২৯ জুন ২০১৯, শনিবার, ৭:৩২

খেলাপি সংস্কৃতির অবসানে যা প্রয়োজন

সংবিধান

গত ২২ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ৩০০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপির একটি তালিকা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এদের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ ছাড়া, বাংলাদেশে এক লাখ ৭০ হাজার ঋণখেলাপি রয়েছে। দেশে কুঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। অঙ্কের হিসাবে বলা যায়, দেশের মোট কুঋণের অর্ধেকেরও বেশি মাত্র ০.১৭ শতাংশ ব্যক্তির পকেটে। অর্থমন্ত্রী খুবই ভালো একটি কাজ করায় তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে এই তালিকা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেনি। এটা বেশ ‘সিমপ্যাথেটিক লিস্ট’ বলে মনে করি। মামলার কারণে অনেকের ঋণের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ জারি আছে। অনেকে তাড়াহুড়া করে রিশিডিউল করেছেন। তাদের নাম এই তালিকায় আসেনি। তা ছাড়া, হিসাবের মধ্যেও অনেক বিষয় উহ্য রাখা হয়েছে। এ অবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি।

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর ছয় বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে পাঁচটি বার্ষিক প্রতিবেদন বের হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে সোস্যাল অ্যানালাইসিসের কথা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছিল। তখন বলেছি, প্রতিটি ঋণ দানের আগে তিনটি বিষয়কে প্রেফারেন্স বা অগ্রাধিকার দিতে হবে : ফিন্যান্সিয়াল প্রেফারেন্স, ইকোনমিক প্রেফারেন্স, সোস্যাল অ্যান্ড মোরাল প্রেফারেন্স। এ বিষয়গুলো দেখা হতো বলে ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ এক্সপ্রেস’ পত্রিকার বিবিবি রেটিংয়ে দেশের সেরা বেসরকারি ব্যাংকের তালিকায় সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক (১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠার সময় ব্যাংকটির নাম ছিল সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক) শীর্ষে স্থান পেয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংক ছিল সেরা। আজ বেসিক ব্যাংকের কী দুর্দশা হয়েছে তা সবাই জানেন। ওই তালিকায় এ রেটিং পাওয়া ব্যাংকের মধ্যে বেসিক ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো ছিল বেসরকারি ব্যাংক (আল-আরাফাহ্ ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, সাউথ-ইস্ট ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি: ও ঢাকা ব্যাংক)। রাষ্ট্রীয় সবগুলো ব্যাংক ছিল সি এবং ডি ক্যাটাগরিতে। দুঃখের বিষয় ২০ বছর পরও ওই সব ব্যাংক তাদের অবস্থান উন্নত করতে পারেনি। এর মূল কারণ, এগুলোতে কোনো কাঠামোগত সংস্কার হয়নি। এ অবস্থা নিরসনের জন্য ব্যাংকের কাঠামোগত পরিবর্তন ও জনবল নিয়োগের পরিবর্তন আনার প্রয়োজন ছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিকভাবে তদারকি করতে পারেনি। অবশ্য মূল্যায়ন করার সেই সামর্থ্যও নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কারণ, এর দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে আমলাদের, যারা কখনো কাঠামোগত সংস্কার চান না। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশে একই অবস্থা। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমেরিকায় আমলারা পদমর্যাদার দিক দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর। যারা মেধাবী তারা আমলা হন না। এই যে রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিকদের আমরা দেখি তারা দ্বিতীয় ক্যাটাগরির। ভালো কোনো ডাক্তার কিন্তু সরকারি চাকরি করেন না। তারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। দুঃখের বিষয়, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ঠিক এর উল্টো। সরকারি চাকরিকে খুব মর্যাদার মনে করা হয়। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আমলা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেকে। এর মূল কারণ, আর্থিক নিরাপত্তা। তাই আমলারা সাধারণত কাঠামোগত সংস্কার চান না। কাঠামোগত সংস্কারের মানে হলো পুরোপুরি নতুন, বিকল্প চিন্তা করা। তারা চান স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে। কারণ, এই এক্সপেরিমেন্ট ফেল করলে তার চাকরি থাকবে না, এই ভয়। তাই তিনি ঝুঁকি নেন না।

