৩০ জুন ২০১৯, রবিবার, ১:২৩

শতফুল ফুটতে দাও

গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজে প্রতিবাদমনস্কতা থাকে না

সম্প্রতি বরগুনায় কুপিয়ে হত্যার যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তাতে দেশবাসী স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ, ক্ষুব্ধ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়! একটি দৈনিকে ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদক লিখছেন, ‘দুই পাশে দুইজন। হাতে তাদের লম্বা রামদা।

মাঝে ফেলে একজনকে তারা কোপাচ্ছে। ইচ্ছামতো। এক নারী দৌড়ে এসে ঘাতকদের ঠেকাচ্ছেন।

কিন্তু পারছেন না। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যাচ্ছে তারা। দিনের আলোয় প্রকাশ্যে রাস্তার ওপর যখন এমন পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে, তখন চারপাশ ঘিরে আছে আরও বেশ কয়েকজন যুবক।

পথচারীরাও দেখে দৌড়ে পালাচ্ছিল। আর এই পুরো ঘটনাটি ভিডিও হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। যাদের চোখের সামনে এই ভিডিও পড়েছে, তারাই দেখেছে। দেখে আঁতকে উঠেছে। এও কি সম্ভব! মানুষ ভয়ে কাঁপছিল ভিডিওটি দেখে। আর যাদের দেখে মানুষ কাঁপছিল সেই ঘাতকরা কারা? এমন প্রশ্নই ছিল গতকাল সর্বমহলে।’
বরগুনায় বুধবারের নিষ্ঠুর হত্যা প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বলেছেন, রাস্তায় প্রকাশ্যে একজনকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মারল, জনগণ সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও করল; কিন্তু কেউ বাধা দিল না। কেউ প্রতিবাদ করল না।

সমাজ কোথায় যাচ্ছে! স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে রিফাত নামের যুবককে কুপিয়ে হত্যার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নজরে আনা হলে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সমাজ কোথায় যাচ্ছে?’ এই প্রশ্ন শুধু হাইকোর্ট বেঞ্চের নয়, দেশের সব বিবেকবান মানুষের।

বাংলাদেশে এরকম নৃশংস ঘটনা যে প্রথমবারের মতো ঘটেছে, এমনটি নয়। গত ক’বছর ধরে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার অনেক দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে। পুলিশের অপরাধসংক্রান্ত ফাইলে কিংবা পুরনো সংবাদপত্র স্ক্যান করলে এ রকম ঘটনার আরও নজির খুঁজে পাওয়া যাবে। এ ঘটনার পরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে, তাতে ঘটনাটিকে বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হয়েছে; কিন্তু ঊর্ধ্বতন আদালতে দণ্ড হ্রাস করা হয়েছে। এখনও পুরো বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। বিশ্বজিৎ ও রিফাত হত্যার মধ্যে নৃশংসতায় কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হল- বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ছিল রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতার জের। আর রিফাত হত্যাকাণ্ড সামাজিক অবক্ষয়ের এক দগদগে ক্ষতচিহ্ন।

দেশে এমন হত্যাকাণ্ড কেন ঘটছে, কেন হত্যাকাণ্ডকে কেউ বাধা দিচ্ছে না, হত্যাকারীরা কেন এমন জিঘাংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ মনে করছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, গণতন্ত্রহীন সমাজে মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। ফলে ভয়ের আবহ পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলে।

মানুষ যখন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে তখন সমাজে এক ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই গোষ্ঠীতন্ত্রের যারা মালিক, মোক্তার এবং যারা এর লাঠিয়াল হয়ে কাজ করে তখন তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না, বাধা দেয়া তো দূরের কথা। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রতিবাদহীনতার ফলে গোষ্ঠীতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে, নাকি গোষ্ঠীতন্ত্র জেঁকে বসার ফলে প্রতিবাদী হওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে?

