৫ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ৬:১৫

টাকার সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণের জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত

মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা

ব্যবসার চলতি মূলধনের যোগান দিতে পারছে না ব্যাংক। এ দিকে বিদেশী ক্রেতাদের পণ্য সরবরাহের নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক টাকার সরবরাহ করতে না পারায় রফতানির জন্য কাঁচামাল উৎপাদনে সহায়ক পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। টাকার সঙ্কটে এখন ববসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ সঙ্কট আসতে পারে। সম্ভাব্য সঙ্কট মেটাতে বিকল্প সংস্থান না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখা সম্ভব হবে না।

গতকাল একজন ব্যবসায়ী এমনি অভিমত ব্যক্ত করেন নয়া দিগন্তের এ প্রতিনিধির কাছে। ওই ব্যবসায়ী জানান, গত ছয় মাস ধরে চাহিদা অনুযায়ী অর্থের সংস্থান করতে পারছে না ব্যাংক। আবার ঋণ না পাওয়ায় সময়মতো পণ্যও উৎপাদন করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এর বিপরীতে মাস শেষে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাসহ ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যের প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছেন তারা। এতে অনেক ক্ষেত্রে মুনাফার পরিবর্তে লোকসান হচ্ছে। আর এ লোকসানের ধকল গিয়ে পড়ছে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে। অনেকেই সময়মতো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে তাদের অনেকেরই ব্যাংকের খেলাপির খাতায় নাম উঠে যাচ্ছে। এতে বাড়ছে নানা জটিলতা।

জানা গেছে, বেশির ভাগ ব্যাংকে টাকার সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে বড় বেকায়দায় পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা ব্যাংক থেকে আমানত নিয়ে ব্যবসায়ীদের ঋণ বিতরণ করে। কিন্তু ব্যাংকগুলোই এখন বেকায়দায় পড়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহকরা বলা চলে কোনো ঋণই পাচ্ছেন না। অনেক গ্রাহক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে ব্যাংকের দিকে ছুটছেন। সবক্ষেত্রেই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর এ আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম দিক থেকেই রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার যোগান দিচ্ছে। কিন্তু এখন এতেও পরিস্থিতি তেমন উন্নতি হচ্ছে না। ফলে বর্তমান সময়ের চাহিদার বিপরীতে সরকারের ঋণের একটি বড় অংশ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছরই ব্যাংক থেকে একটি বড় অংকের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নের জন্য ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাত থেকে বড় অংকের এ ঋণ নেয়ার জন্য সরকারের অর্থমন্ত্রণালয় থেকে প্রতি সপ্তাহে কী পরিমাণ ঋণ নেয়া হবে তার আগাম কর্মসূচি নিধারণ করে থাকে। এ কর্মসূচি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি সপ্তাহেই নিলাম ডাকা হয়।

চুক্তি অনুযায়ী সরকারের ঋণের জোগান দিতে বাধ্য থাকে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ব্যাংকগুলো সরকারের বড় অঙ্কের ঋণের জোগান দিতে হয়; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই টাকার সঙ্কট রয়েছে। মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে প্রতি সপ্তাহে ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বড় একটি অংশ জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থবছরের শেষ মাসে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকাই জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের অর্থ হট মানি হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ ভল্ট থেকে এক টাকা ছাড়লে বাজারে সাড়ে সাত টাকার প্রভাব পড়ে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর পরেও বাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের বড় একটি অংশ জোগান দেয়া হচ্ছে। যতক্ষণ বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে না আসবে ততক্ষণ বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ঘুরে ফিরে আবার ব্যাংকিং চ্যানেলেই ফিরে এলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে চলমান টাকার সঙ্কট মিটছে না; কিন্তু ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকার জোগান দেয়া হলে বিদ্যমান মুদ্রাপ্রবাহের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়। এতে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে। এর প্রভাব বাজারে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে পড়ে যাবে। কারণ, এক দিকে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো আর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনছে না। এতে ডলারের বিপরীতে নগদ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে আসছে না। যদিও ইতোমধ্যে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করায় এর বিপরীতে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে আটকে গেছে। এখন এ সঙ্কট না থাকায় ব্যাংকের টাকা আর ভল্টে আসছে না। পাশাপাশি রেপো ও সরকারের ঋণের জোগান দেয়া হলে বাজারের টাকার সঙ্কট অনেকাংশেই কেটে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/422886