আসলে আমাদের ঋণদান প্রক্রিয়াটিই বদলে ফেলা দরকার। ঋণ দেয়ার আগে, কেন ঋণ দেয়া হচ্ছে তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। এর ফিন্যান্সিয়াল, ইকোনমিক, সোস্যাল ও মোরাল ডাইমেনশনগুলো দেখতে হবে। আমাদের অর্থমন্ত্রীর বিষয়টি বোঝা উচিত। তিনি বেসরকারি খাত থেকে এসেছেন। তিনি শিক্ষিত মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জের মতো সংস্থাগুলো ব্যর্থ হওয়ার কারণেই আজ খেলাপি ঋণের এই দুরবস্থা। এখন বাংলাদেশে মাত্র ২ শতাংশ পেইডআপ ক্যাপিটাল হলেই ব্যাংকের পরিচালক হওয়া যায়। এখানে শুধু আর্থিক বিবেচনা কাজ করেছে। নামকাওয়াস্তে দু-একজন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকলেও তাদের কোনো প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা নেই। যখন তখন সরিয়ে দেয়া যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির ব্যর্থতাকে কিভাবে সামর্থ্য বৃদ্ধিতে রূপ দেয়া যাবে, সেই চিন্তা করতে হবে। বেসিক ব্যাংকের দুর্গতির জন্য ব্যাংকটি দায়ী নয়, দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক। এর জন্য দায়ী সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ। দায়ী রাষ্ট্রের ইনস্টিটিউশনগুলো। তাই এখন বিকল্প চিন্তার সময় এসেছে। মার্জিনাল চেঞ্জ বা দু-একজন ব্যক্তির পরিবর্তন, দু-একটি সেমিনার দিয়ে কিছু হবে না। কেন ঋণখেলাপি তৈরি হচ্ছে, সেই চিন্তা আমরা করছি না। এখন ঋণ দেয়া হচ্ছে কোলেটেরাল দেখে, ব্যক্তি দেখে নয়। আর্থিক বিবেচনার সাথে সামাজিক ও নৈতিক বিবেচনা করা হচ্ছে না।

বিষয়টি আরো সহজ করে বুঝিয়ে বলতে এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী একবার আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। অনেকটা আকস্মিকভাবেই তার এই আগমন বলতে হবে। কারণ, আমি তার মতো খ্যাতিমান ব্যক্তির নাম জানলেও তখনো সাক্ষাৎ-পরিচয় ছিল না। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের কথা জানতাম। অনেক আলাপচারিতার পর বললাম, আপনি ও আমি দুই ক্ষেত্রের মানুষ হলেও আমাদের লক্ষ্য কিন্তু একটাই। আমরা দু’জনেই গরিব মানুষের উপকার করতে চাই।

এরপর আমি তাকে ব্যাংকে আসার কারণ জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, আমার টাকা দরকার। বললাম, ব্যাংকের চেয়ারম্যান তো টাকা দেন না, টাকা দেন ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। তিনি প্রধান নির্বাহী। তিনি বললেন, আপনি না বললে হবে না। আমি বললাম, কত টাকা দরকার? এক বা দুই কোটি টাকা চাইলেন। আমি বললাম, ব্যাংকের নিয়মে তো কোলেটেরাল দিতে হয়, আপনাকে সেগুলো দিতে হবে। তিনি বললেনÑ না, ওগুলো আমার নেই। আমি জানতাম, তিনি ভালো মানুষ। সমাজদরদি ব্যক্তি। মানুষের উপকার করতে চান। আমি বললাম, কেন ঋণ চান? তখন সিরাজগঞ্জে তার গ্রামীণ চেকের একটি কারখানা ছিল। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মিলে এই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। প্রফেসর ইউনূস তখনো নোবেল পুরস্কার পাননি। তবে তার খ্যাতি ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। কারখানার জায়গাটি আমি চিনতাম। তখন এমডিকে ডেকে ডা: জাফরুল্লাহকে বললাম, ঠিক আছে আপনি টাকা পাবেন; তবে একটি শর্তে। শর্ত কী? আপনাকে ‘পারসনাল গ্যারান্টি’ দিতে হবে। টাকাটা শোধ না হলে আপনি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। আর কিছু লাগবে না। কোনো কোলেটেরাল লাগবে না। তিনি অবাক হলেন। তাকে ঋণ দেয়া হলো। এখানে যে বিষয়টি মুখ্য, সেটি হলোÑ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে দেখা হয়েছে। জাফরুল্লাহ ভালো মানুষ। তার কোলেটেরাল নেই। তিনি বিপদে পড়েছেন। তিনি আমার এক কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবেন না। তার সাথে প্রফেসর ইউনূস রয়েছেন। এটা ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সাত বছর আগের ঘটনা। তারা পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নন।