এ যেন মুরগি আগে, না ডিম আগে সে রকম এক প্রশ্ন। একটি দেশে কী অবস্থায় বা কী পরিস্থিতিতে গোষ্ঠীতন্ত্র বা ঙষরমধৎপযু পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অনেক ধরনের বিশ্লেষণ করেছেন। তবে এটাও বাস্তব সত্য, ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে একটি দেশে গোষ্ঠীতন্ত্র জেঁকে বসে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদি পুঁজি সঞ্চয়ন করে একটি দুর্বৃত্ত ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে।

এরা দিনে দিনে অর্থবিত্ত সংগ্রহ করে শক্তিমান হয়ে উঠেছে। রাজনীতিতেও এরা হয়ে উঠেছে ক্ষমতাবান। যে রাষ্ট্রে ক্ষমতার জগৎ এবং বিত্তের জগৎ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং এ দুটোকে পৃথক করার কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানে গোষ্ঠীতন্ত্র অনিবার্য হয়ে ওঠে। গোষ্ঠীতন্ত্রের এই অনিবার্যতা আমরা লক্ষ করি সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থ বেড়ে যাওয়া, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার চিন্তাভাবনা করা থেকে। একই কারণে দেখা যায় শেয়ারবাজারে বুদবুদ সৃষ্টি করে হাজার হাজার পুঁজি বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করে ফেলা এবং এর কোনো প্রতিবিধান না হওয়া।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ার ফলে আইনের শাসন কার্যকর করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে অপরাধ নিবর্তনকারী এবং অপরাধের দণ্ডবিধানকারী আইনের অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হল বিদ্যমান আইনগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আইনের গতি তখনই ত্বরান্বিত করা হয় যখন গোষ্ঠীতন্ত্রের ক্ষমতা বহাল রাখার সমস্যা সৃষ্টি হয়।

এ অবস্থায় আরও অধিক কঠোর ও কড়া আইন পাস করে কোনো ফলোদয় হবে না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রাজনৈতিক অঙ্গীকার। একমাত্র রাজনৈতিক অঙ্গীকারই পারে সুশাসন নিশ্চিত করতে। সুশাসনের মূল কথা হল, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। দুর্ভাগ্য হল এ সমাজে দুষ্টরা উদ্ধত, অন্যদিকে শিষ্টরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে শামুকের মতো গুটিয়ে থাকে।
প্রতিবাদের অনেক রকম ভাষা আছে। বেলজিয়াম যখন জার্মানির দখলে চলে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, তখন দখলদারকবলিত বেলজিয়ামে কোনো প্রতিবাদ ছিল না। এ দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও বেলজিয়ামের জনগণ প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছিল। নাজি সৈন্যরা কোনো বেলজিয়ামবাসীকে কোনো জায়গার অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করলে বেলজিয়ামবাসীরা ভান করত তারা জার্মান ভাষা বোঝে না। ফলে নাজি সৈন্যরা অসুবিধায় পড়ত। অথচ বেলজিয়ামের অনেক নাগরিকই জার্মান ভাষা বুঝত এবং বলতে পারত। এই না বোঝার ভান করাটা শত্রুকবলিত বেলজিয়ামে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে যারা গোষ্ঠীতন্ত্রবিরোধী রাজনীতি করেন তারা একটু গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে এ ভীতসন্ত্রস্ত জনপদের উপযোগী প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেতে পারেন। এজন্য তাদের একটু সৃজনশীল হতে হবে। কষ্ট-সহিষ্ণু তো বটেই।

বাংলাদেশে খুন-খারাবি, দখল ও ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ ভয়াবহ রূপে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সমাধান শুধু আইনের শাসন দিয়ে হবে না, প্রয়োজন হবে শৃঙ্খলার শাসন। শৃঙ্খলার শাসনের কথা শুনে কারও কারও মনে রেজিমেন্টেড সোসাইটির ভয় সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটি সে রকম কিছু নয়, সমাজতত্ত্ববিদরা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিষয় নিয়ে ভাবেন। তাদের দৃষ্টিতে এটা হল সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার সমস্যা। কী করে একটি সমাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় তা তাৎক্ষণিকভাবে বোধগম্য নয়। সমাজে বাস করা মানুষগুলো যদি চরিত্রগতভাবে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সমাজ ব্যক্তি মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দার্শনিক হব্স মানব চরিত্র সম্পর্কে ভেবেছিলেন যে, মানুষ স্বভাবজাতভাবেই কলহপ্রবণ ও অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করে। এ কারণেই তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।

