২৭ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৩১

ক্ষোভ হতাশা ও ভয়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা তুলছেন গ্রাহকরা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : গত ১৩ জুন সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সঞ্চয়পত্রে কর বাড়ানোর আভাস দেন। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে মুনাফা না তুললে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ হারে কর কাটা হবে এ আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংকে ভিড় করছেন গ্রাহকরা। গ্রাহকদের ব্যাপক উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিচে থাকছে না তিল ধারণের জায়গা। ক্ষোভ-হতাশা ভয়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা তুলছেন হাজার হাজার গ্রাহক। রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা রাত ৯টা পর্যন্ত সেবা দিচ্ছেন। সব হিসাব-নিকাশ শেষ করে তাদের অফিস ছাড়তে রাত ১১টা বেজে যাচ্ছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। এ প্রস্তাব পাস হলে আগামী ১ জুলাই থেকে বর্ধিত হারে কর কাটা হবে। এই ভয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ তুলতে গ্রাহকরা ভিড় করছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখা হতো। নতুন প্রস্তাব পাস হলে আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে সুদের ওপর নতুন করের হার। এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকরা।

গতকাল বুধবারও বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের নিচতলায় সঞ্চয়পত্রের মুনাফা উত্তোলনকারী গ্রাহকদের উপচেপড়া ভিড়। বাংলদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সঞ্চয়পত্র গ্রাহকদের সাধারণত দিনে ১০০০ থেকে ১২০০ টোকেন দেওয়া হত। তবে চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন থেকে গ্রাহকের সংখ্যা অধিক হারে বেড়ে গেছে। প্রতিদি ৪ হাজার কিংবা তারও বেশি টোকেন দেওয়া হচ্ছে। এই গ্রাহকদের বেশিরভাগই মুনাফা তুলতে আসছেন। যারা বছরে একবার কিংবা তিন মাস অন্তর অন্তর মুনাফা তোলেন, তারাই এখন বেশি আসছেন।

মুনাফা তুলতে আসা এসব গ্রাহকের বেশিরভাগের বয়স ষাটের উপরে। কারও কারও আশিরও বেশি। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা তুলতে আসা এ সব মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ-হতাশা, ভয় আর চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। কেন না, কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? টাকা তুলতে পারবেন কি না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিচ তলাতেও ছিল একই রকম ভিড়।

পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা শামিমা আক্তার বলেন, তিন মাস অন্তর আমি মুনাফার টাকা তুলি। কিন্তু গত মাসে ঈদের ব্যস্ততার কারণে মুনাফা তুলতে আসিনি। হঠাৎ শুনেছি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। তাই আগামী ৩০ জুনের আগে মুনাফার অর্থ না তুললে নাকি ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ হারে কর কাটা হবে। তাই টাকা তুলতে এসেছি। তার মতো শত শত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারী গতকাল বুধবার সকাল থেকেই মুনাফার টাকা তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে ভিড় করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন। তাদের বেশিরভাগই এসেছেন মুনাফার টাকা তুলতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তারা জানান, দুই সপ্তাহ ধরে গ্রাহক ভিড় করছেন। তবে চলতি সপ্তাহে ভিড় সবচেয়ে বেশি। সবার মনে একটাই প্রশ্ন- ৩০ তারিখের পর থেকে কি বেশি কর কেটে নেবে? যারা মুনাফা তোলেনি তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? আমরা সবাইকে বলছি এ ধরনের কোনো নির্দেশনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) থেকে আসেনি। তারপরও ভয়ে ব্যাংকে ভিড় করছে মানুষ। এতো গ্রাহক সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সকাল থেকে কোনো অবসর নেই।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) মো. মাছুম পাটোয়ারী বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। মানুষ ভয়ে ভিড় করছে। সাধারণ দিনের তুলনায় ৬-৭ গুণ গ্রাহক বেড়ে গেছে। অন্যান্য সময় যেখানে ১০০ টোকেন দেই, এখন সেখানে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টোকেন দিতে হচ্ছে। বাড়তি গ্রাহকের ভিড়ে কর্মী বাড়িয়েও সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ইডি বলেন, অতিরিক্ত দুটি লাইন করেছি। এছাড়া লোকবল বাড়ানো হয়েছে। তিনি জানান, নিয়মে যে কোনো চুক্তি সম্পাদনের সময় যে ক্ষেত্রে যে হার থাকবে, মেয়াদপূর্তি না হওয়া পর্যন্ত সেই হার কার্যকর থাকবে। কিন্ত এসআরও না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয় বলা ঠিক হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের দুটি চিন্তা রয়েছে। এর একটি হচ্ছে- বাজারে প্রচলিত সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর থেকে বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হবে। অথবা শুধু পরিবারভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ওপর তা প্রত্যাহার করা হবে।

