২৭ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৪

গতিহীন সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির প্রকল্প ৫ বছরে অগ্রগতি ৩৬.২৭ শতাংশ; মূল কাজ শুরু করতেই তিন বছর পার

দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির প্রকল্পে অগ্রগতি নেই। বিভিন্ন জটিলতার জালে ৪৫৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে। অনুমোদন পাওয়ার তিন বছর পর প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়নোর পর গত পাঁচ বছরে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, মাঠপর্যায়ের জরিপে স্বাক্ষরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। তবে শিক্ষার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নি¤œ আয়ের পরিবারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ৬৩.৭৫ শতাংশ শিখন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে স্থানীয় লোকজনদের বাসস্থান বা খোলা জায়গায়। শিক্ষার উপকরণ নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, দেশের উন্নয়নে শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ৩ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এখনো নিরক্ষর; যা দেশের উন্নয়নে বাধাস্বরূপ। দেশের এই জনসংখ্যাকে সাক্ষরতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহায়তায় দেশের আটটি বিভাগের ২৫০টি উপজেলায় মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা, সবার জন্য শিক্ষা, জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করা এবং একই সাথে দেশের ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৪৫ লাখ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে মৌলিক সাক্ষরতা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করা। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একনেক সভায় ৪৫২ কোটি ৫৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৮ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার কথা। কিন্তু প্রকল্পটির মূল কাজ শুরু করতেই তিন বছর চলে যায়। পরে আরো এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। স্থানীয় এনজিওর মাধ্যমে এ প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। আর ইউনেস্কোর ইউআইএস বলছে, গত এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার সর্বোচ্চ ৭২.৭৬ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে নারী সাক্ষরতার হার ৬৯.৯০ শতাংশ, পুরুষের হার ৭৫.৬২ শতাংশ। এর মাঝেও দেশের ৩ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এখনো নিরক্ষর।

সরেজমিনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্পের কাজ স্থানীয় ও জাতীয় উভয় পর্যায়ে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে দেরিতে শুরু করা হয়। বিলম্বে প্রকল্প শুরু করার কারণে এর অগ্রগতিও প্রশ্নবিদ্ধ। আর্থিক অগ্রগতি গত পাঁচ বছরে ২৫.৭১ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৩৬.২৭ শতাংশ। প্রকল্পভুক্ত আড়াই শ’ উপজেলার মধ্যে বর্তমানে ১৩৪টি উপজেলায় কার্যক্রম চলছে। মোট ৩৯ হাজার ৩১১টি শিখন কেন্দ্রে ৭৮ হাজার ৬২১ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও এক হাজার ৯৬৭ জন সুপারভাইজার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৪১ জন শিক্ষার্থীকে যুক্ত করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের জরিপ থেকে সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক।

মাঠপর্যায়ের তথ্য থেকে জানা গেছে, শিখন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদরাসায় ৩৬.২৫ শতাংশ এবং ৬৩.৭৫ শতাংশ স্থাপন করা হয়েছে স্থানীয় লোকজনদের বাসস্থান বা খোলা জায়গায়। কিছু কিছু শিখন কেন্দ্রে প্রতিদিনের কার্য পরিচালনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই; যা ডিপিপির নির্দেশনা অনুসরণ করেনি। শিক্ষা উপকরণ সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছালেও এর মান নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চ ও অন্যান্য সরঞ্জাম নেই বেশির ভাগ শিখণ কেন্দ্রে। ব্যাহত করছে শিক্ষাকার্যক্রম। বরাদ্দকৃত তহবিলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা ইউনিটের স্থিতিশীলতার অভাব প্রকল্পের দুর্বলতার অন্যতম দিক।

প্রকল্পের বাস্তব অবস্থা হলো সারা দেশে এ প্রকল্পের আওতায় ৭৫ হাজার শিখন কেন্দ্র স্থাপনের বিপরীতে পাঁচ বছরে ৩৮ হাজার ৩১১টি স্থাপন করা হয়েছে। ৪৫ লাখের মধ্যে মাত্র ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪৪১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। শুরু হয়নি এখনো দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ। ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বাদ পড়েছে।

জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রজেক্ট ইপ্লিমেন্টেশন ম্যানেজমেন্ট ইউনিট ১৩৪টি উপজেলায় কাজ করছে। একটিমাত্র এনজিও চুক্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের জন্য ১১৩ উপজেলার ১০৯টিতে বাস্তবায়নকারী এনজিও সাথে চুক্তি হয়েছে। চারটিতে মামলার কারণে স্থগিত রয়েছে।

বাস্তবায়নকারী সংস্থার মহাপরিচালকের তথ্যÑ দ্বিতীয় ধাপের মাঠপর্যায়ের কাজ এখনো বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। বাস্তবায়নকারী এনজিও নির্বাচনে বিলম্ব, প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্য বইয়ের জন্য দরপত্র আহ্বানে ব্যর্থতা, বিলম্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, ই-জিপি প্রক্রিয়ার দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা প্রকল্প বাস্তবায়নকে বিলম্বিত করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর অসহযোগিতাও একটা কারণ ছিল। স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবে প্রকল্পটির অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/420775