রেললাইনের নাটবল্টু ক্লিপ হুক ফিশপ্লেট খোলা
২৯ জুন ২০১৯, শনিবার, ৭:৪০

রেললাইন যেন ‘মৃত্যুফাঁদ’: নাটবল্টু ক্লিপ হুক ফিশপ্লেট খোলা!

৩০০৬টি রেলসেতুর মধ্যে ৯০ শতাংশই ব্রিটিশ আমলের * লাইন সংস্কার, মেরামত ও পরিদর্শনে এক রকম নির্বিকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা

রেলওয়ে উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতার কমতি নেই। নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। চলমান আছে অর্ধশত প্রকল্প। সেই সঙ্গে আছে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনাও। এরই অংশ হিসেবে হাতে নেয়া হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দ্রুতগতিসম্পন্ন বুলেট ও বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনার।

আর প্রতি বছরই বিভিন্ন রুটে নামছে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন। কিন্তু সবকিছুই এক রকম নিষ্ফল করে দিচ্ছে জরাজীর্ণ রেললাইন। যে পথ দিয়ে ট্রেন চলাচল করে সেই রেলপথ দেখার যেন কেউ নেই। রেললাইন সংস্কার, মেরামত ও পরিদর্শনে এক রকম নির্বিকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

সরেজমিনসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রায় ৩ হাজার ৩৩৩ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময়ই খোলা থাকে ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাটবল্টুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। এমনকি রেললাইন মজবুত ও স্থিতিশীল রাখতে স্থাপিত স্লিপারগুলোর অবস্থাও নাজুক।

আবার এসব স্লিপারকে যথাস্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর থাকা প্রয়োজন, অধিকাংশ স্থানেই তা নেই। কোনো কোনো স্থানে পাথরশূন্য অবস্থায় আছে স্লিপারগুলো।

শুধু তাই নয়, সারা দেশে আছে ৩০০৬টি রেলসেতু। যার ৯০ শতাংশই তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে সচল রাখা হয়েছে সেতুগুলো। এগুলোর ওপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিভিন্ন রুটের ট্রেন। সব মিলিয়ে এক রকম ‘মৃত্যুফাঁদ’-এ পরিণত হয়েছে গোটা রেলপথ।

জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব রেললাইন ও সেতু সংস্কার এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে কুলাউড়ার মতো ফের বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর কিছু সময়ের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে দায়িত্বপ্রাপ্তরা। নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। গঠন করা হয় একের পর এক তদন্ত কমিটি। কিন্তু অধিকাংশ কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না।

আবার যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেগুলোর সুপারিশমালার বেশির ভাগই থাকে অবাস্তবায়িত। সম্প্রতি কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু ও লাইন বর্ষার আগেই সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এ নির্দেশের পরও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

জানতে চাইলে রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রেলপথ সংস্কার এবং যথাযথ মেরামত রাখা যাদের দায়িত্ব, তারা যদি দায়িত্বে কোনো গাফিলতি করেন, সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি কারও দায়িত্বে অবহেলার জন্য লাইনচ্যুত কিংবা দুর্ঘটনা ঘটে, তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা মাঠ পর্যায়ে তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, পুরনো লাইন সংস্কারসহ নতুন লাইন স্থাপন করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করছে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। লাইনের ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা আশা করছি, এমন পরিস্থিতি থাকবে না।

এক প্রশ্নের উত্তরে রেলসচিব বলেন, রেলপথে নাটবল্টু, ক্লিপ-হুক কিংবা ফিশপ্লেট কিছুতেই খোলা থাকতে পারে না। এটা নিশ্চয় সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।

খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রেলপথে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। ৯০ শতাংশ ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে শুধু লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকায়।

একই সঙ্গে লাইনে ভাঙা স্লিপার, ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেট না থাকাও এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। রেলে ব্রিটিশ আমলের রেলওয়ে ব্রিজ রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। এসব ব্রিজের স্লিপার জরাজীর্ণ, লাইনে নেই ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেটও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোথাও কোথায় বাঁশ দিয়ে মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন রেলসেতু। পুরো রেলপথে প্রতি বছর ২২ লাখ ঘনফুট পাথর প্রয়োজন হলেও দেয়া হচ্ছে ১০ থেকে ১২ লাখ ঘনফুট পাথর।

