পলিথিন, গৃহস্থলি পণ্য আর ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ রাজধানীর রামচন্দ্রপুর খাল। ময়লা পচে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। দেখার কেউই নেই! ছবি- মোহাম্মদ জাফর ইকবাল।
২৮ জুন ২০১৯, শুক্রবার, ১:১৩

রাজধানীর খালগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : নবোদয় বাজার। মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন খুবই জমজমাট এই বাজার। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই এলাকাটি। বাজারটির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন খাল রামচন্দ্রপুর খাল। খালের পাশে বহুতল ভবনে ভরা। আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত এই এলাকাটি অনেকের কাছেই বসবাসের জন্য নিরাপদ ও পছন্দের। এখানে যেমন সাধারণ মানুষরা থাকেন তেমনি সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরাও বসবাস করেন। প্রতিনিয়ত এই খালটিকে তারা দেখলেও এটি পরিস্কার করার কোনো উদ্যোগ নেন না। পলিথিন আর ময়লা আবর্জনার কারণে বাজারের পূর্বপাশের অংশটি যে খাল সেটি চেনাই যায়না। পশ্চিমপাশের অংশটিও ময়লায় ভরা। কিছুদিন আগে এই খালে একটি শিশু পড়ে মারা গিয়েছিল। ময়লা আবর্জণার কারণে তার লাশ পেতে বেশ কয়েকদিন লেগেছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ খালই ময়লা আবর্জনায় ভরা। বর্ষাকাল আসার আগে এই খালগুলিকে পরিস্কার করতে দেখা গেলেও এবার যেন ঢিলেঢালা আয়োজন। যার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া সামাণ্য বৃষ্টিতে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কারণ, ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিপূর্ণ থাকায় পানি সরতে পারছেনা। একইসাথে এসব খাল থেকেই মশার জন্ম হচ্ছে। খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার রাখতে দুই মেয়রের দৌড়ঝাঁপও কোনো কাজে আসছে না।

খালেই জীবন, খালেই বিকাশ, খালেই সর্বনাশ। যেসব খাল একসময় স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার উৎস ছিল, খালের দুই কূল ঘেঁষে সৃষ্টি হয়েছিল জনবসতি, নির্বিচারে হত্যার ফলে সেই খালই এখন আধুনিক ঢাকার বাসিন্দাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবহমান খাল দখল করে হয়েছে নগরায়ন। কিন্তু এ নগরীর বিশাল জনগোষ্ঠীর আবর্জনার ভার বয়ে বেড়ানো খালগুলো ধুঁকে ধুঁকে অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর এ নিষ্ঠুর পরিণতি পোহাতে হচ্ছে নগরীর সাধারণ বাসিন্দাদের।

সূত্র মতে, রামচন্দ্রপুল খাল দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা জেলা প্রশাসন কোনও ভূমিকাই রাখতে পারছে না এ ব্যাপারে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি নন। খাল নিয়ে কথা বলার জন্য এ প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন ঢাকা জেলা প্রশাসন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কিন্তু কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। জেলা প্রশাসনের এক সার্ভেয়ার বলেন, রামচন্দ্রপুর খাল নিয়ে আমাদের কাছে নেই। এই খালটি বারবার দখলও হচ্ছে। ২০১২ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে রামচন্দ্রপুর ও কাটাসুর খালের দু’দিকে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়। কিন্তু দখলদাররা এই পিলার উপেক্ষা করেই দখলবাজি অব্যাহত রাখে।

জানা গেছে, রাজধানীর আরেকটি খাল হচ্ছে দোলাইরপাড় খাল। এই খালটিও আবর্জনায় ভরা। যার কারণে সামাণ্য বুষ্টিতেও পানি সরে না। একটু বৃষ্টিতেই আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হয় প্রচন্ড পানিবদ্ধতা। পলিথিন, খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল আর ফলের পরিত্যক্ত ঝুড়িতে ভরপুর এই খাল। সঙ্গে গৃহস্থালি বর্জ্যের স্তূপ। দূর থেকে দেখলে একে খাল ভাবা মুশকিল।

