২৯ জুন ২০১৯, শনিবার, ৭:৩৭

নৌপথে দেদার রাজস্ব ফাঁকি

নৌ-সেক্টরে চলছে রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসব। ট্রিপ (যাত্রা) ও ধারণক্ষমতা কম দেখিয়ে সরকারের আয়কর (ট্যাক্স) কম দিচ্ছেন লঞ্চ মালিকেরা। আবার শীতাতপ (এসি) নিয়ন্ত্রিত কেবিনের নির্ধারিত ভ্যাট (মূসক) পরিশোধ করছেন না তারা। এতে নৌ সেক্টর থেকে সরকার প্রায় শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১০০ দোতলা ও তিনতলা লঞ্চ রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধশত রয়েছে অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল। আর এসব লঞ্চে রয়েছে বিলাসবহুল ভিআইপি, ফ্যামিলিবেড ও ডিলাক্স, সিঙ্গেল ও ডাবল বেডের এসি কেবিন। সরকার রেল, বাস, লঞ্চ ও স্টিমারের এসি কেবিনে শতকরা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করেছে। কিন্তু অসাধু লঞ্চ মালিকেরা তা দিচ্ছেন না। এসব বিলাসবহুল লঞ্চে অনেক তদবির করেও কেবিন পাওয়া যায় না। তবুও ভাড়া হচ্ছে না এবং নিয়মিত ট্রিপ হচ্ছে না দেখিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন মালিকেরা।
জানা গেছে, এমভি পূবালী-৫ লঞ্চে ১২টি সাধারণ এসি, ২টি ফ্যামিলি বেড ও ২টি ভিআইপি কেবিন রয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময় আসা-যাওয়া মিলিয়ে গড়ে প্রতি মাসে ২০টি ট্রিপ দেয় লঞ্চটি। ঢাকা-গলাচিপার দূরত্ব ২৪৯ কিলোমিটার। ডেকের প্রতি যাত্রীর ভাড়া ৩৭৯ টাকা। কেবিনের একজন যাত্রীর ভাড়া ডেকের চারগুণ নির্ধারণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। সে হিসাবে গলাচিপা রুটের একজন কেবিন যাত্রীর ভাড়া এক হাজার ৫১৬ টাকা। আর এসিপ্রতি যাত্রীর ভ্যাট আসে ২২৭ টাকা। এ হিসাবে ভিআইপি ও ফ্যামিলি বেডসহ পূবালী লঞ্চের এসি কেবিনের প্রতি ট্রিপে ৫ হাজার ৪২৪ টাকা ভ্যাট দেয়ার কথা। আর আসা-যাওয়া নিয়ে প্রতি মাসে ২০টি ট্রিপ দিলে ভ্যাট আসে এক লাখ ৮ হাজার ৪৮০ টাকা। কিন্তু পূবালী লঞ্চ প্রতি মাসে ভ্যাট দেয় মাত্র ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা। একইভাবে এমভি বাগেরহাট লঞ্চে ৪টি ভিআইপি, ২টি ফ্যামিলি, ৩টি ডিলাক্স ও ১২টি এসি কেবিন। এ হিসাবে মাসে ভ্যাট আসে ১ এক লাখ ৬৩ হাজার ৯৮০ টাকা। কিন্তু মাসে ভ্যাট দেয় ১২ হাজার টাকা। একইভাবে আসা-যাওয়া লঞ্চ ভিআইপি, ফ্যামিলি বেড, ডিলাক্স ও সাধারণ এসি কেবিনের জন্য মাসে ভ্যাট দিচ্ছে মাত্র ১৩ হাজার টাকা। ঢাকা-পটুয়াখালী রুটের (লাইনের) এআর খান লঞ্চে ৪টি ভিআইপি, ৪টি ফ্যামিলি, ডিলাক্স ৪টি ও ২২টি সাধারণ এসি কেবিন রয়েছে। ঢাকা-পটুয়াখালীর দূরত্ব ২৫২ কিলোমিটার। এ হিসাবে একজন ডেক যাত্রীর ভাড়া ৩৮৩ টাকা। ভিআইপি কেবিনের ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা, ফ্যামিলি বেডের ভাড়া তিন হাজার টাকা, ডিলাক্স কেবিনের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা ও এসি সাধারণ কেবিনের ভাড়া এক হাজার টাকা। এ হিসাবে মাসে দুই লাখ ৪৪০ টাকা ভ্যাট আসে। কিন্তু এআর খান লঞ্চ মাসে ভ্যাট দেয় ১৩ হাজার টাকা। একই রুটের সুন্দরবন-৯, সুন্দরবন-৭, এমভি কাজল, এমভি জামাল-৫, এমভি সত্তার খান, এমভি আওলাদ ভ্যাট বাবদ মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা জমা দিচ্ছে। একইভাবে ঢাকা-চরফ্যাশন রুটের এমভি কর্ণফুলী লঞ্চের ১১৮ সিট এসি এবং ৬টি ভিআইপি কেবিন রয়েছে। ঢাকা-চরফ্যাসনের দূরত্ব ২৪৬ কিলোমিটার। একজন ডেকের যাত্রীর ভাড়া ৩৭৪ টাকা। এ হিসাবে একজন এসি কেবিনের যাত্রীর ভাড়া ১,৪৯৬ টাকা, ভিআইপি কেবিনের ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। আসা-যাওয়া নিয়ে প্রতি মাসে ২০ ট্রিপ হলে মাসে ভ্যাট আসে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৫৮০ টাকা। কিন্তু প্রতি মাসে ভ্যাট দেয় ১৫ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, একইভাবে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে বরিশাল রুটের এমভি টিপু-৭, এমভি সুরভি-৮, এমভি সুরভি-৯, এমভি পারাবত-১২, এমভি পারাবত-১০, এমভি সুন্দরবন-৮, সুন্দরবন-১০, সুন্দরবন-১১, এমভি মানামি, এমভি অ্যাডভেঞ্চার-১, এমভি কীর্তনখোলা-১০, এমভি ফারহান-৮, এমভি দ্বীপরাজ, এমভি কালাম খান; ঢাকা-ভোলা রুটের গ্লোরি অব শ্রীনগর, দৌলতখান রুটের এমভি তাসরিফ-৩সহ প্রায় ৪০টি লঞ্চে এসি কেবিন থাকলেও ভ্যাট কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে বছরে অর্ধশত কোটি টাকা ভ্যাট ফঁকি দিচ্ছে।

