৫ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ৬:০৯

কুরআন অধ্যয়নে কিছু পরামর্শ

শাহ্ আব্দুল হান্নান: যখন ১৯৫৭ সালে ডিগ্রি ক্লাসে পড়ছিলাম, তখন ইংরেজিতে প্রথম কুরআন শরিফের অর্থ পড়া শুরু করি। পরবর্তীকালে মুহাম্মদ আসাদের ‘দি মেসেজ অব দি কুরআন’ তাফসিরটি পড়েছি। মুহাম্মদ আসাদ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পাঁচজন ইসলামী চিন্তাবিদের একজন। এটি একটি অসাধারণ তাফসির, যেটি সবাই পড়তে পারেন। তারপর আমি ‘তাফহীমুল কুরআন’ (মাওলানা মওদূদীর) তাফসির পড়া শুরু করি। তখন এটি একটি একটি পারা করে প্রকাশ হচ্ছিল। যা হোক, ১৯৭৩-৭৪-এর মধ্যে তাফহীমুল কুরআন পুরো প্রকাশ হয়। তখন পুরো তাফসিরটি দু-তিনবার পড়ি। এরপর আমি সাইয়েদ কুতুবের ‘ফি জিলালীল কুরআন’ পড়লাম। এ ছাড়া, মুফতি মোহাম্মদ শফির ‘মারেফুল কুরআন’ এবং মওলানা মোহাম্মদ আলীর কুরআনের তাফসির পড়েছি। প্রথম দিকে বেশ কিছু জায়গায় অর্থ বুঝতে অসুবিধা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে তাফসিরগুলো পড়ার পরে আমার এ অসুবিধাগুলো দূর হয়ে যায়। আমার পরামর্শ হচ্ছেÑ প্রথমত, কুরআনের অর্থ পড়া এবং যেখানে বুঝতে অসুবিধা হয়, সেখানে ওই অংশের তাফসির দেখা। তবে পুরো তাফসির পড়ার কল্যাণ ভিন্ন। কারণ, তাফসিরগুলোতে পাওয়া যায় কুরআন নাজিলের প্রেক্ষাপট ও আয়াত নাজিলের পরিপ্রেক্ষিত। কুরআন বোঝার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে কুরআন শরিফ নাজিল হয়েছে। সুতরাং প্রেক্ষাপট না বুঝলে কুরআন বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যেমনÑ হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পর্কে না জানলে সূরা ফাতাহ বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। তেমনিভাবে, তাবুক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত জানা না থাকলে সূরা তাওবা বুঝতে অসুবিধা হতে পারে, বদর যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত জানা না থাকলে সূরা আনফাল বুঝতে অসুবিধা হতে পারে প্রভৃতি। এ কারণে মনে করি, তাফসির বোঝা জরুরি। যারা ইসলামের বড় দায়ী হতে চান তাদের অবশ্যই তাফসির পড়তে হবে।

কুরআনের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নীতি ভালোভাবে বুঝতে হলে ইসলামী অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের ওপর লেখা বইগুলো পড়া প্রয়োজন। কারণ, কুরআনে অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ের আয়াতগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সুতরাং এসব নীতি সম্পর্কিত বই ইসলামের যেসব শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত লিখেছেন, তা পড়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এসব লেখকের মধ্যে রয়েছেনÑ ড. মুহাম্মদ উমর চাপরা, ড. ইউসুফ আল কারযাভি, মুহাম্মদ আসাদ, তারিক রামাদান, আব্দুল হামিদ আবু সুলাইমান, তাহার জাবির আল আলুয়ানি প্রমুখ।

কুরআনের একটি বিষয় সবার বোঝা দরকার। সেটি হচ্ছেÑ কুরআনে কি কোনো মানসুখ আয়াত আছে? অর্থাৎ কুরআনে কি এমন কোনো আয়াত আছে, যার হুকুম পরবর্তী আয়াত নাজিলের কারণে রহিত হয়ে গেছে বা পরিবর্তিত হয়েছে? এক দলের মতে এ রকম কিছু আয়াত আছে, যেখানে পরবর্তী আয়াত নাজিল হওয়ার পর পূর্ববর্তী আয়াতের হুকুম আংশিক হলেও বদলে গেছে।

এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ আসাদ, সাইয়েদ কুতুব, মাওলানা আকরম খাঁ ও আব্দুল হামিদ আবু সুলাইমান মনে করেন, কুরআনের কোনো রহিত আয়াত নেই। সব আয়াতই তার প্রেক্ষাপটে কার্যকর রয়েছে। আব্দুল হামিদ আবু সুলাইমান তার বই ‘ইসলাম ও আন্তর্জাতিক আইন’-এ (বিআইটি প্রকাশিত) বলেছেন, কেউ কেউ মনে করেন যুদ্ধের আয়াত নাজিল হওয়ার পর শান্তির পক্ষের আয়াতগুলো মানসুখ বা বাতিল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এটা ভুল ধারণা। শান্তির আয়াতগুলো শান্তির পরিস্থিতিতে কার্যকর এবং এটাই সাধারণ অবস্থা। যুদ্ধের অবস্থায় যুদ্ধের আয়াতগুলো কার্যকর হয়। বিশ্বে জাতিসঙ্ঘ হয়ে যাওয়ার পর যুদ্ধ মূলত বেআইনি। তবুও কিছু যুদ্ধ হচ্ছে।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বলেছেন, কুরআনের কোনো হুকুমই রহিত হয়নি। সব হুকুমই কার্যকর রয়েছে সেই আয়াতের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে। কুরআনকে বুঝতে হলে আরেকটি বিষয় বুঝতে হবে যে, কুরআন রাসূল সা:-এর জন্য গাইডবুক হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। এই কুরআন তাঁর নবী জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে পথপ্রদর্শন করেছে। রাসূল সা: যখন যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন, তখন আল্লাহ তায়ালা সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে পথ দেখিয়েছেন। যেমনÑ বদর, ওহুদ ও আহজাব যুদ্ধ যখন চাপিয়ে দেয়া হয়, তখনো আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা: কে পথ দেখিয়েছেন। কুরআনে ২০০ বা তারও বেশি জায়গায় ‘কুল’ (বল) উল্লেখ করে রাসূল সা:কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কখন কী করতে হবে, কাফেরদের শত শত প্রশ্নের জবাবে রাসূলকে কী বলতে হবে। আমরা আশা করব, এই লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশে কুরআনের চর্চা বাড়বে এবং যারা কুরআনের গভীরে যেতে চান, তারাও উপকৃত হবেন। 

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/422749