খালে পানি থাকে, সঙ্গে থাকে প্রবাহ। তবে মিরপুর ১৩ নম্বরের বাইশটেকি খালে এর কোনোটাই নেই। সামনে গিয়ে ময়লার ভাগাড় ভেদ করে সামান্য কালো তরল পদার্থ দেখা গেলেও তাকে পানি বলা মুশকিল। স্থানীয় বাসিন্দা লতিফ হাসান জানালেন, এ খাল দিয়ে একসময় মিরপুর ১৩ ও ১৪ নম্বর এলাকার বৃষ্টির পানি নামত। কিন্তু তা এখন ময়লার ভাগাড়। বাইশটেকির মতো একই অবস্থা মিরপুর কালশী সড়কের সাংবাদিক কলোনি-সংলগ্ন রূপনগর খালটিরও। সম্প্রতি এই খালটি সংষ্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিটি কর্পোারেশন বলছে, এটির সংষ্কার কাজ শেষ হলে এই এলাকায় পানিবদ্ধতা থঅকবেনা।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর খালটি অবৈধ দখল ও আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। একটু বৃষ্টিতেই এলাকায় দেখা দেয় পানিবদ্ধতা। ফলে এখানকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। একটু বৃষ্টির পানিতেই আবর্জনা নিয়ে ছুটে চলা ড্রেন আর স্যুয়ারেজগুলো ফুলে ফেঁপে টইটুম্বুর হয়ে উঠছে। পানি অপসারণের যোগ্যতাও হারিয়েছে ওগুলো। লাইনের মুখগুলো গিয়ে পড়েছে তথাকথিত কোনো না কোনো খালে। সেসব খালই এখন হয়তো মরা, না হয় আবর্জনার ভিড়ে স্রোতহীন। ফলে ঢাকাবাসীকে বর্জ্য আর পানিবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়ার মতো আর কোনো মাধ্যম অবশিষ্ট নেই।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, খালগুলো উন্মুক্ত করা না গেলে আর সেগুলো দিয়ে বৃষ্টি ও স্যুয়ারেজের পানি নদীতে না পড়লে এ ঢাকা বসবাস অনুপযোগী হতে বেশি দিন লাগবে না। শুধু স্থায়ী পানিবদ্ধতা নয়, বাসাবাড়িতেও টয়লেটের কমোড-প্যান দিয়ে ময়লা ফুলে-ফেঁপে উঠবে। অর্থাৎ নির্গমন পথ বন্ধ হওয়ায় প্রচ- চাপ সৃষ্টি হবে এবং

এসব লিকুইড ও সেমি সলিড বর্জ্য ফেরত আসবে। ফলে মানুষ আর ঘরে বসবাস করতে পারবে না।
ঢাকা ওয়াসার হিসাবেই নগরীতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫৪টি খালের অস্তিত্ব ছিল। বেশিরভাগ খালের সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া চারটি নদীর সঙ্গে। ২০০০ সালের জুলাই মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় রাজধানীতে খাল ছিল ৪৪টি। বর্তমান হিসাব মতে রাজধানীতে ৩৫টি খাল শুকিয়ে গেছে বা দখল হয়ে গেছে। তবে একাধিক প্রতিবেদনে রাজধানীতে ৫৮টি খালের কথা বলা হয়েছে। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ঢাকা ওয়াসার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে দেখা যায় খালের সংখ্যা ৩২। বর্তমানে এর ১৯টি আছে শুধু নকশায়, বাস্তবে নেই। বাকি ১৩টি খালের প্রস্থ ১০ ফুটের বেশি নয়। প্রতি বছর মে-জুন মাস তথা বর্ষা মওসুম শুরুর আগে কোটি টাকা খরচ করে খাল পুনরুদ্ধার এবং অবৈধ দখলের কাজ করা হয়। কিন্তু সুষ্ঠু তদারকির অভাবে বছর না যেতেই সেগুলো আবার দখলে চলে যায়।

ঢাকা ওয়াসার হিসাব মতে, বেঁচে থাকা খালের অবস্থাও করুণ। স্বাধীনতার পর মাত্র চার যুগের ব্যবধানে ঢাকা মহানগরীর অনেক খাল বিলুপ্ত হয়েছে। যেগুলো রয়েছে তার বেশির ভাগই সঙ্কুচিত হয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। তার ওপর গৃহস্থালির ধরনের আবর্জনা থেকে পয়ঃবর্জ্য, পলিথিন, ট্যানারি ও শিল্প বর্জ্য নিক্ষেপের প্রধান স্থান এসব খাল। এ ছাড়াও খালগুলো ময়লা দিয়ে ভরাট করে নির্মিত হয়েছে সরকারি রাস্তা, বিশাল বিশাল অট্টালিকা, স্কুল, মসজিদ ও প্রভাবশালীদের আবাসন প্রকল্প। অদূরদর্শিতা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে উপো করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও কিছু মানুষ ব্যক্তিগত মুনাফার চিন্তায় খালগুলো ভরাট করে রাজধানীর পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

তবে হুমকির মুখেও বেঁচে থাকা খালের মধ্যে মহাখালী, বাসাবো, বেগুনবাড়ি, কল্যাণপুর, গুলশান-বনানী, কাটাশুর, ইব্রাহিমপুর, আবদুল্লাহপুর, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ি, শাহজাহানপুর খাল উল্লেখযোগ্য। সচিবালয় ও প্রেস কাব এলাকা, ফকিরেরপুল, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী, কাকরাইল, বিজয়নগর, আরামবাগ, কমলাপুর প্রভৃতি এলাকার পানি সেগুনবাগিচা খাল দিয়ে নিষ্কাশিত হতো, যা এখন শুধু ইতিহাস। কালের পরিক্রমায় সেগুনবাগিচা খালের অস্তিত্ব শুধু বিলুপ্তই হয়নি, সেখানে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল দালানকোঠা। রমনা খালের ৮০ শতাংশই এখন স্মৃতি।

