১ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ১২:৩৭

নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর আজ থেকে

উৎকণ্ঠায় ভোক্তা-ব্যবসায়ীরা

ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখেই আজ থেকে কার্যকর হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন। বিশেষ করে খুচরা পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ীই নতুন এ পদ্ধতি নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন। নতুন প্রক্রিয়ার সার্বিক বিষয়ে পুরোপুরি প্রস্তুত নন তারা। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সরকারের বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আহরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে এ আইন। নতুন এ আইনের সুযোগে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়বে, বাড়বে ভোক্তাদের ভোগান্তি। ভ্যাটের হিসাব স্বচ্ছ রাখতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস সরবরাহ করবে এনবিআর। যদিও লাখ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে শুরু হচ্ছে মাত্র ১০ হাজার মেশিন সরবরাহের মধ্য দিয়ে। এ মেশিনের বিষয়েও কিছুই জানেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, পুরনো আইনের সাতটি হারের পরিবর্তে নতুন আইনে সব মিলিয়ে পাঁচটি ভ্যাট হার হচ্ছে। এই হারগুলো হলো ২, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫। এ ভ্যাট ব্যবস্থাও পুরোপুরি অনলাইন-ভিত্তিক হবে না। হিসাব-নিকাশ ব্যবস্থাও আগের মতোই খাতা-কলমে রাখা যাবে। সীমিত পরিসরে অনলাইন-ভিত্তিক ভ্যাট রিটার্ন জমা, ভ্যাট পরিশোধের সুযোগ দিয়ে আপাতত নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হবে। তবে পুরনো আইনের প্যাকেজ ভ্যাট থাকছে না। আমদানিমূল্যে ৫০ হাজার ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) ব্যবসায়ীদের দেয়ার কথা থাকলেও তা দিতে পারেনি এনবিআর।

নতুন ভ্যাট আইনটি সংশোধন করে আরো বেশ কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালের মূল আইনে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ টাকার কম হলে কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। এখন তা বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। টার্নওভার করের সীমা ন্যূনতম বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৮০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এখন থেকে ৮০ লাখ থেকে তিন কোটি টাকা বার্ষিক লেনদেন হলে টার্নওভার কর দিতে হবে। টার্নওভার করহার ৩ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ করা হচ্ছে।

নতুন ভ্যাট আইন সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ১৫ শতাংশের পরিবর্তে আরো কম হারের একটি একক ভ্যাট হার থাকলে ভালো হতো। হিসাব-নিকাশ করা সহজ হতো। এতে ভ্যাট রেয়াত নেয়ার ক্ষেত্রে কারসাজি করার সুযোগ কম। তিনি মনে করেন, বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় হিসাবব্যবস্থা বা ইসিআর মেশিন নেই। আবার কোনো রসিদ দেয়া হয় না। ব্যাপকভাবে ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। একটি নতুন আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে; কিন্তু এসব বিষয় কিভাবে মোকাবেলা করা হবে, সেই বিষয়ে বাস্তবে উদ্যোগ নেই।

বাংলাদেশে ভ্যাট আইন করার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সুপারিশ করেছিল ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আইনটি করার জন্য এর মধ্যে বহুবার চাপ দিয়েছে আইএমএফ। চাপে কাজ না হলে আইন করার শর্তে ঋণ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ঋণ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার রাজিও হয়েছিল। ২০১৭ সালের পহেলা জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল নতুন ভ্যাট আইন। কিন্তু জনরোষের ভয়ে শেষ পর্যন্ত দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। স্থগিতের মেয়াদ শেষ হয়েছে গতকাল ৩০ জুন। সরকারের সামনে কোনো কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায়, ব্যবসায়ী নেতারা দলীয় আস্থাভাজন হওয়ায় এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরঙ্কুশ সমর্থন থাকায় এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না বলেই আশা করছে সরকার। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে সাহস না পেলেও চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে সাধারণ ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের মধ্যে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম এ প্রসঙ্গে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর মাঠপর্যায়ে কোনো সমস্যা হলে এফবিসিসিআইয়ের সাথে আলোচনা করে সমাধান করবে সরকার। সরকার এখনই কঠোর কোনো অবস্থানে যাবে না। কোথাও কোনো সমস্যা হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। যেমন রেয়াত নিতে না পারলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সব ব্যবসায়ী চেম্বার ও সমিতির সভাপতিদের এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি গঠনের অনুরোধ করেছে এফবিসিসিআই।

যদিও আইনটি নিয়ে ইতঃপূর্বে আপত্তি তুলেছিল ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) লেখা এক চিঠিতে এফবিসিসিআই বলেছে, নতুন ভ্যাট আইনে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে গত দুই বছরে ব্যবসায়ীদের সাথে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। অপ্রস্তুত ও মূল্যায়ন ছাড়া আইনটি বাস্তবায়িত হলে পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানায় এফবিসিসিআই। অপ্রস্তুত ও পুনর্মূল্যায়নে সময়ক্ষেপণ করা ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করবে জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সদ্যবিদায়ী সভাপতি মো: শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, এ আইন সার্বিক বিচারে গণমানুষের বিপক্ষে যাবে। এতে সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। অবশ্য সরকারের ইশারায় এবং নেতৃত্ব বদলের ফলে এ আইন নিয়ে নতুন করে আপত্তি তুলছে না এফবিসিসিআই।

নতুন ভ্যাট আইনে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে জানিয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বলা হচ্ছে যারা ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দেবেন, তারা মূসক রেয়াত সুবিধা নিতে পারবেন না। কিন্তু ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আগের পর্যায়ে যে ভ্যাট দিয়ে এসেছে, তা যোগ করলে তো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভ্যাট হয়ে যাবে! নতুন আইনে কোন পণ্যে কত ভ্যাট হার হবে সেটি চূড়ান্ত করার ওপর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, কোনোরূপ প্রস্তুতি ছাড়াই এনবিআর আইনটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এতে জগাখিচুড়ি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা ও জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি।

এ দিকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের সব প্রস্তুতি রয়েছে দাবি করে এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে ট্যারিফ লাইনে ছয় হাজার ৪৭৩ ধরনের পণ্য আছে। নতুন আইনে মৌলিক খাদ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এই তালিকায় এক হাজার ৯৮৩টি পণ্য ও সেবা আছে। বাকি চার হাজার ৮১৬টি পণ্য ও সেবার আমদানি বা উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পর্যায়ে বিভিন্ন হারে ভ্যাট আরোপিত হবে। নতুন আইনে রিটার্ন জমা এবং কর পরিশোধসহ সব কাজই হবে অনলাইনে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/421798