সমাজতত্ত্ববিদরা ব্যক্তি ও সমাজকে পৃথকভাবে বিবেচনা করেন না। সমাজবহির্ভূত হলে মানুষের মধ্যে পশুত্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, অন্যদিকে সমাজের মধ্যে থাকলে সমাজের নিয়মগুলো মেনে চলতে হয়। এ নিয়ম মেনে চলার অর্থ পৃথিবীটাকে একটি সুশৃঙ্খল বিশ্ব মনে করা এবং একে অপরের সঙ্গে এ ব্যাপারে মতবিনিময় করতে সক্ষম হওয়া। দ্বিতীয়ত আসছে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। কীভাবে একজনের কর্মকাণ্ড অন্য আরেকজনের কর্মকাণ্ডে সঠিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিফলিত হতে পারে। সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠী বাস করে, একথাটি যেমন সত্য, তার মতোই সত্য হল সমাজের চৌহদ্দিতে কীভাবে তারা একে অপরের সঙ্গে অভিন্ন সামাজিক সীমান্তের মধ্যে অবস্থান করবে এবং তাদের মধ্যকার সব বিরোধ ও বিভক্তিকে ঠেকিয়ে রাখবে। এটাই হল সামাজিক জীবনের ঐক্য ও সংহতির সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান সমাজ নিশ্চিত করে পরিবার, কর্মস্থল, বাজার এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যকার শৃঙ্খলা বজায় রেখে। বাংলাদেশে বহুবিধ কারণ এ শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটে। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন আমাদের সমাজের ওপর একটি কালচারাল শক সৃষ্টি করেছে। এ আঘাত অত্যন্ত প্রবল। কিন্তু এর অভিঘাত থেকে কীভাবে মুক্ত থাকা যায় সে ব্যাপারে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতারা সিরিয়াসলি ভাবছেন কিনা তা মোটেও দৃশ্যমান নয়।

গত সপ্তাহে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। এ কনভোকেশনে আমার কনিষ্ঠ কন্যা আন্তর্জাতিক আইনে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কনভোকেশনের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি বড় অডিটোরিয়ামে। এতে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের মাতা-পিতারাও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এ অনুষ্ঠানের ৩টি বিষয় আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রথমত, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সময় সবার মধ্যে ছিল পবিত্রতার প্রতিচ্ছবি। দ্বিতীয়ত, একপর্যায়ে গ্রাজুয়েটদের পেছন ফিরতে নির্দেশ দেয়া হলো এবং গ্রাজুয়েটরা পেছন ফিরে মস্তক অবনত করে তাদের পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করল। পিতা-মাতারা গ্রাজুয়েটদের পেছনে সারিতেই বসেছিলেন।

এ নতুন গ্রাজুয়েটদের স্পষ্ট বার্তা দেয়া হল তাদের সাফল্যের পেছনে পিতা-মাতার অবদান কত মূল্যবান। তৃতীয়ত, নতুন গ্রাজুয়েটদের শপথবাক্য সমস্বরে পড়ানো হল। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কনভোকেশনে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি দুটো পর্বের কোনো সুযোগ রাখা হয় না। আমরা যদি এটুকু ভাবতে না পারি তাহলে সমাজবদ্ধ দায়িত্বশীল নাগরিক কীভাবে সৃষ্টি হবে? এক কথায় বলতে হয়, আইনের শাসনের সঙ্গে শৃঙ্খলার শাসনের সুসমন্বয় ঘটানো ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি প্রয়োজন গোষ্ঠীতান্ত্রিকতা থেকে উদ্ভূত মানসিকতার অবসান। তবে সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এমন এক বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেবে, যার ফলে গোষ্ঠীতান্ত্রিকতা নিজ থেকেই ভেঙে পড়বে। যেমন, পাকা ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে। একটি দৈনিকে বরগুনার ঘটনা সম্পর্কে শিরোনাম করা হয়েছে ‘বহু অভিযোগ নিয়েও দাপিয়ে বেড়াতো ওরা।’ যে সামাজিক বিশৃঙ্খল পরিবেশে ওরা দাপিয়ে বেড়ায় এবং যেখানে নির্মোহভাবে আইনের প্রয়োগ হয় না, সেই সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