সূত্র জানায়, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তবে সবধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর না কি শুধু পারিবারিক ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পাসের দিন তথা ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্ধিত কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করতে পারেন।

এদিকে এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কার্যকর হবে। যারা চলতি নিয়মে ৫ শতাংশ উৎসে কর দিয়ে সুদের টাকা তুলতে চান, তাদের উচিত হবে ৩০ জুনের আগেই সুদের টাকা তোলা। এতে তাদের বাড়তি কর দিতে হবে না।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা তুলতে আসা কয়েকজন জানান, তারা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে সংসার চালান। তারা বলেন, আমরা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে সংসার চালাতাম। সেই টাকাতেও হাত দিয়েছে সরকার। আবার শুনছি পহেলা জুলাইয়ের পর মুনাফা তুললে এতদিন যা পেতাম, তা পাব না। তাই আগের কয়েক মাসের মুনাফা এক সাথে তুলতে এসেছি।

অনেকে মুনাফা তুলে তুলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাসহ অন্য খরচ চালান। এখন কম টাকা পাওয়া গেলে কীভাবে চলবে সেই আশঙ্কার কথা জানান। রোকেয়া নামের একজন গ্রাহক বলেন, পারিবারিক সঞ্চয় পত্র কিনে তার মুনাফা দিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতাম। কিন্তু এখন শুনছি সে টাকা কমে যাবে। তাই ভাবছি কি করে সংসার চালাবো। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে মুনাফা না তুললে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ হারে কর কাটা হবে শুনে টাকা তুলতে এসেছি।

সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের সুদব্যয়ের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদহার থাকায় সঞ্চয়পত্রের দিকে মানুষের আগ্রহ বেশি। সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে ব্যাংকগুলো। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরাও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর দাবি জানাচ্ছে। তাদের দাবি, বেশি সুদ হওয়ায় সবাই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে। পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থার এটা একটি কারণ বলে মনে করেন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী।

বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা সুদের হার এখন ১১ দশমিক শূন্য ৪ থেকে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার এখন ৬ শতাংশের মতো। মেয়াদি আমানতের সুদহার এর চেয়ে একটু বেশি। বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৭৫ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এই সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ছিল ৪৩ হাজার ৪৭৫কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার পুরো অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি নিয়ে ফেলে ১০ মাসেই। সে হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৪৩ হাজার ৪৭৫কোটি টাকা টাকা ঋণ নেয়। অথচ গত বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৪৫ কোটি টাকা করা হয়।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল, কিন্তু বিক্রি কমেনি। এর পরেও দুই দফা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমানো হয়নি।

এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বলেন, উৎসে করের হার বাড়িয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর পক্ষে আমি নই। আমি মনে করি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘পেনশনার সঞ্চয়পত্র’ এবং মহিলাদের জন্য ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ ছাড়া অন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমালে বিক্রির চাপ অনেকটাই কমে আসবে।

সাবেক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী সংসদে বলেন, গ্রামের বিধবা অনেক নারী সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ভরশীল। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে, গাড়ি কেনার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, সেখানে কেন অসহায়দের পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে হাত দিতে হলো।
বিক্রি কমাতে উৎসে কর বাড়ানোর পাশাপাশি গত মার্চ থেকে সঞ্চয়পত্রের সব ধরনের লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন সনদ জমা দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ৩০ জুনের মধ্যে মুনাফা না তুললে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হবে- এমন খবরে ব্যাংকে ব্যাপক চাপ বেড়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত কর্মকর্তাদের অফিস করতে হচ্ছে। গ্রাহক সামলাতে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

https://www.dailysangram.com/post/380592