২৬ জুন ২০১৯, বুধবার, ১১:২৬

স্বদেশ ভাবনা

নির্বাচনে আস্থা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে স্বাভাবিক নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে স্বাভাবিক নির্বাচন বলতে বোঝানো হয়েছে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েরই হোক।

এ বিষয়ে শাসক দল ছাড়া অন্যসব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে মোটামুটি একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিষয়টি সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের কমিশনার মাহবুব তালুকদার ১৯ জুন বলেছেন, এবারের উপজেলা নির্বাচনে সবচেয়ে আশঙ্কার দিক হচ্ছে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা।

একটি গণতান্ত্রিক দেশ ও জাতির জন্য নির্বাচনবিমুখতা অশনিসংকেত। যথোপযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে অবশ্যই সমুন্নত রাখতে হবে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি ১৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

উপজেলা নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মসজিদে ঘোষণা দিয়েও ভোটারদের আনা যায় না। এটা শুধু নির্বাচন নয়, গণতন্ত্রের জন্যও বিপজ্জনক। দু’জনের বক্তব্য অনেকটা অভিন্ন। দেশের মানুষ কেন নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে এবং এ বিপজ্জনক অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

চলতি বছরের ১০ মার্চ শুরু হয়ে ১৮ জুন পর্যন্ত পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হল পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। দেশের মোট ৪৯২টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৪৬৯টি উপজেলা পরিষদে পাঁচ ধাপে নির্বাচন হয়েছে। মেয়াদ শেষ না হওয়ায় অবশিষ্ট ২৩টি উপজেলা পরিষদে পরবর্তীকালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৬৯টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি বিএনপি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ। নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৬৯টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছে ৩৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।

ইতিপূর্বে ২০০৯ সালে ৬৮ দশমিক ৩২ এবং ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬০ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। সবচেয়ে অশুভ লক্ষণ হল, পাঁচ ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ২২৫ জন প্রার্থী বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের সংখ্যা হল যথাক্রমে ১১৫, ৫০ ও ৬০ জন। উপজেলা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোয় গণতন্ত্রের চর্চার অভাবকে নির্দেশ করে। এটা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্যও শুভ লক্ষণ নয়।

পাঁচ ধাপে সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। জাতীয় পর্যায়ে অনেকটা একদলীয়ভাবে এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পক্ষপাতমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকের বেশি সময়ে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় নির্বাচন ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি), ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।

আবার এসব জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না। আর দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় নির্বাচনে কোনো সরকার পরাজিত হয়নি।

স্বাধীনতার প্রথম দু’দশকে অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল গৌণ, মুখ্য হয়ে উঠেছিল দলীয় সরকারের ভূমিকা।

এসব নির্বাচনে দলীয় সরকারগুলো তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে। তাই এসব নির্বাচনের ফল ছিল এক অর্থে পূর্বনির্ধারিত। ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। মানুষ নির্বাচনের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ায় এসব নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।

জনগণ নির্বাচনের ওপর তাদের হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ধীরে ধীরে ফিরে পায়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল যথাক্রমে ৭৫, ৭৪ দশমিক ৯৬ এবং ৮৭ দশমিক ১৩ শতংশ।

নির্বাচনের ওপর ভোটারদের ফিরে পাওয়া বিশ্বাস বেশি দিন স্থায়িত্ব পায়নি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের জুনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে বিএনপির শাসনামলে প্রবর্তিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করে।

উল্লেখ্য, জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর দাবিতে ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সময়কালে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দুর্বার আন্দোলন ও জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের মার্চে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে।

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সমমনা ৮টি দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে। অনেকটা একদলীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার নেমে আসে ৪০ শতাংশে।

একদলীয় দশম জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের ওপর। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন- উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০১৪, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন-২০১৫, পৌরসভা নির্বাচন-২০১৫ এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-২০১৬-এ ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর এজেন্টদের তাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি অনিয়মের মাধ্যমে শাসকদল আওয়ামী লীগ মনোনীত-সমর্থিত প্রার্থীদের একচেটিয়া জয় নিশ্চিত করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ২০১২ সালে গঠিত কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচন বহুদলীয় অংশগ্রহণমূলক হলেও সুষ্ঠু হয়নি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়ম যেমন- নির্বাচনের আগের রাত ব্যালট বাক্সে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে ব্যালটে সিল মারা, সরকারবিরোধী জোটের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, সরকার বিরোধী দল বা জোটের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করা ও পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ দেশে-বিদেশে এ নির্বাচনের ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশায় রয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন অভিযোগের প্রতিবাদে অন্যতম বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, আট দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং আরও কয়েকটি বিরোধী দল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এরই অংশ হিসেবে তারা একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরপরই অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়রের শূন্য পদে এবং ডিএনসিসি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) নবগঠিত মোট ৩৬টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১২টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল মাত্র ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ।

সার্বিকভাবে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি’র উপর্যুক্ত নির্বাচন বহুদলীয় অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং ভোটার উপস্থিতির হার খুব কম হওয়ায় এ নির্বাচনকে ‘নাতিশীতোষ্ণ নির্বাচন’, ‘জনগণের আস্থা হারানোর নির্বাচন’, ‘নিরুত্তাপ নির্বাচন’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে।

সর্বশেষ ১০ মার্চ-১৮ জুন সময়কালে দেশের মোট ৪৯২টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৪৬৯টি উপজেলা পরিষদে পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হল পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল মাত্র ৩৯ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় অনেক কম।

সবশেষে বলতে চাই, স্বাভাবিক নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা ও তাদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গণতন্ত্র রক্ষা ও এর বিকাশে এ চ্যালেঞ্জে আমাদের জয়ী হতেই হবে। এ জন্য যা দরকার তা হল- জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দীর্ঘ ঐতিহ্যের অবসান ঘটিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ২০১৫ সালের সিদ্ধান্ত বাতিল করা।

আশা করি, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবে। তাদের মনে রাখতে হবে, কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/192133