৩ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ১২:৫৭

অর্থবছরের প্রথম ২ দিনে সরকার ব্যাংক ঋণ নিলো ২ হাজার কোটি টাকা

নতুন অর্থবছরের প্রথম দুই দিনে (১ ও ২ জুন) সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলো দুই হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গতকালই নিয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। আর এতে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ব্যয় হবে ৭ টাকা ৯৪ পয়সা। ১৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দুই বছরের জন্য এ ঋণ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সরকারের বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় সুদব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সক্ষমতা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সমাপ্ত অর্থবছরের শেষ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় অর্ধেক ঋণ সরবরাহের কারণ হিসেবে ওই সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এক মাসে বড় অঙ্কের ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দিত। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতো। মূলত টাকার সঙ্কটের কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের যোগান দেয়া হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের আরো কয়েক মাস বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাজারে নানাভাবে টাকার যোগান দেয়া হবে। ব্যাংকগুলোর বড় ধরনের নগদ টাকার সঙ্কট না হয় সে জন্য রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর টাকার যোগান অব্যাহত রাখা হবে। একই সাথে সররকারের ঋণের যোগান দিলে অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে সরকারের ঋণ আকারে টাকার যোগান দেয়া হলে বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ অনেক বেড়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক টাকা বের করা হলে বাজারে সাড়ে সাত টাকার প্রভাব পড়ে। ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির কিছুটা চাপ বেড়ে গেলেও মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ব্যয় মেটাতে ব্যাংক খাতে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা ৩০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। কারণ সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নেয়া হয়। ফলে ব্যাংক খাত থেকে কম ঋণ নিতে হয়েছে। তবে গত বছর কি পরিমাণ ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে তার চূড়ান্ত হিসাব পেতে আরো ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জনে অর্থবছরের প্রথম দুই দিনেই দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ১৫টি ব্যাংকের কাছ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বড় অঙ্কের ঘাটতি বাজেট দেয়ায় প্রতি বছরই সরকারের দেশী বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর সেই সাথে বাড়ছে এসব ঋণের সুদ ব্যয়। বিশ্লেষকদের মতে, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ঋণ নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিচর্যা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আর এতে কমে যাচ্ছে প্রকৃত উন্নয়ন ব্যয়। আবার স্থানীয় ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ায় ব্যাংকের প্রকৃত বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার তার আপৎকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিনা সুদে চার হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে। এর অতিরিক্ত হলেই ৯১ মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের সমপরিমাণ সুদ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরিশোধ করতে হয়। এটাকে ব্যাংকিং ভাষায় ওভার ড্রাফট বা ওডি বলে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নেয়ায় তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, তারা সরকারের ঋণ দিয়ে যে পরিমাণ মুনাফা করছেন, আমানত সংগ্রহ করতে ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। যেমন সরকার ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিলে সর্বোচ্চ মুনাফা দিচ্ছে ১০ টাকা। তবে যে ক্ষেত্রে ১০ টাকা দেয়া হচ্ছে তা দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ। কিন্তু আমানত সংগ্রহ করতে সর্বোচ্চ ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ১০ টাকার ওপরে।

এতে দেখা যাচ্ছে সরকারের ঋণ দিতে গিয়ে তাদের নিট লোকসান হচ্ছে। আর এ লোকসান সমন্বয় করা হচ্ছে বেসরকারি খাত থেকে তুলনামূলক বেশি সুদ নিয়ে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের নানাভাবে দাবির পরেও ব্যাংক ঋণের সুদহার কমাতে পারছে না।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো সরকারের ব্যাংক ঋণ। শুধু ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ই বাড়ছে না, ব্যাংকের টাকাও ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। তার মতে সরকার এখন স্বল্প মেয়াদি ঋণ নেয়ার পরিবর্তে দীর্ঘ মেয়াদি অর্থাৎ ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদে বেশি ঋণ নিচ্ছে। ১০০ টাকা মূল্যমানের সম্পদ ২০ বছর পরে আর ১০০ টাকা থাকছে না। মূল্যস্ফীতির কারণে তা কমে যাচ্ছে। অপর দিকে সরকারের কোষাগারে টাকা আটকে যাওয়ায় তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। ফলে শিল্পায়নেও ব্যাঘাত ঘটছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/422350