সূত্র মতে, বেশ কয়েকবার পৃথিবীর অপরিচ্ছন্ন নগরীর খেতাব পেয়েছে ঢাকা। এ ছাড়াও বসবাস অনুপযোগিতার তালিকারও শীর্ষে এ শহর। দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলেছে, স্বপ্নের ঢাকা এখন এখানকার নাগরিকদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। পানিজট, যানজট, পরিবেশ বিপর্যয়, শব্দদূষণসহ ১১৭ ধরনের সমস্যায় জর্জরিত এ শহরের বাসিন্দারা। শুধু জীবিকার তাগিদেই ৯০ শতাংশ মানুষ ঢাকায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী খালও আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। ফলে পুরো এলাকার পানি নিষ্কাশনের এ খালটি অনেকের কাছে মশা উৎপাদনের ‘কারখানা’ হিসেবে পরিচিত। মশার উৎপাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা অন্যান্য খালগুলোরও। ডোবা, নালা ও খাল নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেখানে মশার প্রজনন বেশি হচ্ছে। জানা যায়, রাজধানীর খাল, লেক, ডোবা-নালা, পুকুর ও জলাশয় পরিষ্কার করার দায়িত্ব হলো ঢাকা ওয়াসা, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের। কিন্তু তারা একে অপরের এক দায়িত্ব দিয়েই নিজেদের দায় সারছে।

জানা যায়, রাজধানীর খাল গুলোর মধ্যে বেশির ভাগ ঢাকা ওয়াসা তত্ত্বাবধান করে থাকে। বেশ কয়েকটি খালের মালিকানা ঢাকা জেলা প্রশাসনের। ঢাকা ওয়াসা নিয়মিত সেগুলো পরিষ্কার করে না। বরাদ্দ পেলে মাঝে মধ্যে কচুরিপানা ও কিছু কঠিন বর্জ্য পরিষ্কার করে ওয়াসা। ইব্রাহিমপুর খাল একসময় এলাকার পানি নিষ্কাশনের কাজ করলেও এখন খালটিতে ময়লা পানির ওপর শুধু মশা আর মশা চোখে পড়ে।

খাল পরিস্কার প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, রাজধানীর খালগুলোর সংস্কার ও পরিস্কার রাখার বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগের থেকে অবৈধ স্থাপনা ও ময়লা কমে গেছে। তারপরও আমরা আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখছি। তিনি বলেন, আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন জনগণ যদি সচেতন না হয় তাহলে খালগুলোর অস্তিস্ত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ গৃহস্থালির ময়লা, পলিথিন সহ অন্যান্য বজ্যগুলো প্রায়শ সবাই খালের মধ্যেই ফেলে দেয়। এটিকে কেন জানি সবাই নিরাপদ মনে করে। এই অভ্যাসটি একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের ত্যাগ করতে হবে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, দখলদাররা খালগুলোকে পৈতৃক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করছে। খালের ওপর ঘর তুলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। রুটির দোকান, লাইব্রেরি, অটোমোবাইল দোকান, চায়ের দোকান, জুতা ও ইলেট্রনিকসের দোকান, ফার্নিচারের দোকান, ব্যবসায়িক চেম্বার, মুদির দোকান, ভান্ডারীর দোকান, টেইলার্স, সবজির দোকান, কাপড়ের দোকান, চটপটির দোকান, সবজির দোকান, গ্যারেজ, পিঠার দোকান, মসজিদ, গ্রিলের দোকান, ডেকোরেটর, মুরগির দোকান, ফার্মেসি, পানের দোকান, মাছের দোকান, ফলের দোকান, মাংসের দোকান, মহিলা ক্লাব, জাতীয় পার্টির কার্যালয়, যুবসংঘের অফিস, ক্রীড়া সংঘসহ এমন কিছু নেই যা গড়ে তোলা হয়নি। মাঝেমাঝে অভিয়ানে এসব স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হলেও কিছুদিনের মধ্যে আবারো সেইসব স্থাপনা তৈরি হয়ে যায়।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমাদের খাল দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত রাখতে কঠোর আইনের প্রয়োগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। খালগুলো পরিষ্কার করে পুরো শহরের চেহারা পরিবর্তন করা সম্ভব। হাতিরঝিলের দিকে তাকালেই আমরা তা দেখতে পারি। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, খালগুলো দেখিয়ে ওয়াসা শুধু বিদেশ থেকে অর্থ আনে। আর কী কাজে খরচ করে তারাই জানে। বৃষ্টি হলে নগরবাসী পানিবদ্ধতায় হাবুডুবু খায়। সার্বিকভাবে খাল ঠিক রাখতে হলে তা সিটি করপোরেশনকে দিয়ে তাদের সব ধরনের সাপোর্ট দিতে হবে।

https://www.dailysangram.com/post/380949