২৮ জুন ২০১৯, শুক্রবার, ৫:৩৮

সিলেট-ঢাকা রেলপথের স্লিপার যেন মরণফাঁদ

কবির আহমদ, সিলেট থেকে : ব্রিটিশ আমলের পুরাতন রেলব্রিজ ও ত্রুটিপূর্ণ রেল লাইন দিয়েই বছরের পর বছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার লাখো ট্রেন যাত্রী। সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম সড়কে শত বছরের পুরানো রেল লাইন দিয়ে যাতায়াত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সিলেট বিভাগের চার জেলার কয়েক লাখ মানুষের। ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত, কালভার্ট ভেঙ্গে যাওয়া, মালগাড়ী পড়ে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেনের মধ্যে বসা থাকতে হয় অসহায় যাত্রী সাধারণকে। সিলেট বিভাগের ৪/৫ মন্ত্রী থাকার পরেও সিলেট রেল স্টেশনের দিকে কারো খেয়াল নেই। ঢাকা-সিলেট রেলপথে স্লিপারে স্লিপারে যেন মরণফাঁদ। গত সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনের সাংবাদিক লাউঞ্জে সিলেট-১ আসনের এমপি ও সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে বলেন, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সিলেটের রেলওয়ে ব্রিজগুলো ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। এগুলো সংস্কার দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, কুলাউড়ার বরমচালের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার খবর শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে সামান্য ঝড়বৃষ্টি হলেই রেল লাইন থেকে মাটি সরে মরণফাঁদে পরিণত হয় দেশের সর্ববৃহৎ এ যোগাযোগ ব্যবস্থাটি। বিভিন্ন সময় ছোড়-বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি নিয়ে কোন মাথা ব্যথাই নেই রেল কর্তৃপক্ষের। দেশের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে রেলপথ থাকলেও ঢাকা-সিলেট রেলপথের প্রতিটি স্লিপারে সাজানো রয়েছে মরণফাঁদ।

জানা যায়, ১৭৬ কিলোমিটারের ঢাকা-সিলেট রেলপথটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি। ঢাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন স্থাপন করা হলেও ভৈরব থেকে সিলেট পর্যন্ত লাইনটি রয়েছে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। শতবছরের পুরনো এই পথটিতে মাঝে মধ্যে সংস্কার করা হলেও অধিকাংশ স্থানের অবস্থাই অত্যন্ত নাজুক। আর সেতুগুলোর কথাতো বর্ণনা করার মতো না। নড়বড়ে এই রুটের প্রতিটি সেতুতে ট্রেন উঠলেই কাঁপতে শুরু করে।

সচেতন মহলের দাবি, শুধুমাত্র ঢাকা-সিলেট রেলপথে যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে তা সম্পূর্ণ দেশের রেল পথেও ঘটে না। কখনো পাহাড়ি ঢলে রেল লাইনের নিচ থেকে মাটি সড়ে যায়। আবার কখনো ব্রীজ ভেঙে যায়। তবে সব চেয়ে বেশি ঘটে লাইনচ্যুতের ঘটনা। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে এই রুটের অধিকাংশ স্লিপারেই নেই নাট-বলটু। ঘুণ-পোকায় খাওয়া কাঠের উপর ভর করে হাজারো জীবন নিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে ৬টি আন্তঃনগরসহ বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেন।

রেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে পারাবত, জয়ন্তীকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন দুইবার করে ১২ বার আসা-যাওয়া করে। আর এই পথে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন অন্তত ২৫/৩০ হাজার যাত্রী।

এদিকে, ছয়টি রেল সেতুকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রেখেছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে তাঁরা এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলতে রাজি না। তাদের দাবি এগুলো মেরামতযোগ্য। তাদের তালিকায় থাকা ছয়টি রেলব্রীজ হলো- হবিগঞ্জের শাহজিবাজারে ৭৩ নম্বর সেতু, লস্করপুরে ১০২ নম্বর সেতু, শায়েস্তাগঞ্জে ১০৫ নম্বর সেতু, বাহুবলের রশিদপুরে ১১৪ নম্বর সেতু, কমলগঞ্জের ভানুগাছে ১৮৩ নম্বর সেতু এবং ছাতকে ৩২ নম্বর সেতু। আর রেল লাইনের ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের দাবি, কিছু কিছু অংশে সমস্যা আছে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়- ঢাকা-সিলেট রেলপথ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে যাত্রীরা দেখলে হয়তো এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতেন না। হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে মৌলভীবাজার পর্যন্ত প্রতিটি স্থান মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। রেল লাইনের কোন স্লিপারেই নাট-বলটু নেই। কোনটাতে একটি, আবার কোনটাতে একটিও নেই। অনেক স্থানে কাঠের উপর থেকে লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও ঘুণ-পোকায় খেয়ে পেলেছে কাঠের স্লিপার। দেখলে মনে হবে এই লাইন দিয়ে হয়তো বেশ কয়েক বছর ধরে রেল চলে না।

