২ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩ হাজার ৮২৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতদিন শুধুমাত্র রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলেও এখন ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলা, খুলনা ও চট্টগ্রাম জেলাতেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মাসে ডেঙ্গ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে যথাক্রমে ৯৮, ১২৪, ১২৮, ১২৪, ১৪৮, ১১৩, ১৮৬, ১৫০, ১৭৫, ১৭৪, ২২৭, ১৯১, ১৬৫, ১৮৮, ১৫৯ ও ২১৪ জন। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চোখ রাখলেই ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেটের জন্য রক্ত চেয়ে সহযোগিতার স্ট্যাটাসের সংখ্যা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চলতি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজন নারী চিকিৎসক ও ১৫ই জুলাই ঢামেকে আরেকজন মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ফলে আক্রান্ত রোগী নিয়ে স্বজনরা আতঙ্কে ভুগছেন। এ বিষয়ে দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে গেছে। আগে যেমন তীব্র জ্বরের সঙ্গে গায়ে রেশ ওঠা, ঠোট ফেটে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেত, এবার সে সব লক্ষণ ছাড়াও অনেক রোগীই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে জ্বর হলে ঘরে বসে চিকিৎসা না নিয়ে যত দ্রত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।

এদিকে, গত ১৫ই জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী। গতকাল ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, ১৫ই জুলাই হাসপাতালে ৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৬৯ জনে। এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, শুরুতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক ডেঙ্গু রোগী মারা যান। ১৫ই জুলাই মারা গেছেন আরও একজন। এ নিয়ে ডেঙ্গুতে মোট দুই জন মারা গেছেন। তিনি বলেন, নতুন ভবনের মেডিসিন ওয়ার্ডে বিভিন্ন তলায় ও ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীরা ভর্তি আছেন। সেখানে তাদের পাশাপাশি অন্য রোগীরাও আছেন। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগীরা আসছেন। এ নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা হচ্ছে, তারা রোগীদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার খোঁজ নিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন হাসপাতালে এসেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ডেঙ্গুর এই মৌসুমে জ্বর হলে অবহেলা না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, রোগীদের জন্য বলব, আমরা জ্বর হলে অনেক সময় সাধারণ জ্বর মনে করি। ডেঙ্গু জ্বরও রোগীর কাছে সাধারণ জ্বর বলেই মনে হয়। যে কোন জ্বরকে তারা যেন সাধারণ জ্বর মনে না করেন, অবহেলা না করেন। চিকিৎসকের পরামর্শ নেন, ডেঙ্গু পরীক্ষা করেন। যদি পরীক্ষা করে দেখা যায় ডেঙ্গু নেগেটিভ তবেই সাধারণ বা অন্য কোনো জ্বর হতে পারে। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে ডেঙ্গুর বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার আগেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আসছেন হাসপাতালে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চলতি বছর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গু বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর মশার উপদ্রব বাড়ে। কিন্তু এবার যেহেতু আগেই বৃষ্টি হয়েছে তাই মশা উপদ্রব আগ থেকেই দেখা গেছে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। জমে থাকা বৃষ্টির পানি থাকলে মশার প্রজনন বাড়ে। তাই বাড়ি বা বাড়ির আঙিনার কোথাও যেন পরিষ্কার পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। এ ছাড়া যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে অ্যাসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ৪ থেকে ৫ দিন জ্বর থাকলে ঘরে বসে না থেকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

https://www.mzamin.com/article.php?mzamin=181611