৩ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ১২:৫১

দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : দেশে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বায়ু, পানি, মাটি, কৃষি, শব্দ, নদী, খাদ্য, প্রকৃতি, পরিবেশসহ সবক্ষেত্রেই দূষণ এখন চরম রূপ নিয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, নানাবিধ দূষণজনিত কারণে জাতির অস্তিত্ব আজ এক মহাসংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসযন্ত্রে প্রদাহ, চোখ জ্বলা ও ফুসফুসের রোগ অনেক বেড়েছে। এছাড়াও ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্কে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। এসব কারণে মানুষ অকাল মৃত্যুরও মুখে পতিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বায়ুদূষণে সচেতনতার অভাব বেশ প্রকট। সচেতনতা সৃষ্টি করে দূষণের মাত্রা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। দূষণ রোধে সরকারের উদ্যোগকে যেমন আরও ত্বরান্বিত করতে হবে, পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সবার সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

সূত্র মতে, দেশের অধিকাংশ স্থানে মাটি ও পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের ঝুঁকি আগেই ছিল, এবার দেশের রাস্তার ধুলার মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছেন গবেষক দল। দেশের বাতাসে ভয়াবহ বিপদ! বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থের কণা ও ক্ষুদ্র অণু অধিক অনুপাতে মেশানো বায়ু দেশবাসী প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশের বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ এ সংস্থার বেধে দেয়া সীমার দশগুণের বেশি। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় বায়ুদূষণের মধ্যে কাটিয়ে দেয়, তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি অন্যতম। সার্বিক দূষণের জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলো অনেকটাই দায়ী। এসব দূষণ রোধে শক্ত পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পনার অভাবেই দেশে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে দিন দিন। এ পরিস্থিতি আর কতটা খারাপ হলে সবার টনক নড়বে, সেটা কেউই বুঝতে পারছেনা। যেখানে দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে বিশ্বের সভ্য মানুষ আজ আতঙ্কিত, কী উপায়ে এ ভয়ংকর সমস্যার মোকাবেলা সম্ভব, তা নিয়ে তাদের ভাবনা-পরিকল্পনার শেষ নেই। সেখানে বাংলাদেশ সরকার অনেকটা নির্বিকার।

সূত্র মতে, ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে অবকাঠামো নির্মাণ এবং যানবাহন ও কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুদূষণ বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, দেশে কয়লা পোড়ানো হয় এমন শিল্পকারখানার সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশে যে নির্মাণকাজ চলছে, তাতে প্রচুর ধুলা ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। শুষ্ক মওসুমে বাতাসে ওই ক্ষুদ্র কণাগুলো এমনিতেই বেশি পরিমাণে পরিবাহিত হয়। আর এ সময়ে বেশি নির্মাণকাজ চলে এবং দেশের সব ইটভাটা চালু থাকে। ফলে দূষণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। অন্যদিকে শীত মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় এসব সূক্ষ্ম বস্তুকণা বাতাসে ভাসতে থাকে, যা অক্ষত অবস্থায় মানবদেহে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে থাকে। তবে সাধারণত বর্ষা মৌসুমে বাতাসে গ্যাসীয় পদার্থ ও বস্তুকণা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকে। শুষ্ক মওসুমকে নির্মাণকাজের উপযুক্ত সময় বিবেচনা করা হয়। সে হিসেবে এ সময়ে কাজও বেশি চলে। কিন্তু নির্মাণকাজের সময় যেসব নিয়ম মানার কথা সেগুলো সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি মানেন না কিংবা মানার চেষ্টাও করেন না। যে নির্মাণকাজগুলো হয়, সেখানে সকাল ও বিকাল দুই বেলা নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে বালু ও ইট, পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয় না, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখার চিন্তাও কেউ করে না। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে মেট্রোরেল ও উড়াল সড়ক নির্মাণ দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং রাখবে। কিন্তু নির্মাণকারী সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয় না। ঢাকা শহরে ধুলা নিয়ন্ত্রণে সকালে নিয়মিত সড়কে পানি ছিটানোর কথা থাকলেও তা কতটুকু মানা হয় সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।

সবুজ পরিবেশ আন্দোলন এর সমাজসেবা সম্পাদক সফিউল আযম বলেন, দেশে দূষণের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হবেনা। বিশেষ করে দূষিত বায়ু মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। তিনি বলেন, দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে শ্বাসযন্ত্রের রোগ ছাড়াও ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্কে মারাত্মক রোগব্যঅধি হচ্ছে। দূষণ রোধে সরকারের উদ্যোগকে আরও ত্বরান্বিত করার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। করতে হবে, পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সবার সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

