১৬ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ৮:৪৭

পানিবন্দি লাখো মানুষ ১০ শিশুর মৃত্যু

বন্যায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট * কয়েক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত, বন্ধ পাঠদান

দেশের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত ১৭ জেলায় বন্যা ছড়িয়ে পড়ে। এসব জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েন লাখ লাখ মানুষ। তারা থাকা-খাওয়া, প্রাকৃতিক কাজ ও গবাদিপশু নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে গরু-ছাগল নিয়ে উঁচু সড়ক ও বাঁধে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। শুকনো খাবারের জন্য বন্যার্তদের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। ফলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগবালাই ছাড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও শেরপুরে পানিতে ডুবে ১০ শিশু মারা গেছে। এ নিয়ে গত ৭ দিনে বিভিন্ন রোগবালাই ও পানিতে ডুবে ২২ জনের মৃত্যু হল। এদিকে বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে কয়েকশ’ বসতঘর ও বহু ফসলি জমি। বন্যায় ডুবে গেছে গ্রামীণ সড়ক, ক্ষেতের ফসল। ভেসে গেছে মাছের খামার। বিভিন্ন স্কুলে পাঠদান বন্ধ হয়ে পড়েছে। সোমবারও ১৪ নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে ছিল। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল, বানের পানি ও দেশের ভেতরকার রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির কোনো আশা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা মধ্যমেয়াদি এই বন্যা ২১ জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।

বন্যায় সৃষ্ট নানা রোগবালাইয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭২ জন। সবমিলে ৬ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ১২২৫ জন। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার। অপরদিকে সোমবার পৃথক এক আদেশে বন্যার্তদের জন্য বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র খুলতে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওইসব আশ্রয় কেন্দ্রে একটি করে সেল স্থাপন করে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে সার্বক্ষণিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকতেও বলা হয়েছে।

সোমবার পর্যন্ত বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে আছে- লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, জামালপুর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও টাঙ্গাইল। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে স্থিতিশীল থাকবে। লালমনিরহাট, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। তবে উজান থেকে বানের পানি নামতে থাকায় আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে বন্যা বিস্তৃত হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, বন্যার মূল কারণ উজানের বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে আগামী ২০-২২ জুলাই থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করবে। তবে এটি ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের বন্যার মতো হওয়ার আশঙ্কা এখন পর্যন্ত নেই।

সোমবার এফএফডব্লিউসি’র দেয়া বুলেটিনে বলা হয়, সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পুরনো সুরমা দিরাই পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে আছে। এছাড়া দেশের প্রধান নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ১৪টি নদী ২৬ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, পুরাতন সুরমা, সোমেশ্বরী, কংস, ধরলা, তিস্তা, ঘাগট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও সাঙ্গু। বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন ও পাকিস্তানেও এই সময় বন্যা চলছে। এর মধ্যে পাকিস্তান বাদে অন্য দেশগুলোর কোনো কোনো অংশের বন্যা বাংলাদেশকেও আক্রান্ত করে।

তিনি বলেন, বর্তমান এই বন্যার নানা কারণের একটি জলবায়ু পরিবর্তন। কেননা, আবহাওয়া চরম বৈরী আচরণ করছে। যখন গরম আসে, তখন তা রেকর্ড ভেঙে ফেলে। আবার বন্যা বা খরা এলে সেটাও তেমন পর্যায়ে পৌঁছায়।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা এখন ঘন ঘন হচ্ছে। ১৯৮৮ সালের পর ১৯৯৮ সালে বন্যা হয়। কিন্তু এরপর বড় বন্যা মাত্র ৬ বছরের মাথায় ২০০৬ সালে। আবার ২০১৬, ২০১৭ এবং এবার বন্যা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ দিক এটি।

ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুড়িগ্রাম, ভুরুঙ্গামারী, উলিপুর, ফুলবাড়ী, রৌমারী ও চিলমারী : জেলার ৫৫টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্লাবিত হয়েছে ৩৯০টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ। সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যার পানিতে ডুবে ৫ শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের হাবিবুল্লাহ (৬), ফুলবাড়ীতে ১ ও চিলমারী উপজেলায় ৩ শিশু। অপর চারজনের নাম জানা যায়নি। সোমবার সকালে কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী মহাসড়কের ৪-৫ জায়গায় হাঁটুপানি প্রবাহিত হওয়ায় ভারি যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নাগেশ্বরীতে নদীতীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, ৩৯০টি গ্রামের ৭৩ হাজার ৫১১টি পরিবারের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ বন্যা আক্রান্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফুলবাড়ীতে ধনীরাম ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন ১২শ’ পরিবার। বন্যায় ২২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার রাস্তা ও ১৬টি ব্রিজ বা কালভার্টের ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে ৯শ’ হেক্টর জমির ফসল। অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নাগেশ্বরীর বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মুড়িয়া এলাকায় দুধকুমর নদ তীররক্ষা বাঁধের একাংশ ছিঁড়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকার মানুষ। এছাড়া হুমকিতে রয়েছে সদর উপজেলার বাংটুর ঘাট ও সারডোব তীররক্ষা বাঁধ। রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ, খাদ্যগুদাম, হাসপাতাল চত্বর ও বাজারে পানি প্রবেশ করেছে।

দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও ইসলামপুর (জামালপুর) : সোমবার বানের পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানগঞ্জে তিনজন ও মাদারগঞ্জে একজন। তারা হল- দেওয়ানগঞ্জ পৌর এলাকার চর কালিকাপুর গ্রামের মনিরুর হোসেনের ২ বছরের ছেলে রিয়ামুল হক ও জহুরুল ইসলামের ৭ বছরের ছেলে নাঈম এবং সীমান্তবর্তী এলাকা ডাংধরা পাথরের চরের রাকিবুল ইসলামের ৭ বছরের ছেলে সাইমুন ইসলাম। এছাড়া মাদারগঞ্জের ঝাড়কাটা গ্রামে সাদিয়া নামে ৭ বছরের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সাদিয়া ওই গ্রামের হারেছ আলীর মেয়ে। এদিকে জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্ধ হয়ে পড়ে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শত শত পরিবার বিভিন্ন সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। সোমবার দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন, রেল ইয়ার্ড, বেলতলী বাজার উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ পৌর শহরের প্রধান প্রধান সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে।

গাইবান্ধা : ভোরে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারিতে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ধসে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ঘাঘট নদীর পানির তোড়ে সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের ফকিরপাড়া এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধের প্রায় ১৫০ ফুট এবং গোদারহাট এলাকায় সোনাইল বাঁধের প্রায় ২শ’ ফুট এলাকা ধসে গেছে। ফলে ওইসব বাঁধের পার্শ্ববর্তী ১৫টি গ্রামে আকস্মিকভাবে বন্যা দেখা দিয়েছে।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ২১৩ গ্রামের ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৮ হাজার ২৩০টি। কাঁচা রাস্তা ৯২ কি.মি., ৬টি কালভার্ট ও ৪ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১ হাজার ২৪৬ হেক্টর। এছাড়া ৩১৪টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

শেরপুর : ঝিনাইগাতীতে বন্যায় ৪০টি গ্রামের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে মালিঝিকান্দা ইউনিয়নের ঘাঘরা সরকারপাড়া গ্রামের নুর ইসলামের এক বছরের শিশু মাহিন বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার বেশিরভাগ রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গবাদিপশু নিয়ে কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। পানিবন্দি এলাকাগুলোতে কোথাও নৌকা, কোথাও কলার ভেলা দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এদিকে দুর্গত এসব এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধরা। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোফাখখারুল ইসলাম জানান, প্রায় ২০টি বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসার হুমায়ুন কবির জানান, ১৫০ হেক্টর জমির বীজতলা এবং ৪০ হেক্টর জমির সবজি বাগান পানিতে নিমজ্জিত।

নেত্রকোনা ও মদন : বন্যায় সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা উপজেলায়। কলমাকান্দার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পানিবন্দি মানুষ গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত পশু নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। বন্যাকবলিত ওইসব এলাকায় কয়েক হাজার পুকুর ও মাছের খামার ডুবে মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বেশকিছু গ্রামীণ বাজার পানির নিচে। কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় অন্তত ৩৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া আরও প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। জেলা মৎস্য অফিসার দিলীপ কুমার সাহা জানান, দুই হাজার ৯৬৩টি পুকুরের প্রায় ১ হাজার ৩৪২ টন মাছ পানিতে ভেসে গেছে। নেত্রকোনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম জানান, বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ কাজ চলছে।

