গতকাল শনিবার চট্টগ্রামে প্রবল বর্ষণে নগরীর বেশিরভাগ এলাকা পানিতে ডুবে যায়। ছবিতে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, ষোলশহর, নাসিরাবাদ এলাকার দৃশ্য -সংগ্রাম
১৪ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ২:০৬

চট্টগ্রামে ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে নগরীর বেশীরভাগ এলাকা ॥ মানুষের দুর্ভোগ চরমে

চট্টগ্রাম ব্যুরো : গতকাল শনিবার সকালে চট্টগ্রাম মহানগরী সহ আশেপাশের এলাকায় ঝড়ো হাওয়া সহ ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে এক ঘন্টায় চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশীরভাগ এলাকা পানিতে ডুবে যায়। এতে নগরবাসীর দুর্ভোগ চরমে উঠে।

ভোররাত থেকে থেমে থেমে ঝড়ো হাওয়ার সাথে বজ্র বৃষ্টি হয়। সকাল থেকে এই ভারী বৃষ্টিপাতে নগরীর সকল নিম্নাঞ্চল সহ বেশীরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। নগরীর নালা নর্দমা ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের পানি নামতে সময় লেগেছে। সকাল ৭.৩০টার দিকে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে তা সকাল ১১টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরে সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে পড়েন চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেক জায়গায় পানিতে গণপরিবহন বিকল হয়ে যাওয়ায় জনসাধারণ পড়েন ভোগান্তিতে। প্রবল বৃষ্টিপাতে নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজার,তামাকুমন্ডি লেন,খাতুনগন্জ,চাক্তাই,বহাদ্দারহাট এলাকার বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান,গুদাম পানিতে ডুবে গেলে মালামাল পন্য সামগ্রী ভিজে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারী বর্ষণে গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম মহানগরীর চকবাজার, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, শুলকবহর, কাপাশগোলা, কে.বি.আমান আলী রোড, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ সিডিএ, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড,মুহুরী পাড়া, বেপারি পাড়া,মোল্লা পাড়া,পোর্ট কনেকটিং রোড,মুহুরী পাড়া,হাজী পাড়া, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, হালিশহর বড়পুল, ছোটপুল, হালিশহর, চান্দগাঁও, জিইসি মোড়, কাতালগঞ্জ, ষোলশহর ২ নম্বর গেইট,চাক্তাই,মিঞাখান নগর,রাজাখালী,পাথরঘাটা মুরাদপুর,বায়েজীদ,মোহাম্মদপুর, চান্দগাও খাজারোড, হামজারবাগ, মোহাম্মদপুর, নয়াবাজার বিশ্বরোড, রেয়াজউদ্দিন বাজার, তিন পোলের মাথা,আসকারদিঘী, হেমসেন লেন, জামালখান বাই লেন,ফিরিংগীবাজার,এয়াকুবনগর,মেহেদীবাগ,ওয়াসার মোড়, কাট্রলি,পাহাড়তলী,খুলশী সহ প্রায় এলাকায় কোথাও হাটু সমান ও কোথাও কোমর সমান ও কোথাও বুক সমান পানি হয়েছে। শনিবার সকালে টানা বর্ষণের মধ্যে নগরের বায়েজিদ থানার আরেফিন নগর এবং কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সূএের খবর, শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আরেফিন নগরের অদূরে অবস্থিত জানু বাপের ঘোনা সংলগ্ন পাহাড়ে ধসের সৃষ্টি হয়। ধসের পরপরেই স্থানীয়দের সহায়তায় সেনাবাহিনীর একটি টিম এবং ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় শাহানুর আক্তার (৪০) এবং মর্জিনা বেগম (১৮) নামে দুই নারীকে উদ্ধার করা হয়। সম্পর্কে মা-মেয়ে দুজনই পাহাড় ধসের কারণে ঘরে আটকে ছিলেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের উদ্ধারের পর পুরো পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন। ১৫টি পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এদিকে ৯টার দিকে গরিবুলাহ শাহ মাজার সংলগ্ন কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ স্টেশনের একটি দল ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান চালায়। এসময় নুসরাত শারমিন নামে এক শিশুকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদিকে টানা বৃষ্টিতে শনিবার ভোরে সার্সন রোডে দেয়াল ধসের ঘটনা ঘটে। তবে এসময় সড়কে যানবাহন চলাচল সীমিত থাকায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে জানা গেছে। এছাড়া সীতাকু- উপজেলার কুমিরায় পিইচপি স্টিল মিলের পেছনে পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলের ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে ষোলশহর এলাকায় রাস্তায় পানি ওঠার কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের তেমন ক্ষতি হয়নি।ষোলশহর স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো.জাকির হোসেন বলেন, ভারি বর্ষণের কারণে ষোলশহরের বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে পানি জমেছে। তাই সকাল থেকে কোনো শাটল ট্রেন চলাচল করতে পারেনি।