আরেকটি ঘটনার কথা বলছি। ব্যাংকে সবাইকে বলতাম, দেখো আমি ৩৩ বছর দেশের বাইরে ছিলাম। আমি মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। আমার ডক্টরাল কমিটিতে হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি প্রফেসররা ছিলেন। তাদের কাছে আমি মুসলমান হয়ে অসাধারণ ভালোবাসা পেয়েছি। ফলে তাদেরকে আমার দ্বিতীয় পিতা-মাতার মতো শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। এ দেশে কারো কারো মধ্যে জেলাভিত্তিক যে পক্ষপাতিত্ব দেখি আমি তার বিরুদ্ধে। সিরাজগঞ্জ আমার জন্মস্থান হওয়ায় ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে সিরাজগঞ্জের কেউ এলে আমার কাছে না আনার নির্দেশ ছিল। যা হোক, একদিন এমডি কিছুটা সঙ্কোচের সাথে সিরাজগঞ্জেরই এক ছেলেকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। দেখতে শুনতে সুঠাম-সুদর্শন, এমকম পাস করেছে। সে আমার কাছে চাকরি চায়। আমি বললাম সাত-আট হাজার টাকা বেতনের চাকরি দিয়ে তুমি কী করবে? একসময় তুমি তো ঘুষ খাওয়া শুরু করবে। তোমার মধ্যে সম্ভাবনা আছে, তুমি উদ্যোক্তা হও না কেন? সে বলল, আমি তো তা-ই হতে চেয়েছিলাম, মাত্র ২৭ লাখ টাকার জন্য অনেক ব্যাংকে ঘুরলাম; কিন্তু কেউ দিলো না। কারণ, আমার জামানত দেয়ার মতো কিছু নেই। শেষ পর্যন্ত আমি ১৫ লাখ টাকাও চাইলাম। সেটিও কেউ দিলো না। গেলেই ঘুষ চায়। আমার ঘুষ দেয়ারও টাকা নেই। যা হোক, তার একখণ্ড জমি ছিল। এটা ছিল বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর উত্তরবঙ্গে যাওয়ার পথে বেশ ভালো একটি অবস্থানে। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকামুখী বা ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গমুখী মানুষ এখানে এসে ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নেয়, খাওয়াদাওয়া করে। জায়গাটা কাজে লাগতে পারে বলে আমার কেন যেন মনে হলো। তখন তার পরিবারের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। তাকে জিজ্ঞেস করি, তোমার সাথে তোমার আব্বার সম্পর্ক কেমন? সে বলল ভালো। তার বাবা তখন সিলেটে চাকরি করেন। আমি তখন টেলিফোনে তার বাবার সাথে কথা বলতে চাইলাম। তার বাবাকে বললাম, আপনার ছেলে আমার কাছে লোন নিতে এসেছে। সে কি ভালো ছেলে? আপনি যদি তাকে ভালো বলে সার্টিফাই করেন, তাহলে আমি তাকে লোন দেবো। তার বাবা বললেন, আমি বাবা হিসেবে বলছি না, আসলেই সে ভালো ছেলে। তাকে লোন দিতে পারেন। আমি যে কথা বলতে চাচ্ছি সেটি হলোÑ লোন নিতে আসা কেউ ভালো না খারাপ সেটি তার বাবার কাছে জানতে চাওয়া তো কোনো ব্যাংকের কাজ নয়। অথচ এ ধরনের কাজগুলো করতে পারলে আজকে আমাদের সমাজ অনেক দুর্দশা থেকে মুক্তি পেত। আজ সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের যোগাযোগ নেই। স্কুলের সাথে পরিবারের যোগ নেই। শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ভালো নয়। ছাত্রছাত্রীকে সমাজের উপযুক্ত করে তোলার দায়িত্ব স্কুল-কলেজের। ওই ছেলের বাবার সাথে কথা বলার পর আমি এমডিকে বললাম, আপনি কালই সিরাজগঞ্জ গিয়ে ওর জায়গাটি দেখে আসবেন। যদি জায়গা থাকে, তাহলে তাকে লোন দেন। ঠিকই সেখানে তার জায়গা ছিল এবং তাকে ২০ লাখ টাকা লোন দেয়া হয়। তাকে শুধু বললাম, দেখো, এই টাকাগুলো গরিবের টাকা। আমি বহু মানুষের টাকা নিয়ে এসে তোমাকে দিচ্ছি। এই টাকা আমার টাকা নয়। এই টাকা তোমাকে ফেরত দিতে হবে।