পুরো রেলপথে পূর্ণমাত্রায় পাথর দিতে এক বছরে খরচ হয় ৩৩ কোটি টাকা। সেখানে রেলওয়ের লাইনচ্যুতে বগি ও ইঞ্জিন উদ্ধার এবং লাইন মেরামতে প্রতি মাসেই খরচ করছে ৮ কোটি টাকারও বেশি। বছরে যা দাঁড়ায় শত কোটি টাকায়।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে পাথরবিহীন লাইন, নাটবোল্টু, ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেট খোলা অবস্থায় স্লিপার ও লোহার লাইন রয়েছে। লাইন জুড়ে অসংখ্য স্লিপার ভাঙা এবং নাটবোল্টু, ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেট খোলা অবস্থায় আছে।

জরাজীর্ণ স্লিপার ও খোলা স্থানগুলো মাসের পর মাস ধরে যে সংস্কার হচ্ছে না- তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। লাইনে নির্ধারিত দূরত্বের মধ্যে (প্রায় ৪০-৫০ ফুট) পয়েন্ট রয়েছে। এসব পয়েন্টের মধ্যে দু’পাশে ৮টি করে মোট ১৬টি নাটবোল্টুসহ ১৬টি হুক-ক্লিপ থাকার কথা।

কিন্তু দেখা গেছে অধিকাংশ পয়েন্টের মধ্যে ১৬টির স্থলে ৫-৭টি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ পয়েন্টগুলো খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। ফেটে গেছে স্লিপারগুলো।

আরও দেখা গেছে, খিলগাঁও রেলগেট থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত অধিকাংশ লাইনের পয়েন্ট (জোড়ার স্থল) নাটবোল্টু খোলা রয়েছে। এসব পয়েন্ট দিয়ে যখন ট্রেন চলাচল করে তখন শোনা গেছে বিকট শব্দ।

আর অধিকাংশ স্লিপারের সঙ্গে লাইনটি লাগানো নয়। ক্লিপ খোলা!। ফিশপ্লেট খোলা। হুক খোলা। কোথাও কোথাও কিছু পাথর আছে। আবার কোথাও একেবারেই পাথর নেই। পাথর না থাকায় অনেক জায়গায় পানি জমে আছে।

লাইনে পানি থাকার বিষয়ে একাধিক ট্রেনচালক বলেন, পাথরবিহীন লাইন আর নাটবোল্টু, ক্লিপ-হুকবিহীন লাইনে ট্রেন পৌঁছতেই ঝাঁকুনি শুরু হয়। এসব স্থানেই ট্রেন সবচেয়ে বেশি লাইনচ্যুত হয়।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলপথ দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। নাটবোল্টু, হুক-ক্লিপ-ফিশপ্লেট ও পাথর চুরি হচ্ছে। পুরো রেলওয়েতে প্রায় ৮০টি সেকশন রয়েছে। এসব সেকশনে রেললাইন দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে স্থায়ী রেলপথ পরিদর্শক (পিডব্লিউআই)। যাদের তত্ত্বাবধানে থাকে ওয়েম্যান।

ওয়েম্যানরাই মূলত লাইন রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কিন্তু ওয়েম্যানসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। ৮ জন ওয়েম্যান একত্রিত হয়ে একটি গ্যাংক করা হয়। একেকটি গ্যাংক ৫ থেকে ৮ কিলোমিটার রেলপথ প্রতিদিন দেখাশোনার কথা।

বর্তমানে প্রতি গ্যাংকে ১-২ জন ওয়েম্যান রয়েছে। কোনো কোনো সেকশন গ্যাংকে ওয়েম্যানই নেই। ফলে দিনের পর দিন রক্ষণাবেক্ষণ হয় না রেললাইন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক প্রকৌশলী জানান, পুরো রেলে হাজার হাজার স্লিপার জরাজীর্ণ রয়েছে। নাটবোল্টু, হুক-ক্লিপ, ফিশপ্লেট খোলা অবস্থায় রয়েছে পদে পদে। এসব মেরামত কিংবা পূরণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাথাব্যথা নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তথা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ শুধু প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। মাঠ পর্যায়ে যে কাজের স্বল্পতা রয়েছে সেদিকে খেয়ালই নেই।

তিনি বলেন, নিয়মানুসারে একটি স্পিপার কিংবা নাটবোল্টু, ক্লিপ-হুক-ফিশপ্লেট খোলা থাকলে প্রয়োজনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে হলেও তা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই নাটবোল্টু, হুক-ক্লিপ-ফিশপ্লেট খোলা থাকতে পারে না। ওয়েম্যানরা প্রতিদিন লাইন পরিদর্শন করবে, এমন ত্রুটি দেখা মাত্রই তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবে এবং সেই সমস্যা সমাধান করবে। রেলে এ নিয়মটাই নেই!

পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল এ দুই অঞ্চল নিয়ে রেলওয়ে। উভয় অঞ্চলে রেলপথের অবস্থা জরাজীর্ণ রয়েছে। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছরে যেসব ওয়েম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা মাঠে কাজ করতে চায় না। তাদের কিছু বলাও যায় না।

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গালমন্দ পর্যন্ত তারা করছে। একই অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমাঞ্চলে কর্মরত ওয়েম্যানদের বেলায়ও। মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মচারীর কেউ কেউ আবার রেলের বিভিন্ন অফিস ও কর্মকর্তাদের বাসায় কাজ করছেন।

ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা থেকে-সিলেট, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ও যমুনা সেতু পর্যন্ত লাইনের সমস্যা ও ত্রুটিগুলোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাজারও বার বলা হয়েছে, কিন্তু কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনও নেয়া হচ্ছে না। লাখ লাখ নাটবোল্টু-ক্লিপ-ফিশপ্লেট খোলা রয়েছে এ পথে। দিন দিন আরও খুলছে, এতে ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রহনপুরসহ এ অঞ্চলের সিঙ্গেল রেলপথ ৬শ’ ৬৭ কিলোমিটার। প্রায়ই এ রুটে লাইনচ্যুত হয় মালবাহী অথবা যাত্রীবাহী ট্রেন। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকে রেল চলাচল। যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এ পথে অধিকাংশ স্থানে নেই নুড়ি পাথর। দুর্বল স্লিপার, ক্ষয়ের কারণে নড়বড়ে লাইনের পাত। বছরের পর বছর নাটবল্টু খোলা থাকলেও তা সংস্কার করা হচ্ছে না।

একই চিত্র এ অঞ্চলের শাখা লাইনগুলোতেও। পাথরের অভাব, লাইন ক্ষয়, নষ্ট স্লিপারসহ নানা কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। অন্যদিকে চালকরা বলছেন, এ পথে ট্রেন বাড়লেও বাড়ছে না গতি। একই অবস্থা ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ, ঢাকা-ময়মনসিংহ লাইনেও। লাইনের এমন অবস্থায় কোনো ট্রেনই যথাযথ গতি নিয়ে চলতে পারে না। ফলে ট্রেন সিডিউল বিপর্যয় লেগেই আছে।

রেলওয়ে মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জরাজীর্ণ রেলপথের জন্য। লাইন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এ লাইনই যদি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে, ত্রুটি থাকে তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। পুরো রেলে একটি হুক-ক্লিপ কিংবা ফিশপ্লেট খোলা থাকলেও সেটি মারাত্মক ঝুঁকি।

পুরো রেলওয়েতে যেসব সেকশনে এমন অবস্থা পাওয়া যাবে, সেই সব সেকশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো অবস্থায়ই একটি লাইনে স্লিপার নষ্ট কিংবা ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেট খোলা থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে। তা যত দ্রুত সম্ভব মেরামত করা হবে।

যুগান্তরের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি হোসাইন আহমেদ জানিয়েছেন, মৌলভীবাজার-আখাউড়ায় রেললাইন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রেলপথ থেকে অব্যাহতভাবে চুরি হচ্ছে ক্লিপ-হুক। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় উপবন ট্রেন দুর্ঘটনার পর রেলের গাফিলতি ও ক্লিপ-হুক চুরির ঘটনা ধরা পড়েছে।

ভানুগাছ রেলস্টেশন সংলগ্ন গোপালনগর রেলগেটের মাত্র ৫শ’ মিটারের মধ্যে পাতের সঙ্গে ৪১২টি ক্লিপ নেই। এ রকম হাজারও ক্লিপ চুরি হয়েছে কিন্তু দেখার কেউ নেই। ফলে ট্রেন চলাচলের সময় যে কোনো মুহূর্তে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে সিলেট বিভাগের ১৭৩ কিলোমিটার দেখভাল করার জন্য সরকারিভাবে ২৯ জন ওয়েম্যান নিয়োজিত আছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মাস শেষে নিয়োজিত ওয়েম্যানরা ঠিকই বেতন নিচ্ছেন। কিন্তু একজনই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেননি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

