৫ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ৬:১২

গ্যাসের অপচয় রোধ ও চুরি ঠেকাতে নেই নজরদারি

স্টাফ রিপোর্টার: বিল কম আসে, খরচও কম হয়। তারপরও গ্যাসের অপচয় রোধ ও চুরি ঠেকাতে নেই নজরদারি। কর্তৃৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুবই উদাসীন। ঢিলেঢালাভাবে চলছে এর কাজ। তাইতো প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন প্রকল্পে নেই অগ্রগতি। প্রকল্পের পুরো সময় শেষ হলেও অগ্রগতি হয়েছে মাত্র প্রায় ৪৩ শতাংশ। সরকারের কোটি কোটি টাকা হাত ছাড়া হচ্ছে অগ্রিম রাজস্ব আদায়ের সুযোগ।

তবে প্রশিক্ষণের নামে দেশ-বিদেশে লাম-সাম খাত দেখিয়ে ঠিকই শতভাগ ব্যয় করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে সব গাড়িও কেনা হয়েছে।

প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও কাজের ধীরগতির কারণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডি সম্প্রতি নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা করে তার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সার্বিক ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ফয়জার রহমান বলেন, গ্যাসের বিল সাশ্রয় করার এ প্রকল্পে ঋণদাতা সংস্থা জাইকার বিভিন্ন শর্ত মেনে চলতে অনেক দেরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের লোকজন এলাকায় গ্যাস মিটার সংযোগ দিতে গেলে ফিরিয়ে দেয়।

এর ফলে অনেক ম্যান পাওয়ার লস হয়েছে। তাদের বোঝাতে অনেক কষ্ট হয়েছে। একপর্যায়ে ভোক্তারা যখন বুঝতে পারে যে, মিটার সংযোগ করা হলে গ্যাসের অপচয় কমবে এবং বিলও কম লাগবে তখনই ভোক্তাদের সাড়া পাওয়া যায়।

বর্তমানে এর ব্যাপক চাহিদা। চুরি বন্ধ হয়ে যাবে তাই কাজে ঢিলেমি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অবাস্তব কথা। এক শ্রেণির লোক আছে তারা নেগেটিভ কথা বলবে, তাই বলে থাকে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের প্রথমে দায়িত্ব নিয়েই আমি প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করেছি। গত জানুয়ারি থেকে ব্যাপকভাবে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে প্রি-পেইড সংযোগ দেয়ার জন্য। এ পর্যন্ত এক লাখ ৪৩ হাজার গ্রাহক সংযোগ দেয়া হয়েছে। অগ্রগতি ৬৪ শতাংশ।

বিভিন্ন কারণে দেরি হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধন করে সময় দুই বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ওই সময়ে সব কাজ শেষ হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়ায় ৪ হাজার প্রি-পেইড মিটার চালুর সফলতা বিবেচনায় নিয়েই সব জায়গায় গ্যাসের উত্তম ব্যবহার এবং দক্ষ ও নিরাপদ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয় সরকার।

যাতে গ্যাসের অপচয় রোধ ও চুরি ঠেকানো যায়। একই সঙ্গে যাতে ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, পরিচালনা ব্যয় হ্রাস এবং জ্বালানি সাশ্রয় তথ্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

একই সঙ্গে গ্রাহক সেবার মান উন্নয়নও হয়। এসব দিক বিবেচনা করে সরকার রাজধানী ঢাকার ১২টি এলাকায় গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার চালু করার জন্য ২০১৫ সালের ১৩ মে ‘ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএল’ নামে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়।

২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়। ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ধরা হয় ২৩৭ কোটি টাকা। প্রকল্পে জাইকার সাহায্য ৪৫৩ কোটি টাকা। বাকি ২২ কোটি টাকা সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এলাকাগুলো হলোÍ বাড্ডা, গুলশান, তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট, মিরপুর, কাফরুল, খিলক্ষেত, উত্তরখান, দক্ষিণখান, উত্তরা, পূর্বাচল ও ঝিলমিল। প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজ ধরা হয় স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য লাস-সাম খাতে ব্যয় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

পরামর্শক সেবা খাতে প্রায় ৩১ কোটি টাকা। ১৫টি যানবহন কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা। আর প্রকল্পের মূল কাজ অর্থাৎ প্রি-পেইড মিটার কেনা হবে ২ লাখ। এছাড়া ওয়েব-সিস্টেম-সফটওয়্যার ও কম্পিউটার এবং ফার্নিচারও রয়েছে।

প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাসের অপচয় রোধে সরকার ঢাকার ১২টি এলাকায় ২ লাখ প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এতে অপচয় রোধের মাধ্যমে সিস্টেম লস কমে আসবে। রাজধানীতে পুরোপুরিভাবে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার করা গেলে যে পরিমাণ গ্যাস বেঁচে যাবে, তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগালে তা থেকে দৈনিক ৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

এরপরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও বলেছিলেন, আবাসিক খাতে গ্যাসের অপচয় রোধ করে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে গ্রাহক পর্যায়ে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে পাইলট প্রকল্পের আওতায় তিতাস গ্যাস টিএন্ডটি কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) থেকে মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া এলাকায় ৪ হাজার ৫শটি আবাসিক প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে।

এ পাইলট প্রকল্পের জরিপের ফলাফল সন্তোষজনক এবং গ্রাহকদের দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহারের কারণে প্রতিটি ডাবল বার্নার চুলায় গড়ে ৩৩ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। ঢাকা উত্তরের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৫ সালের ২ জুন সরকারি আদেশও জারি হয়।

এরপর কাজও শুরু হয়। জাপান সরকারের ৩৫তম ওডিএ লোন প্যাকেজের টিজিটিডিসিএলের মাধ্যমে ২ লাখ আবাসিক প্রি-পেইড মিটার আনা হয়। কিন্তু গতি বাড়েনি।

আইএমইডির ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা বা ৪২ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

এর মধ্যে প্রশিক্ষণের জন্য লাম-সাম খাতে পুরোটাই ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পরামর্শক খাতে ১ কোটি সাড়ে ৩২ লাখ বা ৮০ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। ১ লাখ ৫২ হাজার ২৮০টি মিটার কেনা হয়েছে। তবে মার্চে বেড়ে এর সংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজার হয়েছে।

আর গ্রাহকদের সংযোগ দেয়া হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৭৬২টি মিটার। তবে পিডি গতকাল বলেন, জুন পর্যন্ত গ্রাহকদের সংযোগ দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার। এরমধ্যে পাইলট প্রকল্পে আগেই ৬ হাজার সংযোগ দেয়া হয়েছে। বাকি সময়ে সব মিটার সংযোগ দেয়া সম্ভব হবে।

সূত্র জানায়, শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিতাস গ্যাস ১৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ১৩৪ জন গ্রাহককে গ্যাস সংযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে ২৭ লাখ ৬৪ হাজার গ্রাহকই আবাসিক শ্রেণির। বাকিগুলো বিদ্যুৎ, শিল্পসহ অন্যখাতের। প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ব্যবহারের সুবিধা কেমন? এমন প্রশ্নের ব্যাপারে প্রায় ৮২ শতাংশ গ্রাহক বলেছেন, নিজের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস ব্যবহার করা যাচ্ছে। ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ বলেছেন লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাংকে বিল পরিশোধের ঝামেলা নেই। ৬৫ শতাংশ বলেছেন, বিল কম আসে, খরচ কম হয়।

প্রায় ৬০ শতাংশ বলেছেন গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্নের চিন্তা নেই, ঝামেলাও নেই। গ্রাহকদের ৫২ শতাংশ বলেছেন তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে কার্ড হারিয়ে গেলে নতুন কার্ড কষ্টকর বলে প্রায় ৪২ শতাংশ গ্রাহক অভিযোগ করেন।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এক চুলায় ৭৫০ টাকা এবং ডাবল চুলায় ৮০০ টাকা নেয়া হলেও গ্যাস মিটার ব্যবহারের ফলে মাসিক ব্যয় হয় মাত্র ৫০০ টাকা বলে ৩৯ শতাংশ মনে করেন। প্রায় ২৪ শতাংশ বলেছেন সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা ব্যয় হয়। ১৩ শতাংশ বলেছেন, ৫০০ টাকার কম ব্যয় হয়।

আর মাত্র প্রায় ৩ শতাংশ বলেছেন, হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয়। তবে গড় মাসিক ব্যয় হয় ৭৯০ টাকা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সরকার গতকাল থেকে ভোক্তাপর্যায়ে এক চুলা ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলা ৯৭৫ টাকা নির্ধারণ করেছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী ৮৭ শতাংশ বলেছেন, হ্যাঁ, আর্থিকভাবে সাশ্রয় হয়। জরিপ এলাকার প্রায় ৮৫ শতাংশ জানান, গ্যাসের স্বল্পচাপ নেই। তবে ১৫ শতাংশ গ্রাহক জানান, গ্যাসের সমস্যা রয়েছে। জাপানের ভালো মানের মিটার হওয়ায় কখনো নষ্ট হয়নি বলে ৯৯ শতাংশ গ্রাহক জানান।

তবে ১ শতাংশ বলেছেন, প্রি-পেইড মিটার কোনো না কোনোভাবে নষ্ট হয়েছে। ৫১ শতাংশ গ্রাহকই হাজার টাকা করে রিচার্জ করেন।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম রাজস্ব আদায়ের সুযোগ হবে। বিল অনাদায়ী ও বকেয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো কোনো সুযোগ থাকবে না। এতে কোম্পানির যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ও কর্ম ঘণ্টাও সাশ্রয় হবে।

https://www.dailysangram.com/post/381585