তবে ভ্যাট আদায়ে অনিয়মের ব্যাপারে সদরঘাট আরমানিটোলা সার্কেল (ভ্যাট) সুপার মনসুর আলী মিয়া বলেন, লঞ্চ মালিকেরা অনেক ক্ষমতাধর। এ ছাড়া বাসের নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে উঠতে হয় বলে কতজন যাত্রী নিচ্ছেন তা নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু লঞ্চে টিকিট কাটে ঘাট থেকে ছাড়ার অনেক পরে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ্যাট নির্ধারণ করতে নদীতে যাওয়া সম্ভব নয়। যে কারণে মালিকদের ইচ্ছাতেই ভ্যাট আদায় করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

ধারণক্ষমতা কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন-১১ লঞ্চের দৈর্ঘ্য ২৯০ ফুট ও প্রস্থ ৪৫ ফুট, যাত্রী ধারণক্ষমতা এক হাজার ৯১ জন। সুন্দরবন-১০, লঞ্চের দৈর্ঘ্য ২৯৫ দশমিক ২ ফুট ও প্রস্থ ৪৮ দশমিক ৪৪ ফুট, যাত্রী ধারণক্ষমতা দেখানো হয়েছে ৯৪৪ জন। সুরভী-৯, দৈর্ঘ্য ২৯৫ দশমিক ২ ফুট ও প্রস্থ ৪৭ দশমিক ৪৪ ফুট। কিন্তু যাত্রী ধারণক্ষমতা দেখানো হয়েছে এক হাজার ২৭৪ জন। অ্যাডভেঞ্চার-১ লঞ্চের দৈর্ঘ্য ২৫২ দশমিক ৪৬ ফুট ও প্রস্থ ৪১ দশমিক ৯৮ ফুট, যাত্রী ধারণক্ষমতা দেখানো হয়েছে ৭০০ জন। কীর্তনখোলা-১০ দৈর্ঘ্য ২৯৫ দশমিক ৫২ ফুট ও প্রস্থ ৫০ দশমিক ২ ফুট, ধারণক্ষমতা দেখানো হয়েছে এক হাজার ২০ জন। এভাবে ছোট-বড় সব লঞ্চ ধারণক্ষমতা কম দেখিয়ে আয়কর কম দিচ্ছেন মালিকেরা। অথচ কাগজেকলমে যাত্রী ধারণক্ষমতা কম দেখালেও দুই ঈদ ছাড়াও সাপ্তাহিক ছুটির সাথে একদিন বেশি ছুটি হলে দুই থেকে তিন হাজার যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে লঞ্চগুলোতে। নৌ-পরিবহনের অসাধু জাহাজ জরিপকারকদের সাথে যোগসাজশে লঞ্চে ধারণক্ষমতা কম দেখানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

আয়কর ও ভ্যাট ফাঁকির নানা কৌশল
আয়কর ও ভ্যাট ফাঁকি দিতে কম যাত্রী পরিবহন ও এসি, ননএসি কেবিন খালি দেখানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছেন লঞ্চ মালিকেরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, লঞ্চ মালিকদের নিয়ন্ত্রেণে আনা এবং অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধ করার জন্য বাসের মতো সদরঘাট থেকে টিকিট কেটে লঞ্চে যাত্রী ওঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। এ জন্য সদরঘাট টার্মিনাল ভবনের মধ্যে প্রত্যেক লঞ্চ মালিকদের কাউন্টার করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মালিকেরা কাউন্টার নিলেও সেখান থেকে টিকিট বিক্রি করছেন না। গত ঈদুল ফিতরের সময় ঘোষণা দিয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রি নিয়ে নানা টালবাহানা করেছেন মালিকেরা। শেষ পর্যন্ত কাউন্টারে টিকিট বিক্রি না করেই নিজেদের ইচ্ছে মতো কেবিনের টিকিট দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি করেছেন তারা। এমনকি লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী তুলে ডেকের ভাড়াও দেড় থেকে দুই গুণ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে লঞ্চ মালিকদের বিরুদ্ধে। অথচ মালিকেরা খুব কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছেন বলে আয়কর বিভাগ ও ভ্যাট অফিসে কাজপত্র জমা দিচ্ছেন।

পয়লা জুলাই থেকে কমছে ভ্যাটের হার
যাত্রী সেবার মান না বাড়লেও লঞ্চের এসি কেবিনের ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী পয়লা জুলাই থেকে নতুন নির্ধারিত এ ভ্যাট কার্যকর হচ্ছে। এতে লঞ্চ মালিকদের ভ্যাট ফাঁকির আরো সুযোগ বাড়ল বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার কার্যকরী সহসভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, দুই ঈদের সময় ছাড়া যাত্রী খুব কম হয়। তাই ঈদের ভিড় দেখে শুল্ক নির্ধারণ করলে হবে না। এ ছাড়া লঞ্চ মালিকেরা কেউ শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন না বলে দাবি করেন তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/421249