মৌলভীবাজার-আখাউড়ায় আন্তঃনগর, লোকাল ও মালবাহী মিলিয়ে প্রায় ১০-১২টি ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করছে। রেল বিভাগের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দেশের অন্যতম পুরনো রেলপথ সিলেট-আখাউড়া। এখন অনেকটাই নড়বড়ে রেল সেতু ও লাইন। দ্রুত মেরামত কিংবা নির্মাণ না হলে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

সিলেট-আখাউড়া রেলপথের ১৭৩ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২৫-৩০টি সেতু ও কালভার্ট চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভানুগাছের গোপালনগর ও ফাজিলপুর এলাকার ৩০২/৭নং পিলার পর্যন্ত দু’ধারে প্রায় ৪১৬টি ক্লিপ-হুক নেই। দু’লাইনের জোড়া দেয়া স্থানেও ক্লিপ চুরি হয়ে গেছে।

দিনের পর দিন ক্লিপ-হুক, নাটবল্টু ও ফিশপ্লেট চুরি হয়ে যাওয়ায় সেকশনটি অধিকতর ঝুঁকির মুখে পড়েছে। চুরি হওয়া এসব যন্ত্রাংশ দ্রুত লাগানোর নিয়ম থাকলেও বছরের পর বছর তা লাগানো হচ্ছে না। দ্রুত রেলপথের কল, ক্লিপ ও নাট লাগানোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

সম্প্রতি সিলেট-আখাউড়া রেললাইনে বেড়ে চলা দুর্ঘটনায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন এ অঞ্চলের যাত্রীরা। সিলেটবাসীর জোর দাবি, দ্রুত এই জরাজীর্ণ রেললাইনটির (সার্বিক) সংস্কার।

রেলপথ সিলেট বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আহসান জাবিদ যুগান্তরকে বলেন, রেলপথের মেরামত ধারাবাহিক প্রসেস। এক বছর করলে যে শেষ হয়ে যাবে এমন না। তবে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

গৌরীপুর প্রতিনিধি মো. রইছ উদ্দিন জানান, কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনার পর এবার সারা দেশের ন্যায় ময়মনসিংহের গৌরীপুরেও সাধারণ যাত্রী ও সচেতন মহল রেলপথের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। রেলওয়ে জংশনের ২নং রেললাইনে মিলেছে কাপড়ে বাঁধা নাটবল্টু! জোড়ায় জোড়ায় নেই নাট, ফিশপ্লেট ও স্লিপারে নেই নাটবল্টু ও হুক। পাথরবিহীন অধিকাংশ রেলপথ।

এ জংশনের সঙ্গে গৌরীপুর-চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ঝারিয়া ও মোহনগঞ্জ চার রেলপথের মোহনা। গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনের ৪টি রেলপথে প্রতিদিন আন্তঃনগর, লোকাল, কমিউটার ও মেইল ট্রেনসহ ৩২ ট্রেন আসা-যাওয়া করে। স্টেশনের প্লাটফর্মে ট্রেন চলাচলের জন্য ৫টি পৃথক লাইন রয়েছে। কিন্তু ২টি রেললাইন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় ৩টি রেললাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করে।

প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শুধু ময়মনসিংহের গৌরীপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম সীমানায় ট্রেন চলাচলের ৪টি রেললাইনের এ অবস্থা। তবে স্থানীয়রা জানান, প্লাটফর্ম সীমানার বাইরেও রেললাইনের অনেক স্থানে পর্যাপ্ত পাথর ও ফিশপ্লেটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নাটবল্টু না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। ফলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম মিন্টু বলেন, রেললাইনের ফিশপ্লেটের নাটবল্টু, হুক, ক্লিপ পুরনো হয়ে যাওয়ায় ট্রেন চলাচলে খসে পড়ে যায়। অনেক সময় আবার চুরিও হয়।

দুর্ঘটনা এড়াতে দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। নয়তো কুলাউড়ার মতো এখানেও ট্রেন দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

গৌরীপুর রেলস্টেশন মাস্টার আবদুর রশিদ বলেন, রেললাইনের ফিশপ্লেটে ৪টি নাটবল্টু থাকে। ৩টি থাকলে ট্রেন চলাচল করতে বড় রকমের ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু ২টি থাকলে ঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু এই সেক্টরটা আমার আওতাধীন নয়, এটা রেলওয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ দেখভাল করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৌরীপুর রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, রেলওয়ের এই ত্রুটিগুলো সংস্কার ও রেললাইন মেরামত করার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/193091