১১ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১:২৬

দেশপ্রেমের চশমা

অসুস্থ রাজনীতিই একশ্রেণীর মানুষকে বিকারগ্রস্ত করছে

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নৈতিক অবক্ষয়। সামাজিক অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। খুন, গুম, চুরি, অপহরণ বাড়লেও অতি সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ধর্ষণ।

একটি সমাজে কতটা নৈতিক অবক্ষয় ঘটলে প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা খুললেই ৫-৭টি ধর্ষণের খবর চোখে পড়ে তা অনুমান করা যায়। সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা মহামারীর মতো বিস্তারিত হয়েছে। ছোট শিশুরাও আজ ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

নৈতিক অধঃপতন কত নিচে নামলে মানুষ ছোট ছোট শিশুকে ধর্ষণ করতে পারে তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমি যখন এ লেখাটি লিখতে বসি তখন আমার টেবিলে ছিল যুগান্তরের ৮ জুলাই তারিখের (সোমবার) সংখ্যাটি।

এর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে মাত্র তিন দিন আগে রাজধানীর বনগ্রামে ৭ বছরের শিশু ওয়ারী সিলভার ডেল স্কুলের নার্সারি ক্লাসের ছাত্রী সামিয়া আফরিন সায়মাকে ধর্ষণ করে হত্যা করার বিচারের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের ছবি।

পত্রিকাটির শেষের পাতার অষ্টম কলামে ছাপা হয়েছে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় প্রতিষ্ঠিত মা হাওয়া (আ.) কওমি মহিলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবুল খায়ের বেলালীর এক বছরে ৬ শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণ করার স্বীকারোক্তির খবর।

এ অধ্যক্ষ মাদ্রাসার ছাত্রীদের শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে শরীর টেপান এবং তাদের ধর্ষণ করার পর ছাত্রীদের কোরআন শরিফে হাত রেখে ঘটনা প্রকাশ না করতে শপথ করান।

একই পৃষ্ঠার পঞ্চম কলামে ছাপা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বায়তুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল আমিনের গত এক-দেড় বছরে ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের খবর। তিনি পানি পান করা বা বইপত্র গোছানোর কথা বলে ছাত্রীদের ঘরে ডেকে ধর্ষণ করেন।

১৮ পৃষ্ঠার প্রথম কলামে ছাপা হয়েছে হাটহাজারী পৌর সদরের গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী তাসনীম সুলতানা তুহিনকে ধর্ষণ, খুন ও লাশ গুম করার মামলার চার্জশিট দেয়ার খবর।

১৭ পৃষ্ঠার ৬ষ্ঠ কলামে ছাপা হয়েছে কুড়িগ্রমের ভুরুঙ্গামারী সদর ইউনিয়নের নলেয়া মাঝিপড়া ব্র্যাক স্কুলের ছাত্রীকে গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে পাটক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করার খবর। একই কলামে জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভ্যানচালকের কলেজপড়–য়া মেয়েকে ধর্ষণচেষ্টার খবর প্রকাশিত হয়।

৩ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে ছাপা হয়েছে এ মাসের ৩ তারিখে আনোয়ারায় গার্মেন্ট কর্মীকে গণধর্ষণের মূল আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের খবর। ২ পৃষ্ঠায় বগুড়ার শিবগঞ্জে স্বামী পরিত্যক্ত এক নারীকে গণধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

একটি পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত এত অধিকসংখ্যক ধর্ষণের খবর দেখে সারা দেশে যে ধর্ষণ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ধর্ষণের এ মাত্রারিক্ত বৃদ্ধিজনিত কারণে জাতীয় সংসদে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন ১৪ দলের শরিক জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। তিনি ৬ মাসে ৬৯৬টি শিশু ধর্ষণের ঘটনার উল্লেখ করে ৮ তারিখে সংসদে জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণের নোটিশে এ দাবি জানান।

যে সংসদের অধিকাংশ এমপিরাই নৈশভোটে নির্বাচিত, সে সংসদের সদস্যদের এমন দাবিতে আইন করা হলেও যে ধর্ষণ হ্রাসে সে আইন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না তা অনুধাবন করা যায়।

এ সংসদের সাংসদদের উচিত, কীভাবে কার্যকর সংসদ গড়ে তুলতে সঠিক নির্বাচনী ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা যায় সে সম্পর্কে সাহস সঞ্চয় করে আইন তৈরি করার বিষয়ে কথা বলা। সে বিষয়ে আইন তৈরি করা।

সংসদের সম্মানিত এমপিরা নিজেরা অবিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত না হয়ে যদি ধর্ষণ কমানোর জন্য আইন তৈরির পরামর্শ দেন তাহলে সে উপদেশ হবে নিজেরা সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধূমপানবিরোধী সমাবেশে বক্তৃতা করার মতো।

আইন করেই যদি ধর্ষণ কমানো যেত তাহলে এ দেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইন থাকার পরও আর সন্ত্রাস হতো না। যৌতুকবিরোধী আইন থাকায় যৌতুকের প্রচলন উঠে যেত। খোলা স্থানে ধূমপান না করার জন্য আইন থাকায় কেউ আর রাস্তাঘাটে ধূমপান করতেন না। দেশে আইন থাকলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে সে বিষয়টি এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কতটা বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সে বিষয়টির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সততা ও সদিচ্ছাও এ প্রসঙ্গে বিবেচ্য।

তাছাড়া সংসদ সদস্যরা যদি আইনিভাবে নির্বাচিত হয়ে সংসদে না আসেন তাহলে তারা কীভাবে ধর্ষণবিরোধী আইন তৈরি করবেন? ভোটের বাক্সের সতীত্ব রক্ষায় যারা ব্যর্থ, তাদের পক্ষে কীভাবে নারী ও শিশুর সতীত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে?

