ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো কাঠের স্লিপার আটকানো হয়েছে লোহার নাটের বদলে কাঠের টুকরো দিয়ে। আর থ্রেটহীন নাট ধরে রাখতে থ্রেট অংশেই বেঁধে দেয়া হয়েছে পলিথিন আর সুতলি দিয়ে। ব্রিজ দু’টির উপরের রেললাইনে ক্লিপ, নাট, হুক, ফিসপ্লেট, স্লিপার, গার্ডার বয়সের ভারে ন্যূব্জ। তাই একে অপরের পরিপূরক পুরাতন ওই খুচরা নানা ছোট-বড় যন্ত্রাংশ এখন অধিকাংশই অকেজো। আর যেগুলো আছে, সেগুলোও সংখ্যায় অপ্রতুল। ৪টি নাটের স্থানে আছে মাত্র দু’টি। তাও রুগ্ণদশার। সরজমিন মনু ও পলকি ব্রিজ দু’টিতে গেলে এমন চরম ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্য চোখে পড়ে। কুলাউড়ার হাজীপুর ২০৬ নং মনু সেতুর উপরের ২০৭টি কাঠের স্লিপারের মধ্যে প্রায় ১শ’টিই নষ্ট।
আর ২০৫ নং পলকি সেতুর ১৮৫টি স্লিপারের মধ্যে ৯৫টিই নষ্ট।
অন্যগুলোর অবস্থাও তেমন ভালো নয়। পুরাতন ওই কাঠের স্লিপারগুলোর অধিকাংশই পঁচা। বছর দু’এক আগে ওখানকার স্লিপার বাঁশের ফালি দিয়ে আটকানো হয়েছিল। তখন এনিয়ে স্থানীয় লোকজন ও গণমাধ্যম সোচ্চার হলে ঠনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। এরপর ওই স্থানে বাঁশের বদলে কাঠের ফালি দিলেও অন্যান্য যন্ত্রাংশ পরিবর্তন হয়নি এখনো। ট্রেন গেলে লাইন ফাল দেয় (লাফ দেয়)। অনেকটা কাত হয়ে যায় ট্রেনও। অতিরিক্ত ঝাঁকুনিতে বিকট শব্দে মনে হয়, এই বুঝি ভেঙে পড়লো রেললাইন আর ব্রিজ। এরকম আগে না হলেও এখন হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের বেলা যখন কালনীসহ দ্রুতগতির আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো ওই ব্রিজ দু’টির উপর দিয়ে যাতায়াত করে তখন মনে অজানা ভয় কাজ করে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় তখন তসবি জপ করি। যেন আমাদের এলাকায় কোনো ট্রেন দুর্ঘটনা না ঘটে। একনাগাড়ে ক্ষোভের সঙ্গে এ কথাগুলো জানালেন, কুলাউড়ার হাজীপুর ইউনিয়নের মাহতাবপুর, টুকলি, রাজনপুর, পাবই ও চক শালনপুর গ্রামের দেলোয়ার হোসেন, জাহিন মিয়া, সুবাস রবি দাস, মিজান মিয়া, আব্দুল জলিল, সাইফুল ইসলাম, মবশ্বির আলী, কালাম মিয়া, শরিফ মিয়াসহ অনেকেই। তারা জানালেন, প্রতিদিনই ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার আতঙ্কে থাকেন। বার বার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ দেয়ার পরও তারা তা আমলেই নিচ্ছেন না। পলকি ও মনু ব্রিজের উপরের রেললাইন এখন চরম ঝুঁকিতে। ব্রিজের গার্ডারের ক্লিপ, নাট ও হুক নড়েবড়ে আর অধিকাংশই নেই। লাইনের অধিকাংশ ফিসপ্লেট নেই। আর যেগুলো আছে সেগুলোও পুরাতন হওয়ায় ক্ষয়ে গেছে। ব্রিজের উপরের কাঠের স্লিপারগুলোও পচা ও ক্ষয়ে যাওয়া। রেললাইনের সঙ্গে কার্যক্ষমতা হারানো পুরাতন ওই কাঠের স্লিপার আটকানোর ক্লিপ, হুক, নাট, ফিসপ্লেট কোনো কিছুরই অবস্থা ভালো নেই। ব্রিজের উপরের লাইন জয়েন্ট পয়েন্টগুলোতে ফাঁক। ওখানে আটকানোর জন্য লাগানো নাটগুলো ঢিলেঢালা। জং ধরানো থ্রেট ক্ষয়ে যাওয়া ওই নাট ও হুকগুলো হাত দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই খুলে যাচ্ছে। দ্রুতগতিতে ট্রেন ওই স্থান দিয়ে অতিক্রমের সময় ট্রেন লাইন উপর-নিচে ওঠানামা করে। মনু ব্রিজের মধ্যখানে ১০-১৫টি কাঠের পুরনো স্লিপার নিজ স্থান থেকে সরে গিয়ে আঁকাবাঁকা অবস্থায় কোনো রকম টিকে আছে। ব্রিজটির উভয় দিকের প্রথম অংশ বেশ ক’টি স্লিপারের অধিকাংশই পচা। গার্ডারের সঙ্গে রেললাইনের সংযোগ দেয়া নাট-বল্টু ঢিলেঢালা ও ফাঁক। আর ক্লিপ দিয়ে আটকানোর পরও স্লিপারের সঙ্গে রেললাইনের ফাঁক কয়েক ইঞ্চি। একারণে ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় ওই রেললাইন যেমন ওঠানামা করে তেমনি শব্দও হয় বেশি। চরম বেহালদশায় পলকি ব্রিজও। ব্রিজের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাঠের স্লিপার, রেললাইন, ফিসপ্লেট, নাট-বল্টু সবকিছুতেই সমস্যা। ব্রিজের পার্শ্ববর্তী মাহতাবপুর গ্রামের বাসিন্দা নূর মিয়া ও জুনু মিয়া বলেন, ব্রিজের উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটলেও ভয় করে। কি জানি ব্রিজের পচা স্লিপারগুলো ভেঙে পড়ে। এমতাবস্থায় কীভাবে দ্রুতগামী ট্রেনগুলো ওই ঝুঁকিপূর্ণ স্থান পাড়ি দেয়। ৩৬০ আউলিয়ার দোয়ায় আল্লাহ দয়া করে আমাদের রক্ষা করছেন। মনু থেকে পলকি সেতুর দূরত্ব প্রায় অর্ধ কিলোমিটার। এই অর্ধকিলোমিটারের রেললাইনের অবস্থাও চরম দুর্দশায়। অনেক স্থানেই রেলের পাত গলে চিকন হয়ে গেছে। জয়েন্ট পয়েন্টগুলোতে পর্যাপ্ত নাট ও ফিসপ্লেট না থাকায় কয়েক ইঞ্চিই ফাঁকা। আর রেলের স্লিপারের মধ্যখানে নেই পর্যাপ্ত পাথর। স্থানীয়রা জানান, আল্লাহ না করুক নানা ত্রুটির কারণে ওখানে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ট্রেনের বগিগুলো যদি ব্রিজ থেকে লাইনচ্যুত হয়ে বড়ছড়ার ব্রিজের মতো নিচে পড়ে তাহলে পানিতে ভরপুর মনু ও পলক থেকে জীবিত যাত্রী উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। জানা যায়, সিলেট আখাউড়া ১৭৯ কিলোমিটারের রেলপথের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলা অংশে বন্ধ খোলা মিলে ১১টি রেল স্টেশন রয়েছে। স্টেশনগুলো হলো ভাটেরা, বরমচাল, ছকাপন, কুলাউড়া জংশন স্টেশন, লংলা, টিলাগাঁও, মনু, শমসের নগর, ভানুগাছ, শ্রীমঙ্গল ও সাতগাঁও। এই ১১টি স্টেশন এলাকায় প্রায় অর্ধশতাধিক ছোট-বড় রেল ব্রিজ ও কালভার্ট রয়েছে। পুরাতন ওই ব্রিজগুলোর নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত হয়নি কোনো মেরামত কাজ। এর মধ্যেই অধিকাংশই ব্রিজের উপরের রেললাইন রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জোর দাবি বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে দ্রুত ব্রিজ ও রেললাইন নির্মাণ ও মেরামতের। এ বিষয়ে জানতে রেল বিভাগের স্থানীয় প্রকৌশলীদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা কেউ ফোন রিসিভ করেননি। কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজের ওই ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে রেল বিভাগের অনেক কর্মকর্তা মুঠোফোনে বা সরাসরি এসব বিষয়ে কোনো বক্তব্য মিডিয়ায় দিতে চাচ্ছেন না।