তাই বলছি, আমাদের ব্যাংকগুলো যেভাবে লোন দেয়, সেই পদ্ধতিই পরিবর্তন করতে হবে। আমরা শুধু ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস দেখি, রাজনৈতিক চাপ দেখি। আমার ওপরও চাপ ছিল। আমি যে দিইনি তা নয়। কিন্তু আমি দেখেছি, লোকটা ভালো কি না। তাই বলছি, কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। তদারকির জন্য যে লোকটিকে নিয়োগ করা হচ্ছে, তার ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। তাকে নতুন করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে রিএডুকেট করতে হবে। নতুন করে শেখাতে হবে।

অর্থনীতির তিনটি খাত : করপোরেট, অনানুষ্ঠানিক ও স্বেচ্ছাসেবক খাতের কথা বলেছি। প্রতিটি খাতে তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদানের কথা বলেছি। এগুলো হলোÑ (ক) সব ধরনের অপারেশনে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক অগ্রাধিকারগুলো স্বচ্ছ ও রিভিল্ড হতে হবে, (খ) আর্থিক/অর্থনৈতিক এনটাইটেলমেন্টগুলো সামাজিক অ্যাসাইনমেন্টের সাথে যুক্ত করতে হবে, (গ) কর্তব্য দ্বারা অধিকারকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এ বিষয়গুলো ব্যাংকের লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। অনেকে বুঝেছেন। আর সে কারণেই সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকটির ফাউন্ডেশন এখনো ভালো। সে সময় এই ব্যাংকের সবচেয়ে কম ওভারডিউ লায়াবিলিটিজ ছিলÑ ২ শতাংশের কম। এখনো অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম রয়েছে। কিন্তু অন্য ব্যাংকগুলোর ওভারডিউ লায়াবিলিটিজ ৪০-৫০ শতাংশের কম নয়। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরো মূল্যায়ন কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। গভর্নর থেকে শুরু করে স্টাফ পর্যন্ত জনবল নিয়োগপ্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে হবে। শীর্ষপদে এমন যোগ্য লোক বসাতে হবে যিনি অর্থনীতির দর্শন বোঝেন, রাজস্বের দর্শন বোঝেন।

সব সময় ঋণকে সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সংযুক্ত করতে চেয়েছি। যেমনÑ যৌতুক সব সমাজের জন্যই একটি অভিশাপ। বেশির ভাগ নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী এই যৌতুক। যারা যৌতুক না নিয়ে বিয়ে করেছে, তাদেরকে ‘কনজুমার ডিউরেবলস স্কিম’-এ ২ শতাংশ কনসেশন রেট দিয়েছি। একজন রিকশাচালককে ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার আগে বলা যায় যে, তুমি ঋণ পেতে চাইলে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে। এভাবে আমরা সহজেই ক্রেডিটকে সোস্যাল ভ্যালুর সাথে যোগ করতে পারি। অবশ্য এসব প্রচেষ্টা হলো সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এখন সবাই রাতারাতি বড়লোক হতে চায়। রাজনৈতিক চাপ নিয়ে হয়তো কেউ আসছে, তাকেই ঋণ দিয়ে দেয়া হচ্ছে। যাদেরকে ঋণ দেয়া হচ্ছে, তারা ঋণ কিভাবে কাজে লাগাচ্ছে, তার কোনো তদারকি নেই।

তবে আমি মনে করি, আমাদের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা আনতে পারবেন। কারণ, তাকে যত দূর জানি, তিনি একজন স্বচ্ছ লোক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি যদি প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরেন, তাহলে দেশের আর্থিক খাত রক্ষা পেতে পারে। রাষ্ট্রের এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। পরিস্থিতির জন্য এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানকে দোষ দেয়। যারা ঋণখেলাপি, তাদের জেলে পাঠালেই সমস্যার সমাধান হবে না। তাদের সাথে বসে বুঝাতে হবে যে, এ দেশটি তাদের।

আজকে ব্যাংকগুলোর দুর্দশার কারণ হলো, সেখানে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব তৈরি হয়েছে। সামাজিক দায়িত্ববোধ লোপ পেয়েছে। এর জন্য ‘ডেলিবারেট কনশাস প্রোগ্রাম’ থাকতে হবে। একটি বা দু’টি সভা-সেমিনার, একজন-দুজন ব্যক্তিকে পরিবর্তন করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে হাত দিতে হবে। পরিচালক হওয়ার যোগ্যতায় পরিবর্তন আনতে হবে। গোড়ায় হাত না দিলে ঋণখেলাপিদের জেলখানায় পাঠিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং আরেক দল ঋণখেলাপি তৈরি হবে। এই দুষ্টচক্র থেকে দেশ মুক্তি পাবে না। হ

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লি:, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা।
যসপঃ ২০০৪@ুধযড়ড়.পড়স

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/421148