কাজেই এমন সংসদে এমনভাবে নির্বাচিত এমপিদের প্রস্তাবিত ধর্ষণবিরোধী নতুন আইন করা হলে তা কেবল আইনের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাবে; কিন্তু ধর্ষণ কমাতে পারবে বলে মনে হয় না।

ধর্ষণ বৃদ্ধির সাম্প্রতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে মাদ্রাসায় ছাত্রীদের ধর্ম শেখানোর কথা, নৈতিকতা শেখানোর কথা, সে প্রতিষ্ঠানে আজ শিক্ষক নামধারী একশ্রেণির চরিত্রভ্রষ্ট আলেম ছাত্রীদের ধর্ষণ করছে। ছাত্রীদের ধর্ষণ করতে না পেরে আগুনে পুড়িয়ে মারছে।

ধর্ষণ কেবল মাদ্রাসা শিক্ষকরাই করছেন এমন নয়। স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও ‘শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী লাঞ্ছিত’ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এজন্য দোষী প্রমাণিত হয়ে অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন।

শিক্ষক যদি রক্ষক না হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তবে তার চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! অভিভাবকরা কাকে বিশ্বাস করবেন? নিজের মেয়েকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় পাঠিয়ে কীভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবেন? তবে কেবল স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নয়, নারী ও শিশুরা আজ কোথাও নিরাপদ মনে হচ্ছে না।

রাস্তায়, দোকানে, বাসে, কর্মস্থলে, গ্রামে, শহরে, এমনকি নিজ সংসারে ঘরের মধ্যেও তাদের আক্রমণ করা হচ্ছে। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, বাবা-মার সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনের সম্ভ্রমহানির খবর পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।

তবে সব ধর্ষণের খবর পত্রিকায় আসে না। তারপরও যেটুকু আসছে সে পরিসংখ্যানও লোমহর্ষক। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদের গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে সংঘটিত ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৬৯৭, গণধর্ষণের শিকার ১৮২ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন। সংস্থাটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ১৪টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে ধর্ষণ আরও বেড়েছে।

সাম্প্রতিক ধর্ষণগুলোর ভঙ্গিমা বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করা যায়, ধর্ষকরা তাদের ধর্ষণ কাজ করার জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আসার পর এ ফোনের ক্যামেরা ধর্ষকদের ধর্ষণে সহায়তা করছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের কুলাঙ্গার শিক্ষক পরিমল জয়ধরের মতো অনেক শিক্ষক ছাত্রীদের ব্লাকমেইল করে তাদের সঙ্গে একবার ঘনিষ্ঠ হতে পারলে সে ছবি মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রাখছে এবং ছাত্রীকে ওই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে বারবার কাছে আসতে বাধ্য করছে।

তা ছাড়া অপরিণত বয়সে অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতে আসায় অনেক টিনএজ কিশোর-কিশোরী, তরুণী ও যুবক-যুবতী ইনটারনেটের অপব্যবহার করে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে এবং এভাবে ধীরে ধীরে যৌন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

যদিও এখন অধিকাংশ স্কুলে টিনএজ শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন আনা নিষেধ; কিন্তু স্কুলের পর তো আর তাদের পাহারা দিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে শিক্ষক ও অভিভাবকদের উচিত হবে শিক্ষার্থী এবং ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বারিত রাখার জন্য বকাঝকা না করে তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করে এর সুফল এবং কুফল সম্পর্কে তাদের পরিচ্ছন্ন ধারণা দেয়া।

তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে লাভবান হওয়া যায় সে শিক্ষা দেয়া। স্কুলের শিক্ষা কারিকুলামে এ সম্পর্কে বাংলা টেক্সট বইয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে লিখিয়ে একটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করার কথাও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভাবতে পারে।

সমাজে ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি, ইত্যাদিসহ যে কোনো রকমের অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, অপহরণ তখনই কমবে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সততার সঙ্গে এসব অপরাধপ্রবণতা কমাতে চেষ্টা করবেন। তারা যখন সৎ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসীন হয়ে নাগরিক কল্যাণে নিবেদিত হবেন, তখন তাদের উপদেশ তরুণ ও যুব সমাজকে প্রভাবিত করবে।

কিন্তু নৈশভোটে নির্বাচিত নেতৃত্বের কোনো সদুপদেশ তরুণ ও যুব সমাজের ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখবে না। কারণ, আজকের তরুণ ও যুবকরা বোকা নন। তাদের চোখ-কান খোলা। তারা জানেন কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় একেকজন ব্যক্তি রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন। এমপি হয়েছেন।

কাজেই কেন তারা তাদের সম্মান করে তাদের উপদেশ শুনবেন? সে কারণে সাম্প্রতিক ধর্ষণ বৃদ্ধির সঙ্গে আমি গণতান্ত্রিক অসুস্থতার সম্পর্ক খুঁজে পাই। রাজনীতির অসুস্থতার সম্পর্ক খুঁজে পাই। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে সমুন্নত রাখতে এ গণতান্ত্রিক অসুস্থতার চিকিৎসা প্রয়োজন সবার আগে।

রাজনীতি যেহেতু সমাজের ও দেশের চালিকাশক্তি, সেজন্য রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ সবচেয়ে জরুরি।

গণতন্ত্র ও রাজনীতিকে অসুস্থ রেখে আইন করে, শাস্তি দিয়ে বা শক্তি প্রয়োগ করে কখনই ধর্ষণ কমানো যাবে না। সেজন্য ধর্ষণ কমানোর যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করার আগে রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/197829