চট্টগ্রাম ও মীরসরাই : সাতকানিয়ার ১৫ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি। টানা বর্ষণে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। হাজার হাজার মানুষ সাইক্লোন শেল্টারসহ পাড়া-প্রতিবেশীর বহুতল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। শিশুদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়া পটিয়া, চন্দনাইশ, মীরসরাই ও লোহাগাড়া উপজেলা বন্যাকবলিত। পটিয়ায় রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় নৌকা করেই এলাকা পরিদর্শন করেন সরকারি দলের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি। রোববার তিনি পরিদর্শনে গিয়ে দিক হারিয়ে বিপদের মুখোমুখি হন। তবে শেষ পর্যন্ত রাতে কূলে উঠতে সক্ষম হন। এদিকে বন্যার্ত লোকজন অভিযোগ করেছেন, থাকা-খাওয়া নিয়ে চরম দুঃখে-কষ্টে দিন কাটলেও প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। সাতকানিয়ায় পানিবন্দি অনেকে এক সপ্তাহ ধরে একবেলা খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। কোথাও কোথাও ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল।

বগুড়া : সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় বন্যার আরও অবনতি হয়েছে। সোমবার বিকালে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক রায়হানা ইসলাম জানান, তিন উপজেলার ৯৮টি গ্রাম জলমগ্ন হয়ে ১৬ হাজার ৪৪০ পরিবারের ৬৬ হাজার ৮০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নদী ভাঙনে ১৪৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ২৪০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধে দুই হাজার ও অন্যান্য স্থানে ৪৯ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ৫৯টি প্রাথমিক ও দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যার পানিতে মোট আট হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এদিকে বন্যায় তিন উপজেলায় এক হাজার ৯০০টি ল্যাট্রিন, দুই হাজার ৪৫৭টি নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৪টি নলকূপ মেরামত ও এক হাজার পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ৩৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৮২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যা দুর্গতদের বাঁধে আশ্রয় নিতে না দেয়ায় তারা অন্য নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছেন।

বান্দরবান : বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে জেলার সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ চালু হয়নি ৭ দিনেও। বৃষ্টি বন্ধ হলেও সাঙ্গু নদীর পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবার প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ছেড়ে ঘরে ফিরছেন দুর্গতরা।

বরিশাল : কীর্তনখোলাসহ জেলার প্রায় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নগরীর নিম্নাঞ্চল পলাশপুরসহ জেলার নিম্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। যদিও বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাইদ বলছেন, এই অঞ্চল সাগরের খুব কাছাকাছি। জোয়ার-ভাটা থাকে। এখানে এখনও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।

রাঙ্গামাটি : ভারি বর্ষণে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন সড়কে পাহাড় ধসে ও দেবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ভারি যান চলাচল করতে পারছে না। এছাড়া রাঙ্গামাটি-বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে যোগাযোগ এক সপ্তাহ ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সড়কে জরুরি মেরামত ও সংস্কার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

খাগড়াছড়ি : দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে বহু ফসলি জমি। দীঘিনালা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের কর্মকর্তা ওঙ্কার বিশ্বাস জানান, উপজেলায় ৮০ হেক্টর ধানের জমি নষ্ট হয়েছে। বন্যা দুর্গতদের সাড়ে ৫ টন খাদ্যশস্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।

হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট : কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নবীগঞ্জ উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। চুনারুঘাট উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে এসব এলাকার ক্ষেতের ফসল।

সুনামগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার : সরকারি হিসাবে ৯ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১ লাখ ২০ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির হিসেবে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। বন্যায় এ পর্যন্ত ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি প্লাবিত হয়েছে। ৪ কোটি ৬০ লাখ ৬১ হাজার ২শ’ টাকার মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় ২২টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পানিবন্দি নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষরা বেশ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। কৃষকরা নিজের পরিবারের পাশাপাশি গবাদিপশুর নিরাপত্তা ও খাদ্য নিয়েও বিপাকে আছেন।

সিলেট : জেলার গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও সিলেট সদরের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ও ধলাই এবং গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি ও জাফলং পাথর কোয়ারির সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে এসব পাথর কোয়ারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় দুই লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, পানিবন্দি মানুষের সহায়তায় এরই মধ্যে ৬৪ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আরও ১৬৪ মেট্রিক টন।

মৌলভীবাজার ও কমলগঞ্জ : কুশিয়ারা নদীর ৩টি স্থানে গ্রামীণ রাস্তা ও ধলাই নদীর ৩টি স্থানে বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া, রাজনগর ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৪৬ হাজার ৯০ জন লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে ৭০টিরও বেশি গ্রাম। পানি ডুকেছে ২৫টি প্রাইমারি ও ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রামের মানুষ ইতিমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের সবজিক্ষেত, ফসলি জমি, পুকুরসহ এলাকার রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/199662/