এদিকে গতকাল শনিবারের বৃস্টিতে সৃষ্ট চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানিবদ্ধতা নিরসনে সেনাবাহিনীর ৪০ জন সদস্য ৪টি টিমে ভাগ হয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে প্রবর্তক মোড়-কাপাসগোলাতে ১টি, জিইসি-দু’নম্বর গেট এলাকায় ১টি এবং মুরাদপুর ও বহদ্দারহাটে ১টি করে টিম কাজ করছে। বৃষ্টি শুরুর পর থেকে এসব টিম মাঠে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ৪০ জন সদস্য চারটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ করছে। তারা দ্রুত পানি সরানোর পাশাপাশি পরবর্তীতে কীভাবে কাজ করতে হবে এসব বিষয় দেখছে। ইতোমধ্যে এসব পয়েন্টে পানি জমার কারণ চিহ্নিত হয়েছে। পানি নেমে গেলে সে অনুযায়ী কাজ শুরু হবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ও মেগাপ্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাঈনুদ্দীন বলেন, পানিবদ্ধতার মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। তারা কারণগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি দ্রুত পানি সরানোর ব্যবস্থা করছেন।

এদিকে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ২ নম্বর রাইখালী ইউনিয়নে পাহাড় ধসে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকাল ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে । এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিকাল থেকে বৃষ্টি হলেও শনিবার ভোর রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, এতে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী বাঙ্গালহালিয়া (রাজস্থলী), বান্দরবান প্রধান সড়কে একটি চলন্ত সিএনজি অটোরিকশার উপর পাহাড় ধসে পড়ে এতে ঘটনাস্থলে ২ জন নিহত হয়। নিহতরা হলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার নোয়াপাড়ার অজয় বড়ুয়া (৫০) ও কারিগর পাড়ার সুজয় মং মারমা (৪০)। কাপ্তাই উপজেলার নির্বাহী অফিসার আশরাফ আহমেদ রাসেল জানান, রাইখালি সড়কে সিএনজির উপর মাটি পড়েছে শুনেছি। আমি ঘটনাস্থলে যাচ্ছি। দুইজন মাটি চাপা পড়েছেও জানতে পেরেছি। 

এদিকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে ,বৃহওর চট্টগ্রামে টানা বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে সাতকানিয়ার বাজালিয়া, বড় দুয়ারা, ঘিলাতলী, মাহালিয়া এলাকা, লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া, আমিরাবাদ ও লোহাগাড়া, পটিয়ার জুলধা, ডাঙ্গারচর, বড় উঠান, দৌলতপুর, শাহমীরপুর, বাঁশখালীর শেখেরখীল, বাহারছড়া, চাম্বল, গন্ডামারা ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম। আনোয়ারার হাইলধর, জুইদন্ডী, বরুমচড়া, চন্দনাইশের দোহাজারী ইউনিয়নের চাগাচর দিয়াকুল, নয়াপাড়া, রায়জোয়ারা, খিল্লাপাড়া, বৈলতলী, ইউনিয়ন এবং হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ, ধলই, নাঙ্গলমোড়া, গুমানমর্দন, ফতেপুর, মেখল, শিকারপুর ও আলমপুর এলাকা বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ফটিকছড়ির নারায়ণহাট, হারুয়ালছড়ি, ভুজপুর, লেলাং, ধুরুং, গজারিয়া ও বারোমাসিয়া, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালির নিম্নাঞ্চল ও সন্দ্বীপ উপজেলায় ডুবে গেছে কয়েকটি গ্রাম। ভেসে গেছে একাধিক মাছের ঘের। উপকূলবর্তী এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে ঢুকছে বন্যার পানি। রাউজান উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিয়াজ মোরশেদ জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সর্তা খাল ও ডাবুয়া খালের কয়েকটি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। সাতকানিয়ায় প্লাবিত নিম্নাঞ্চল। ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সায়েদুল আরেফিন বলেন, বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হালদার বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে অর্ধশত গ্রাম এখন পানির নিচে। বন্যাকবলিতদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, বন্যায় পানিবন্দি রয়েছে ৫০ হাজার পরিবার। বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন সরেজমিন পরিদর্শন করেছি এবং ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছি। এখানে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

https://www.dailysangram.com/post/382677