২৮ জুন ২০১৯, শুক্রবার, ৫:৪৬

মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন কোচ ব্রিজে চলছে রেল

সাড়ে ১০ বছরে ৪৮০০ ট্রেন দুর্ঘটনায় ৩৯২ প্রাণহানি * দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হলেও, রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না * যথাযথ রেলপথ, নতুন ইঞ্জিন-কোচের বিকল্প নেই : রেলওয়ের মহাপরিচালক

রেল নামক ‘নিরাপদ বাহনে’ চড়েও ঝরছে প্রাণ। গত সাড়ে ১০ বছরে ৪ হাজার ৭৯৮ বার ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যু হয় ৩৯২ জনের।

বছরে প্রাণ যাচ্ছে ৩৭ জনের। ৫০-৬০ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ, জরাজীর্ণ লাইন ও ব্রিজের ওপর দিয়ে চলছে যাত্রীবাহী ট্রেন।

এ নিয়ে রেলের হর্তাকর্তাদের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। তবে বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে অনেক কিছু করার চেষ্টা করলেও রেল নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলার যেন শেষ নেই। পরিসংখ্যান বলছে, রেলে যত দুর্ঘটনা ঘটছে তার ৮২ শতাংশই ঘটছে লেভেল ক্রসিংয়ে।

রেলের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনার দুই নম্বর কারণ হচ্ছে- ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতু। তাছাড়া এই মুহূর্তে মাঠ পর্যায়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর প্রায় ১১ হাজার কর্মচারীর পদ খালি।

প্রতিদিন ৩ বার করে পুরো রেল লাইন, সিগন্যাল ও সেতু পরিদর্শনের কথা থাকলেও অনেক সময় বছরে একবারও পরিদর্শনে যাওয়া হয় না। দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত ও লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ছাড়াও অবহেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে শত শত লোকের মৃত্যু তো আছেই।
কথা হয় রেলওয়ের একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে। তারা বলছেন, রেললাইনকে খুব যত্ন করে রাখতে হয়। লাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লাইনে উনিশ-বিশ হলেই দুর্ঘটনা। রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর থাকবে এবং কোনো অবস্থাতেই একটি স্লিপারও ক্লিপ কিংবা হুকবিহীন থাকবে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর রেলপথ পাথরশূন্য হতে শুরু করে। স্লিপার নড়বড়ে, এর সঙ্গে ক্লিপ-হুক ও ফিশপ্লেট খোলার হার লাফিয়ে বাড়ছে। এখন যেসব পাথর দেয়া হয়, তা খুবই নিম্নমানের। প্রভাবশালী ঠিকাদারদের হস্তক্ষেপ থাকায় এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কথাও বলা যায় না। অপরদিকে ট্রেনের সিডিউল ঠিক রাখতে ‘নিয়ন্ত্রণাদেশ’ অমান্য করে ট্রেন চালানোর কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা।

কুলাউড়ায় রেল দুর্ঘটনায় ৪ জনের মৃত্যু ও শতাধিক যাত্রীর আহতের পর রেল নিরাপদ বাহন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন সামনে এসেছে। রেলের দুরবস্থা নিয়ে খোদ সংসদেও আলোচনা হয়েছে একাধিকবার। ব্রিটিশ আমলের রেলসেতু, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ ও লোকবলের ঘাটতি নিয়ে কথা হয়েছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হলেও তা কখনই আলোর মুখ দেখে না। অনেকেই তদন্ত কমিটিকে ‘ভাঁওতাবাজি’, লোক দেখানো বলছে।

কথা হয় রেলওয়ের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে। তিনি জানান, বড় ও মাঝারি দুর্ঘটনায় দুটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কোনো রিপোর্টই বাস্তবায়ন হয়নি। এটি পুরোটাই ভাঁওতাবাজি। শুধু তদন্ত কমিটি গঠন ও সাময়িক বরখাস্তেই শেষ হয় দুর্ঘটনা। লোকবল স্বল্পতার কারণে বরখাস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্বহাল করতে হয়।

রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম যুগান্তরকে জানান, ট্রেন দুর্ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। যাত্রী হতাহত ছাড়াও রেলের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ রেলপথ এবং নতুন ইঞ্জিন ও কোচের বিকল্প নেই। অনেক রেলপথ জরাজীর্ণ স্বীকার করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন করছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার একটি বরাদ্দ আমরা পাচ্ছি, যার প্রায় পুরোটাই লাইন, রেলসেতুসহ মাঠ পর্যায়ে কাজ করা হবে। এরই মধ্যে লাইন, ব্রিজ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। জরাজীর্ণ লাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুর দিকেই নজর বেশি দিচ্ছি। এগুলো ছাড়া রেলের কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। বর্তমানে ২৫ হাজার লোকবল রয়েছে। আমরা আরও ২৭ হাজার লোক নেয়ার প্রস্তাব করেছি।