এক গবেষণায় জানা গেছে, ২০১৫ সালে বিভিন্ন প্রকার দূষণের শিকার হয়ে সারা বিশ্বে ৯০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছে বাংলাদেশে। দূষণজনিত মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশের প্রধান কারণ হলো বায়ুদূষণ। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলান্বিয়ার হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস এ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। মার্চ ২০১৯ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এয়ারভিজ্যুয়ালের ‘বিশ্ব বাতাসের মান প্রতিবেদন ২০১৮তে বলা হয়েছে, বিশ্বে সর্বাধিক বায়ুদূষণের কবলে থাকা রাজধানী শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এই শহরে বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পি এম (২.৫) পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রার চাইতে প্রায় ১০ গুণ বেশি। একটি বেসরকারি সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ আর ভারত ও চীনে মারা গেছে ১২ লাখ মানুষ। এ বায়ুদূষণের কারণে ২০১৭ সালের হিসাবে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, শিল্প, যানবাহন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং নগরায়ন পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। তবে বায়ুদূষণের বড় দুটি উপাদান হল, শিল্পকারখানার বর্জ্য ও যানবাহনের ধোঁয়া। বাতাসে থাকা রাস্তাঘাট ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন স্থাপনার ধুলিকণা, সালফার-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ওজোন, সাসপেনডেড পার্টিকুলার ম্যাটার, বাতাস দূষণের জন্য বহুলাংশে দায়ী। ইটভাটার ধোঁয়া এ ধরনের দূষণের আর একটি কারণ। পেট্রোল, ডিজেল এবং কাঠসহ নানাধরনের কার্বন-যুক্ত জ্বালানি আধপোড়া হলে কার্বন মনোক্সাইড রঙ বিহীন গন্ধবিহীন গ্যাস তৈরি হয়। সিগারেট পোড়ালেও এই গ্যাস বের হয়। এই গ্যাস আমাদের শরীরে অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এক গবেষণায় জানাগেছে, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮%, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮%, যানবাহন ১০%, বায়োমাস পোড়ানো ৮% এবং অন্যান্য উৎস ৬% দায়ী। পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় জানা যায় যে, ঢাকা শহরে পরিবেশ দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী। ১০৪৮ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত স্ট্রোকের ওপর ৯৪টি গবেষণায় তথ্য রিভিউ করে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনতি হর যে, উচ্চমাত্রায় বায়ুদূষণের আওতায় থাকা এবং স্ট্রোকের মাঝে সম্পর্ক বিদ্যমান।

গবেষণা করে দেখা গেছে, বায়ুদূষণের ফলে কিডনির কাজে বাধা পড়ে। কিডনির রোগ হয় এমনকি কিডনি ফেইলিওর পর্যন্ত হতে পারে। কম পরিমাণে বায়ুদূষণ ও কিডনিকে প্রভাবিত করতে পারে। আর দূষণ বাড়তে থাকলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ে। শুধু যে শরীরের উপরেই বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা কিন্তু নয়। বায়ুদূষণে মানুষিক সমস্যা বাড়ায়। জানা যায়, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয়ার ফলে হতে পারে হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ। এ্যালকোহল, কফি, যেভাবে হার্ট এ্যটাকের জন্য দায়ী, বায়ুদূষণ ও সেভাবে দায়ী। হার্ট এ্যটাকের জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়, এটা গবেষকদেকদের গবেষণায় পাওয়া গেছে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ থেকে ক্যান্সার হতে পারে। মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

ওয়াল্ড ব্যাংব বলছে, বাংলাদেশে পরিবেশগত দূষণ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, প্রতি বছর, শুধু ঢাকায়ই এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটে। সারা দেশে শহরাঞ্চলে মারা যায় ৮০ হাজার মানুষ। রিপোর্টে প্রকাশ-বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতি ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ২ দশমিক ৭ শতাংশ। শুধু বায়ুদূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। দূষণের সব চাইতে বেশি শিকার হয় শিশুরা।

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন চলছে। সে সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত পরিবেশ নিয়ে পৃথিবীর মানুষকে সর্তক করেছে। পরিবেশের অবনতির কারণে বিশ্ব ব্যাপি আবহাওয়া পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবেশগত সমস্যায় তৃতীয় বিশ্বের লোকজন বেশি দুর্যোগের মুখে। অথচ দেশের ক্ষমতাসীনদের পরিবেশ নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নেই। ২০০৬ সালে সর্ব প্রথম এই সূচক তৈরি করা হয়ে ছিল। সে বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। অর্থাৎ গত এক যুগে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে। এই ক্রমাবনতি ঘটছে, তা নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই। জানা গেছে, বিশ্ব ব্যাংকের ঋণের টাকায় সরকার ঢাকার পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় না করে পরিবেশ অধিদফতরের বহুতল ভবন, সড়কে উন্নতমানের ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করেছে।

রাজধানীসহ সারাদেশে দূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠনগুলো। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ঢাকা মহানগরীতে দূষণের প্রকোপ অনেক বেড়ে গেছে। হাজার হাজার ইটভাটায় ইট প্রস্তুত ও পোড়ানোর পাশাপাশি মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের কারণে দূষণ এখন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্রেনের ময়লা আবর্জনা রাস্তার দু’পাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে দূষণ বন্ধে জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করেন তিনি।

https://www.dailysangram.com/post/381328