অভিযোগ রয়েছে- ঢাকা-সিলেট রেলপথের হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার অংশে সব চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এর একমাত্র কারণ ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ। ত্রুটির কারণে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটলেই দিনব্যাপী সারাদেশের সাথে বন্ধ হয়ে পড়ে সিলেটের রেল যোগাযোগ। দুর্ভোগ পোহাতে হয় হাজার হাজার যাত্রীকে। আবার দুর্ঘটনা কবলিত স্থানটিতে জোরা-তালি সংস্কার করেই পুনরায় চালু করে দেয়া হয় যোগাযোগ। স্থায়ী সমাধানের চিন্তাই যেন কর্তৃপক্ষের মাথায় আসে না।

অন্যদিকে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত তিন বছরে অন্তত ২০/২৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-সিলেট রেল পথে।

সব চেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৩ জুন রোববার রাতে। সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ‘উপবন এক্সপ্রেস’র কয়েকটি বগি সেতু ভেঙে খালে পড়ে ও লাইনচ্যুত হয়ে ৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক যাত্রী। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল স্টেশন থেকে ২০০ মিটার দূরে কালা মিয়া বাজার সংলগ্ন সেতু ভেঙে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এই স্থানটিতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে লুৎফুর রহমান রাজু নামে এক ব্যক্তি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। অবশেষে তাঁর আশংঙ্কাই বাস্তাবায়িত হলো।

চলতি বছরের গত ২ জুন সকালে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশিদপুরে ‘কুশিয়ারা’ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে সিলেটের সাথে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৬ ঘন্টার দুর্ভোগ দিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

এর আগে ৬ এপ্রিল সিলেটের মাইজগাঁওয়ে মালবাহী একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে সিলেটের সাথে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ সময় সিলেট থেকে ছেড়ে যায় যাত্রীবাহী ‘উপবন এক্সপ্রেস’ মোগলাবাজার স্টেশনে আটকা পড়ে।

২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ‘পাহাড়িকা এক্সপ্রেস’ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রেলওয়ের ১৪১ নম্বর সেতুর মাটি সরে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

একই বছরের ২৯ মার্চ হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকার ৫৬ নম্বর ব্রিজে বৃষ্টির পর মাটি সরে যায়। পরদিন মেরামতের সময় একটি পিলার ধসে গেলে সারাদেশে সঙ্গে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। চারদিন সারাদেশের সাথে সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর স্বাভাবিক হয়। কিন্তু একদিন পর আবারও ফের বন্ধ হয়ে পড়েছে যোগাযোগ।

এরআগে একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ভাড়াউড়া এলাকায় ১৫৭ নম্বর সেতুর পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে সেতুটি দেবে যায়। এতে রেল যোগাযোগ ১৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকে।

২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়ায় ‘পারাবত এক্সপ্রেস’ ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইঞ্জিনে আগুন লেগে যায়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন।

এসকল বড় বড় দুর্ঘটনা ছাড়াও ঢাকা-সিলেট রেলপথে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করলেও নাকে তেল দিয়েই ঘুমাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। বৃহত্তম এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা চলাচল করলেও রেল কর্তৃপক্ষ লাইন সংস্কারের কোন উদ্যোগই নিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক যাত্রী।

সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট রেলপথ নিয়ে আব্দুল খালিক নামে এক যাত্রী বলেন- ‘আমরা রেল পথকে সব চেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা মনে করি। কিন্তু ঢাকা-সিলেট রেলপথে যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে এর পর রেলে যেতেই ভয় করবে।’

তিনি বলেন- ‘এই রেলপথটি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে কি বলব! দ্রুত এটি সংস্কার করা প্রয়োজন। না হলে কখন কি হয় বলা যায় না।’ এছাড়া সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে চরম সংকট দেখা দিয়েছে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ। সিলেট স্টেশন ম্যানেজার (এসএমআর) এর পদ শূন্য দীর্ঘদিন থেকে। গত ঈদুল ফিতরের পরের সপ্তাহ সিলেট স্টেশন মাস্টার কাজী শহীদুল ইসলাম অবসরে চলে যান। সহকারী সিলেট রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার রাশেদ আহমদকে দিয়ে উপবন ট্রেন দুর্ঘটনার দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। এই দিনই কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আফছার উদ্দিন সিলেটে যোগদান করেন। প্রায় বছর খানেক আগে শারীরিক অসুবিধার কারণ দেখিয়ে সিলেট স্টেশন ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক অবসরে চলে যান। এরপর থেকে স্টেশন মাস্টারই ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। যাত্রী সাধারণ মনে করেন সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে অবস্থা ফিরিয়ে আনতে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ট্রেন চালক সহ শূন্য পদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের পাশাপাশি পুরাতন ব্রিজ, কালভার্ট ও রেল লাইন জুরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করা খুবই জরুরী। এ বিষয়গুলো নিয়েও যাত্রীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।

https://www.dailysangram.com/post/380693