পাহাড়ধসের কারণে সোমবার বান্দরবানের রুমা-থানচি সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়- ফোকাস বাংলা
৯ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:৪৮

চট্টগ্রামে মৃত্যুফাঁদ ৩০ পাহাড়

কাপ্তাইয়ে পাহাড় ধসে নারী-শিশু নিহত

টানা ভারি বর্ষণে চট্টগ্রামের ৩০ পাহাড়ে তৈরি হয়েছে মৃত্যুফাঁদ। রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে এরই মধ্যে গতকাল সোমবার পাহাড়ধসে মারা গেছে শিশুসহ দু'জন। চট্টগ্রামে প্রাণহানি এড়াতে মাইকিং করছে প্রশাসন। গত দু'দিনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে সরানো হয়েছে চার শতাধিক পরিবারকে। কিন্তু দিনের বেলায় যাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তারা আবার রাতের আঁধারে ফিরে যাচ্ছে পাহাড়ে। এখনও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবারের অর্ধলাখ মানুষ। টানা বৃষ্টি হলে রাঙামাটির মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে এখানেও। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এরই মধ্যে ১৭টি পাহাড়ে ছয় শতাধিক পরিবারের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি করার তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রশাসন। তবে তালিকার বাইরেও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে আরও ১৩ পাহাড়ে। গতকাল কাপ্তাইয়ের কলাবাগানের মালি কলোনি এলাকায় পাহাড়ধসে নিহতরা হলো ওই এলাকার সুনীল মল্লিকের তিন বছরের শিশুপুত্র সূর্য মল্লিক এবং তাহমিনা বেগম (২০) নামে এক নারী। মাটিচাপা পড়ে আহত হয়েছেন আব্দুল গফুর (৫০) ও সুনীল মল্লিক (৫৬) নামে দু'জন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা স্থানীয়দের সহায়তায় হতাহতদের উদ্ধার করেন।

স্থানীয়রা জানান, রোববার রাত শুরু হওয়া প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কলাবাগানের মালি কলোনির পাহাড়ের পাদদেশে থাকা দুটি ঘর পাহাড়ধসে ভেঙে যায়। এ সময় ওই দুই ঘরের সবাই বের হতে পারলেও সূর্য ও তাহমিনা আটকা পড়ে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে এলাকাবাসী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সূর্য মল্লিকের লাশ এবং তাহমিনাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। পরে তাহমিনাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহমেদ রাসেল দু'জন নিহতের সত্যতা স্বীকার করে জানান, আহত দু'জনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে, টানা বর্ষণের কারণে রাঙামাটি-বান্দরবান এবং লংগদু-দীঘিনালা সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ও দেয়ালধসে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১২৮ জন মারা যায়। এভাবে এক দশকে ২০৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। টানা বৃষ্টি হলে প্রশাসন সতর্ক করতে মাইকিং করে। চালায় উচ্ছেদ অভিযান। কিন্তু স্থায়ীভাবে কাউকে পুনর্বাসন না করায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে।

চলতি বছর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি চট্টগ্রাম নগরের ১৭ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। তালিকায় ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে ৫৩১ পরিবার এবং সরকারি মালিকানাধীন সাত পাহাড়ে ৩০৪টি পরিবার বসবাস করার তথ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু তালিকায় অবৈধভাবে পাহাড় দখল করে ঘর নির্মাণকারী শীর্ষ পাহাড়খেকোদের কারও নাম নেই। তিন বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে অবৈধভাবে পাহাড় দখলকারী পাহাড়খেকোদের একটি তালিকা তৈরি করে গোয়েন্দা সংস্থা। সেই তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি সমর্থিত শীর্ষ নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ পাহাড়ের অনেক গডফাদারের নাম উঠে এসেছিল। ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসন ১৬টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারী ৬৮৪টি পরিবারের নাম উল্লেখ করে তালিকা করেছিল একটি। চলতি বছর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩৫ পরিবারে। ২০১৭ সালের তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতির সংখ্যা ছিল ৬৬৬টি। তবে প্রতিবছর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা চিহ্নিত করা হলেও নেওয়া হচ্ছে না তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'রোববার পর্যন্ত সরকারি মালিকানাধীন পাহাড়গুলো থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী পাঁচ শতাধিক পরিবারকে জেলা প্রশাসনের নয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। ত্রাণ দেওয়ার পাশাপাশি রান্না করা খাবারও পরিবেশন করা হচ্ছে তাদের। তাছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাইকিংয়ের মাধ্যমে সতর্ক করে দিচ্ছেন সবাইকে। তারপরও ব্যক্তি মালিকানাধীন ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার পাহাড়গুলোতে যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে, কোনো দুর্ঘটনা হলে তার দায়দায়িত্ব নিতে হবে তাদেরই।'

