২৭ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৪০

রংপুর মেডিকেলে নজিরবিহীন দুর্নীতি: কার্যাদেশের ৪ দিনের মাথায় বিল পরিশোধ

যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে সোয়া ৩ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

রংপুর মেডিকেল কলেজের জন্য ৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে নজিরবিহীন দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, ৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার নামে সোয়া তিন কোটি টাকাই লোপাট করা হয়েছে।

দরপত্রের চাহিদাপত্র তৈরি, কার্যাদেশ দেয়া, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনা এবং তা বুঝে নেয়ার প্রত্যেকটি জায়গায় চরম অসঙ্গতির চিত্র পাওয়া গেছে। বিশেষ করে কার্যাদেশ দেয়ার পর ৪ দিনের মাথায় মেডিকেল কলেজের জন্য একাধিক যন্ত্রপাতি জাপান, ইতালি, জার্মানিসহ বিশ্বের একাধিক দেশ থেকে এনে তা সরবরাহ করার বিস্ময়কর তথ্যও মিলেছে।

শুধু তাই নয়, কার্যাদেশ দেয়া থেকে অর্থ পরিশোধে বিল স্বাক্ষরে সময় লেগেছে মাত্র চার দিন। গত বছর ৩০ জুনের মধ্যে এ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। ২৬/এ/২, তোপখানা রোড, ঢাকার ঠিকানায় ‘বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কো.’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাগজপত্রে এসব মালামাল সরবরাহ করলেও এর নেপথ্যে কাজ করেছে একটি পেশাজীবী সংগঠনের কয়েকজন নেতা।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, পারস্পরিক যোগসাজশে যন্ত্রপাতির মূল্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে লেখা হয়েছে। সরকারি অর্থ লুটের পথ সহজ করতে দরপত্র আহ্বান, দরপত্র ওপেনিং, বাজারদর যাচাই-বাছাই, সার্ভে কমিটিসহ প্রতিটি কমিটিতে কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের ৩ জন শিক্ষককে রাখা হয়েছে।

নিয়ম মেনে মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধানদের কাছ থেকে মালামাল ক্রয়ের চাহিদা নেয়া হলেও তা মানা হয়নি। বরং ঠিকাদারের মর্জিমাফিক তালিকা প্রস্তুত করার অভিযোগ রয়েছে। প্রয়োজন নেই বা তালিকায় নেই এমন যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়েছে।

দরপত্র প্রস্তুত কমিটির সদস্য সচিব মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মাহফুজার রহমান বিষয়টি জানতেনই না। কোনো নথিপত্রেও তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশে এয়ারকন্ডিশন প্রস্তুতকারী দেশ জাপান লেখা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহকৃত ওই মালামাল ও মেমোতে লেখা রয়েছে থাইল্যান্ড।

এ ধরনের আরও অনেক অসঙ্গতি দেখা গেছে। নথিপত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশের তারিখ উল্লেখ রয়েছে ২০১৮ সালের ২৩ জুন। দরপত্র প্রস্তুতের তারিখ রয়েছে ২১ জুন ২০১৮।

এর দু’দিন পর ২৩ জুন কার্যাদেশ দেয়া হয় এবং ২৭ জুন সরবরাহকৃত মালামাল গ্রহণের কথা নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। অস্বাভাবিক দ্রুততায় ২৭ জুনেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধের নথিপত্রে স্বাক্ষর করেন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. নুর ইসলাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন প্রশ্ন রেখে বলেন, কার্যাদেশ দেয়ার ৪ দিনের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপান, ইতালি, ইউকে, জার্মানি, চীন, আমেরিকা, ভারত ও বেলজিয়াম থেকে এসব মালামাল ক্রয় এবং তা পরিবহন করে রংপুর মেডিকেল কলেজে সরবরাহ করল কী করে।

রংপুর মেডিকেল কলেজের ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড আদারস ইনস্টলমেন্টসহ প্রায় ৫ কোটি টাকার উপকরণ দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়।

পারস্পরিক যোগসাজশে দরপত্রে প্রতিটি পণ্যমূল্য ৪-৫ গুণ বাড়িয়ে প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা লুটে নেয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ৩টি কোম্পানির মধ্যে সর্বনিু দরদাতা হিসেবে ‘বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানিকে’ কার্যাদেশ দেয়া হয়।

অভিযোগে বলা হয়, দরপত্রে কাটাকাটি করে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানিকে সর্বনিু দরদাতা দেখিয়ে কার্যাদেশ দেয়া হয়।

অভিযোগ সম্পর্কে রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ নুর ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রমেকের এক শিক্ষক জানান, দরপত্রে এমন কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে যা মেডিকেল কলেজের প্রয়োজন নেই। শুধু অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ওসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। তাছাড়া, যে বিভাগের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে সেই বিভাগে কোনো শিক্ষককেও কমিটিতে রাখা হয়নি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/192429