১৩ দিন পর না ফেরার দেশে ফুলন। ফাইল ছবি
২৭ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৮

কলেজছাত্রীর শরীরে আগুন: ১৩ দিন পর না ফেরার দেশে ফুলন

শরীরে কেরোসিন দেয় আনন্দ, আগুন দেয় রাজু : ভবতোষের স্বীকারোক্তি * পুলিশের তদন্ত ও স্বীকারোক্তি নিয়ে পরিবারের সন্দেহ

অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নরসিংদীর কলেজছাত্রী ফুলন বর্মণ। দীর্ঘ ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের হাই ডিফেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার সকাল ৬টা ২০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।

ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বাড়িতে ফুলনের লাশ পৌঁছলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। লাশ এক নজর দেখতে হাজারও মানুষ ভিড় করেন।

বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল যুগান্তরকে বলেন, আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফুলন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার শরীরে ২১ ভাগ ডিপ বার্ন ছিল। এছাড়া ইনফেকশনও হয়েছিল। এদিকে, ছোট মেয়েকে হারিয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আহাজারি করেন ফুলনের বাবা-মা। জড়িতদের ফাঁসির দাবি করেছেন তার বাবা-মা।

ফুলনের মা অঞ্জলী বর্মণ বলেন, আগুন দেয়ার জন্য ফুলন মৃত্যুর আগে প্রতিপক্ষ সৌরভ ও তার পরিবারকে দায়ী করে গেছে। তিনি আরও বলেন, বাড়ির জায়গা নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝামেলা ছিল। আমাদের অনেকবার হুমকি দেয়া হয়েছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে এলাকাছাড়া করারও হুমকি দেয়া হয়েছে।

ফুলনের ভাই সুমন বর্মণ বলেন, আমরা যাদের সন্দেহ করছি পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি। বরং আমার ফুফাতো ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ভবতোষ বর্মণ ও রাজু হয়তো ভয় পেয়ে দোষ স্বীকার করেছে। এ কারণে আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। দোষী যেই হোক আমরা অবিলম্বে প্রকৃত অপরাধীর বিচার চাই। জড়িতদের ফাঁসি চাই।

১৩ জুন রাত সাড়ে ৮টার দিকে নরসিংদীর বীরপুরে কলেজছাত্রী ফুলন দোকান থেকে কেক নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন। বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছামাত্র পূর্ব থেকে ওতপেতে থাকা অজ্ঞাতনামা দুই দুর্বৃত্ত তার হাত ও মুখ চেপে পাশের নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। তার আর্তচিৎকারে লোকজন তাৎক্ষণিক তাকে উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তাকে ভর্তি করা হয়।

এ ঘটনায় ফুলনের বাবা যোগেন্দ্র বর্মণ অজ্ঞাত দু’জনকে আসামি করে সদর মডেল থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ভবতোষ, আনন্দ, রাজু ও সজিবসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আগুন দেয়ার কথা স্বীকার করেছে ফুলনের ফুফাতো ভাই ভবতোষ ও রাজু। পরে তারা আদালতে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

২১ জুন নরসিংদীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শারমিন আক্তার পিংকীর আদালতে রাজু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরদিন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহিনা আক্তারের আদালতে ভবতোষ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার কয়েকদিন আগে জমি নিয়ে ফুলনের পরিবারের সঙ্গে প্রতিবেশী সুখলাল ও হিরালালের বিরোধ হয়। তার মামার দুই মেয়ে এবং কোনো ছেলে নেই। এ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে মামাতো বোনকে হত্যার মিশনে নামে ভবতোষ। তার টার্গেট ছিল মামার সম্পত্তি।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝামেলা থাকায় তাকে কেউ সন্দেহ করবে না। ভবতোষ তার এ পরিকল্পনার কথা আনন্দ ও রাজুকে জানায়। বন্ধুত্বের খাতিরে তারা কাজটি করতে রাজি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের শিক্ষা চত্বর এলাকার একটি মুদি দোকান থেকে কেরোসিন কিনে আনে রাজু।

জানা গেছে, যোগেন্দ্র বর্মণের সঙ্গে প্রতিবেশী সুখলাল ও হিরালালের জমি নিয়ে বিরোধ নিরসনে এলাকায় সালিশ দরবারও হয়েছে। ঘটনার ২ দিন আগে ভবতোষ ও ফুলনের মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশী সুখলালের ঝগড়া হয়। এ ঝগড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ফুলনের মা বলেন, এখানে থাকব না। দরকার হয় জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাব।

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ফুলনের শরীরে আগুন দেয়ার পরিকল্পনা করে ভবতোষ। ঘটনার দিন সে রাজু ও আনন্দকে নিয়ে বীরপুর রেল লাইনে বসে পরিকল্পনা করে। ঘটনার পর ভবতোষ ও আনন্দ একদিক দিয়ে এবং রাজু অন্যদিক দিয়ে পালিয়ে যায়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক আবদুল গাফফার বলেন, বর্তমানে অগ্নিদগ্ধের ঘটনা খুবই আলোচিত ও স্পর্শকাতর। তাই অপরাধীরা প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে এ পথ বেছে নেয়। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্রেফতার ভবতোষ প্রথম থেকে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। আনন্দের কেরোসিন কেনার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। শুধু তাই নয়। আনন্দকে কেরোসিন দোকানদারের সামনাসামনি পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী সুখলাল ও হিরালালের দিকে সন্দেহ করছে নিহতের পরিবার।

তিনি আরও বলেন, এ মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন সরাসরি এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা আদালতে স্বীকার করেছে। পরিবারের লোকজন দ্বিমত থাকলেও পুলিশের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।

এদিকে, বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ফুলনের লাশ বীরপুরে তার নিজ বাড়িতে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। লাশ দেখতে এলাকাবাসী ও তার সহপাঠীরা বাড়িতে ভিড় জমান।

নরসিংদী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড কমিশনার একেএম ফজলুল হক লিটন বলেন, ফুলনের গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। এ ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। যাতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।

নরসিংদীর পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন বলেন, আসামিরা আলাদাভাবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের বক্তব্যের মিলও পাওয়া গেছে। এছাড়া পুলিশের তদন্তে আসামিদের পরস্পর যোগাযোগ ও তাদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, মানবিক কারণে আমরা ফুলনের পরিবারের পাশে ছিলাম। পুলিশের পক্ষ থেকে চিকিৎসার সব ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের আর্থিকভাবেও সহায়তা করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/192423