২ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার, ১১:৪৮

রিফাতের খুনিরা মাদকের কারবারও গড়ে তুলেছিল

বরগুনার সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তাঁর ছেলে সুনাম দেবনাথ। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই সুবাদে যুবলীগকর্মী মঞ্জুরুল আলম জনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও বেশ। এ সম্পর্কের কারণেই জন এমপিপুত্রের সঙ্গে বাইকে পুরো শহর দাবড়িয়ে বেড়ান। জনের সঙ্গে রয়েছে নয়ন বন্ড গ্রুপের সখ্য। রিফাত শরীফ খুনের মামলার আসামি নয়ন-রিফাতরা তাই বেপরোয়া ছিল। তারা গড়ে তুলেছিল মাদকের নেটওয়ার্ক। এমপিপুত্রের ডান হাত ছিলেন জন আর বাম হাত নয়ন-রিফাতরা। এ কারণে এমপিপুত্রের বিরুদ্ধে বছরখানেক আগেই জেলা ছাত্রলীগ মাদক কারবারের অভিযোগ তুলেছিল। সুনামের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নয়ন বন্ড মাদক কারবার চালাচ্ছিল বলে ছাত্রলীগ সেই সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে।

রিফাত খুনের পরে বরগুনার বাসিন্দারা মাদকের নেটওয়ার্কের ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারদলীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও ইঙ্গিতে বলছেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় নয়ন-রিফাতরা শহরে মাদকের কারবার খুলে বসেছিল। পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক মঞ্জুরুল আলম জন নেপথ্যে থেকে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তাঁরই মদদে নয়ন-রিফাতরা কারবার চালিয়ে আসছিল। জেলা ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলনের পর জনকে নিয়ে সুনাম দেবনাথের ফেসবুকে স্ট্যাটাস এবং জনের সঙ্গে নয়ন বন্ডের ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে থাকা ছবিই রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে মাদক সন্ত্রাসীদের বেড়ে ওঠার বিষয়টির প্রমাণ দেয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভার আশপাশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, পৌর মার্কেটের তৃতীয় তলায় জনের একাধিক কক্ষে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। সেই আড্ডায় প্রায়ই নয়ন ও তার সহযোগীরা আসত। তা ছাড়া জনের নেতৃত্বে পুরো শহরের পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি তাঁর অনুসারী শ্রমিকরা নিয়ন্ত্রণ করে। শহরের অধিকাংশ সালিস-মীমাংসা জনের কক্ষেই চলে। কেবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাতে। খাকদোন নদীতে চলাচলকারী নৌকা থেকে চাঁদা তোলার কাজটিও জনের লোকজনই করে। মাদকের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই। কারণ তাঁর সঙ্গে এমপিপুত্রের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

গতকাল মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে কথা হয় জনের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমপি শম্ভু বাবু আমার বাবার রাজনৈতিক অভিভাবক। আর এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ আমার রাজনৈতিক অভিভাবক। শুধু দলীয় কর্মসূচি নয়, অধিকাংশ সময় আমি তাঁর সঙ্গে থাকি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার সমর্থনে সুনাম দাদার মোটরবাইকে করে গণসংযোগ করেছি। বন্ধু রিফাত শরীফকে নিয়ে প্রায়ই এমপির বাসায় যেতাম। রিফাতকে আমিই ডিশলাইনের ব্যবসায় এনেছি। তাই বিয়ের আগে রিফাত আমার বাসায় থাকত।’

নয়ন বন্ডের সঙ্গে ছবি থাকা প্রসঙ্গে জন বলেন, ‘বরগুনা ইজিবাইক মালিক শ্রমিক সমিতির উদ্যোগে গত বছর আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। ওই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে আমি অনেককেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তখন বিনা আমন্ত্রণেই নয়ন আমাদের সঙ্গে কুয়াকাটা ভ্রমণে যায়। আমার অজান্তেই ছবি তোলে। তবে এত দিন বিষয়টি আমাকে কেউ অবগত করেনি। এর পর থেকে নয়নের সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি।’ এ প্রতিবেদকের কাছে দুজনের একাধিক ছবি থাকার ব্যাপারে জন কোনো মন্তব্য করেননি। তবে বারবারই বলেছেন, ‘ নয়ন মাদকসেবী। ও আমার কাছে ভিড়ত না।’

‘আপনিই বলেছেন, নয়ন মাঝে মাঝে মিন্নিকে বিরক্ত করত। তখন আপনি প্রতিবাদ করেননি কেন’—এ প্রশ্নের জবাবে জন বলেন, ‘রিফাত শরীফ আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কিন্তু আমি ওর বিয়েতে যাইনি কারণ শুরুতেই আমি বিষয়টি মেনে নিতে পারিনি। আমরা বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঈদের পরে নয়নকে মারধর করব। কিন্তু ওই ঘটনা ঘটালে রাজনৈতিকভাবে একটি পক্ষ ফায়দা লুটবে। তাই আর ঝামেলায় যাইনি। এ কারণেই আজ রিফাত আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে।’

মিন্নির সঙ্গে তাঁর বাসায় রবিবার সকালে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। মিন্নি বলেন, ‘রিফাত বেকার ছিল। তাই শুরুতেই বিয়ের ব্যাপারে আমার পরিবারের আপত্তি ছিল। বিয়ের পর কিছু একটা করার জন্য আমি বারবারই তাকে বলেছি। কিন্তু রিফাত তা না করে জনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যেত। এটা নিয়ে আমার সঙ্গে রিফাতের মনোমালিন্য হয়েছিল। কারণ জনের ব্যাপারে মানুষের ধারণা তেমন একটা পজিটিভ না। ওর সঙ্গে নয়নদের ওঠাবসা ছিল। আমার পরিবারও রিফাতকে ওর (জন) সঙ্গে মিশতে বারণ করত। এ কারণেই জন আমার পছন্দ করত না। জনের কারণেই আমি রিফাতের লাশটি শেষবারের মতো দেখতে পাইনি। এমনকি ওর কবরে এক টুকরো মাটিও দিতে পারেনি। জন আমার বাবার সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেছে।’

এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ গত ২৭ জুন তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘রিফাত শরীফ খুব সাহসী ছেলে, এটা যারা রিফাতের সঙ্গে মেলামেশা করেছে বা যারা ওর বন্ধু তারা খুব ভালো করে জানে। রিফাত, জন, প্রান্ত, পাপ্পু, সানজিদ এরা একসঙ্গে চলেফেরে বলে আমিও রিফাতকে ভালো করে চিনি।’ জন সম্পর্কে সুনাম বলেছেন, ‘তার বাবা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। তিনি প্যানেল মেয়রও। জন ভালো ছেলে হিসেবেই শহরে পরিচিত। সে যুবলীগের রাজনীতি করে, তাই সভা-সমাবেশে দেখা হয়। কথা হয়। এর বাইরে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীরের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে শনিবার এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘পৌর মার্কেটের তৃতীয় তলায় সন্ধ্যার পর কিসের আসর বসে তা শহরবাসী জানে। কারা সে আসরে নিয়মিত অংশ নেয়, তাও আমরা জানি। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারি না। প্রতিবাদ করলেই বিষয়টি দলীয় কোন্দলের কথা বলে আমাদের বিব্রত করবে। কারণ সেই আসরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের দলের কেউ কেউ।’ তবে এই ‘কেউ কেউদের’ নাম বলেননি তিনি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2019/07/02/786343