ঝুঁকিতে আছে ৩০ পাহাড় : পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির লোলুপ দৃষ্টিতে পড়ে চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে ৩০টি পাহাড়। দিনে নয়তো রাতে এসব পাহাড় কেটে কেউ গড়ে তুলেছে জনবসতি, কেউ তুলছে দোকানপাট, কেউ তুলছে ইটভাটা, কেউবা গড়ছে শিল্প কারখানা, কেউ বানাচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প, কেউ বানাচ্ছে সড়ক, কেউ বানাচ্ছে আবাসন। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো হচ্ছে- সলিমপুর বাস্তুহারা পাহাড়, টাইগারপাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশ, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ, মোজাফফর নগর পাহাড়, কাট্টলি থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোলপাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, জয়পাহাড়, চট্টেশ্বরী হিল, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড়, ফয়'স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের পাশের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়ের দিকের ফুলের দোকানগুলোর অংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের পাহাড়, একে খান অ্যান্ড কোম্পানির পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধামে বিশ্ব কলোনির পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, লালখান বাজার চান্দমারি রোড সংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম ইসলামি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পাহাড়, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তর পাশের মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়-সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের হারুন খানের মালিকানাধীন পাহাড়ের পশ্চিমাংশ, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় ও সিডিএ এভিনিউ রোডের পাশে অবস্থিত বোসম গার্ডেন সংলগ্ন পাহাড়।

কোন পাহাড়ে কত অবৈধ বসতি : ১৭ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অবৈধভাবে বসবাস করা ৮৩৫ পরিবারের মধ্যে রেলওয়ের লেক সিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২২ পরিবার, পূর্ব ফিরোজ শাহ এক নাম্বার ঝিল-সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮ পরিবার, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিনাকানাধীন কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে ২৮ পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি করপোরেশন পাহাড়ে ১০ পরিবার, রেলওয়ে, সওজ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ১৬২ পরিবার, ব্যক্তি মালিকানাধীন একে খান পাহাড়ে ২৬ পরিবার, হারুন খানের পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ পরিবার, মধুশাহ্‌ পাহাড়ে ৩৪ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৩২ পরিবার, আকবরশাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮ পরিবার, আমিন কলোনি সংলগ্ন ট্যাঙ্কির পাহাড়ে ১৬ পরিবার, লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ১১ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১ পরিবার, ফয়'সলেক আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়ে ৯ পরিবার এবং এম আর সিদ্দিকী পাহাড়ে আটটি পরিবার বসবাস করছে।

রাঙামাটিতে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস :রাঙামাটিসহ দশ উপজেলায় পাহাড়ের পাদদেশে ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বসবাস করছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে জেলা প্রশাসন থেকে মাইকিং করা হলেও এখনও তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি। রাঙামাটি শহরে ২১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি।

জানা গেছে, রাঙামাটি পৌরসভাসহ ১০ উপজেলায় মোট তিন হাজার ৩৭৮টি পরিবারের প্রায় ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছে। রাঙামাটি পৌর সদরে ৯টি ওয়ার্ডের প্রায় ৩৮টি স্থানে সাত শতাধিক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে। এর মধ্যে পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের শিমুলতলী, রূপনগর, আউলিয়া নগর, মনোঘর, মুসলিমপাড়া, পোস্ট অফিস কলোনি, নতুনপাড়া, লোকনাথ ব্রহ্মচারী মন্দির এলাকা, সনাতনপাড়া, ৭নং ওয়ার্ডের কলেজ গেট, কাদেরিয়া মার্কেট এলাকা, রাজবাড়ী এলাকা, ১নং ওয়ার্ডের চেঙ্গীমুখ, চাম্পানিমার টিলা, ২নং ওয়ার্ডের এসপি অফিস সংলগ্ন, পুরাতন বাস স্টেশন, মাতৃমঙ্গল এলাকা রয়েছে।

এদিকে টানা বর্ষণের কারণে রাঙামাটি-বান্দরবান এবং লংগদু-দীঘিনালা সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বর্ষণের কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। ইতিমধ্যে পাহাড়ধস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লিফলেট বিতরণসহ মাইকিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া গতকাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে।

https://samakal.com/whole-country/article/1907658