রেলওয়ে অপারেশন বিভাগ বলছে, মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত ও বিভিন্ন কারণে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ৩৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে লেভেল ক্রসিংয়ে। লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় রেলের নয়। বৈধ কিংবা অবৈধ লেভেল ক্রসিং পার হতে হয় দেখেশুনে। প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ের পাশেই বিলবোর্ডে লেখা রয়েছে- ‘এটি অবৈধ রেল লেভেল ক্রসিং, নিজ দায়িত্বে পারাপার হোন’। পথচারী ও গাড়ি চালকেরা এসব না দেখে গাড়ি নিয়ে লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়েই পড়েন দুর্ঘটনায়।

রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়াজাহান যুগান্তরকে জানান, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ২৭৯৮টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ২০৪ জন নিহত হয়েছে। বাকি দুর্ঘটনাগুলো ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত। এসব দুর্ঘটনা শুধু লাইন জরাজীর্ণের কারণে হচ্ছে এমনটা নয়, মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত ও লেভেল ক্রসিংয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে দুর্ঘটনার হার কমছে। দুর্ঘটনা যাতে একেবারেই কমে আসে সেই জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

রেল দুর্ঘটনা নিয়ে কথা হয় রেলের চালক, গার্ড ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে। তারাও দুর্ঘটনার জন্য ব্রিটিশ আমলের ইঞ্জিন, বগি ও ব্রিজকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, রেল লাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, স্লিপার নষ্ট, লাইন ও স্লিপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকার কারণে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। লক্কড়-ঝক্কড় দুটি রেললাইনের সংযোগস্থলে এক একটি স্লিপারের সঙ্গে ৮টি ক্লিপ থাকার কথা থাকলেও কোথাও ২টি, কোথায় ৩টি আবার কোনো সংযোগস্থলে ক্লিপই নেই। রেলওয়ে সেতুগুলোর আরও ভয়ানক অবস্থা রয়েছে। তারা বলছেন, ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনায় চালক কিংবা গার্ড দায়ী নয়। মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য দায়ী সিগন্যালিং। এ জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট স্টেশন মাস্টার-ম্যানেজার।

রেলওয়ে গার্ডস কাউন্সিল, রেলপথ বিভাগ ও রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কর্মচারীদের মূল কাজই হচ্ছে রেল লাইন রক্ষণাবেক্ষণ করা। অথচ ১১ হাজার কর্মচারীর পদ শূন্য। প্রতিদিন ৩ বার করে লাইন, সিগন্যাল ও ব্রিজ পরিদর্শন করা ছাড়াও ট্রেন ছাড়ার পূর্বে ইঞ্জিন ও প্রতিটি বগির বিশেষ বিশেষ যন্ত্রাংশ ও চাকা চেক করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এছাড়া ২৫ শতাংশ ট্রেন চালক ও গার্ড কাজ করছে চুক্তিভিত্তিক। ভুল করলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এক কর্মকর্র্তা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার কথা চুক্তিতেই উল্লেখ রয়েছে। অবসরে যাওয়া চালক-গার্ডের ওপরই এখন নির্ভর করছে রেল। রেলওয়ের ট্রেন গার্ডস ও চালক অ্যাসোসিয়েশনের দুই নির্বাহী সদস্যের বক্তব্য- রেল দুর্ঘটনার পর সমস্যার মূলে না গিয়ে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে চালক ও গার্ডদের।

রেলপথ সচিব মোফাজ্জেল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা এরকম দুর্ঘটনা দেখতে চাই না। রেলকে নিরাপদ বাহন নিশ্চিত করতে হলে দুর্ঘটনা রোধ করতেই হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, রেললাইনকে শিশুর মতো লালন-পালন করতে হবে। মাত্র ৩-৪ ইঞ্চির একটি লোহার লাইন ধরে ট্রেন চলে। ওই ট্রেন হাজার হাজার যাত্রী চড়ে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও বগি নিয়ে আমরা বেশি চিন্তিত। নতুন ইঞ্জিন ও কোচ বর্তমান সরকার ক্রয় করছে। আশা করি এমন অবস্থার পরিবর্তন হবেই।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/192771