২৬ জুন ২০১৯, বুধবার, ১১:২১

রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বরূপ ও সঙ্কট

ইবনে নূরুল হুদা : সম্প্রতিককালে রাষ্ট্রচিন্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র বিষয়ক মৌলিক ধারণাগুলোর ব্যাখ্যায়ও অভিনবত্ব এসেছে। ফলে রাষ্ট্রের (State) পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ (Political system) শব্দটি। আর রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিয়ে ডেভিড ইস্টন (David Easton) বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো লক্ষ্য স্থির, নিজেকে রূপান্তরিত করার ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের এক সৃজনশীল ব্যবস্থা’ (‘A goal setting, self-transforming and creatively adaptive system’.)। রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো ‘সমাজে উপযোগের প্রভূত্বব্যঞ্জক বরাদ্দ’ (The authoritative allocation of values).

অবশ্য গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (G A Almond) রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিয়েছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। তার মতে, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন একটি পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যা প্রত্যেকটি স্বাধীন সমাজে বিদ্যমান; আর যেখানে বৈধ উপায়ে কমবেশি বল প্রয়োগ করে বা বল প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংহতি সাধন ও নায্যতায় অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিষ্পন্ন করা হয়’। মূলত রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো একটি বৈধ, শৃঙ্খলারক্ষাকারী ও রূপান্তর সাধনকারী ব্যবস্থা’। তবে এক রূঢ় বাস্তবতায় আমাদের দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতালিপ্সা। সঙ্গত কারণেই অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে প্রায় ক্ষেত্রে। রাষ্ট্র কোন কিছুতেই পুরোপুরি শৃঙ্খলা বিধান করতে পারছে না। লঙ্ঘিত হচ্ছে গণমানুষের নিত্যদিনের অধিকার। দেশে আইন আছে নেই যথাযথ প্রয়োগ। অনেক ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগই হচ্ছে বেশি। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার পরিবর্তে ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জননিরাপত্তায় বিঘœ সৃষ্টি করার অভিযোগ ক্রমেই জোরালো ভিত্তি পাচ্ছে। ফলে আমাদের প্রচলিত রাজনীতি গণমানুষের জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠছে না বা পারছে না। রাষ্ট্রও নাগরিকদের জন্য কল্যাণমূখী হয়ে উঠেনি। বস্তুত এটিই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য।

নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে বা ক্ষেত্র বিশেষে উদাসীন থাকছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনস্বার্থের পরিবর্তে অনৈতিকভাবে আত্মস্বার্থ ও ক্ষমতা চর্চার অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি রীতিমত চোখে পড়ার মত। জনজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের হলেও জনগণ সে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতিকে যেভাবে প্রস্তুত করা দরকার ছিল সেখানেও ব্যর্থতার ছাপটা সুস্পষ্ট। ফলে আমরা জাতি হিসেবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বেশ পশ্চাদপদ। আর আমাদের এই পশ্চাদপদতা ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না বরং ক্রমেই এর পরিসরটা বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আমাদের এই পশ্চাদমুখীতার গন্তব্য যে কোথায় তা নিশ্চিত করে বলা বেশ কষ্টসাধ্যই বলতে হবে।

রাষ্ট্রের পৌণপৌণিক ব্যর্থতা, প্রচলিত রাজনীতির কক্ষচ্যুতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও সুশাসনের অনুপস্থিতিই আমাদের এই জাতীয় বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়। ফলে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। নাগরিকরা আশ্রয় গ্রহণ করতে পারছে না। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডও এখন শুধু ক্রমবর্ধমানই নয় বরং লাগামহীন। ঘটনার পর নিহতদের কুখ্যাত, ভয়ঙ্কর অপরাধী কিংবা ডাকাত দলের সর্দার তকমা দেয় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব অভিযোগের ভিত্তি খুবই দুর্বল। অভিযোগ রয়েছে সব কিছুই ঘটছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। অথচ আমাদের দেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন খুবই যৎসামান্য।

সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘The Republic shall be a democracy in which fundamental human rights and freedoms and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed’. অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে’।

সংবিধান অনুসরণ করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ নাগরিকের সকল অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার সে দায়িত্ব পালনে কতখানি সক্ষম বা আন্তরিক তা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। আর এই প্রশ্নের যৌক্তিকতার ভিত্তিটাও বেশ জোরালো। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারাদেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক মনে করার কোন সুযোগ থাকছে না বরং ক্রমেই পরিস্থিতি অবনতিই ঘটছে। যা আমাদের রাষ্ট্রীয় কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড। ফলে জনজীবন হয়ে উঠছে রীতিমত দুর্বিসহ। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট ৪৬৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন মাদকবিরোধী অভিযানের সময়। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) এর পক্ষে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন ১৬২ জন। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী গত এক বছরে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ২৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংস্থাটি আরও বলেছে, ২০১৮ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৩২টি, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে ও ৭ জন ধর্ষিতা আত্মহত্যা করেছেন। ১ হাজার ১১ জন শিশু নিপীড়নের শিকার হয়েছে। নিপীড়নের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৮৩টি ও আত্মহত্যা করেছে ১০৮ শিশু। পুলিশের সংগে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৬৭ জন। নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৩৪ জন। যা রীতিমত উদ্বেগজনকই বলতে হবে।

এসব অভিযোগ আরও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে। গত ৫ জুন প্রকাশিত দেশটির বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ওঠা সহিংসতা ও কারচুপির অভিযোগকে ‌’বিশ্বাসযোগ্য’ বলেছে এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশের উদারনৈতিক অবস্থানের প্রশংসা করা হলেও গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেড়ে যাওয়া এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিবেদন ২০১৮’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন সূচনাতেই বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণতন্ত্রের সুরক্ষা দুর্বল হয়েছে। গুম, ধর্মীয় স্বাধীনতা বা বিশ্বাস এবং আধুনিক দাসপ্রথার মতো বিষয় যুক্তরাজ্য খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন নিয়ে যে শুধু বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর অভিযোগ তুলেছে এমন নয় বরং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল মহল থেকেই এই নির্বাচন নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নির্বাচনকে প্রহসন বলে অভিহিত করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) ৫০টি আসনে জরিপ করে নির্বাচনকে ‘অভূতপূর্ব’ ও ‘অবিশ্বাস্য’ বলে অভিহিত করেছে। টিআইবি ৪৭টি সুনির্দিষ্ট অনিয়ম চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল দেওয়া, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ না দেওয়া। অনেক ভোটারের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারা, বুথ দখল করে প্রকাশে সিল মারা, জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট শুরুর আগে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, ভোট শেষের আগে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, গণমাধ্যমের জন্য ‘অভূতপূর্ব’ কঠোর নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। যা আমাদের দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের দিকেই অঙ্গলী নির্দেশ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে গুম ও অপহরণের প্রবণতাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন তোলার পরও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি বরং সার্বিক পরিস্থিতি বেশ অবনতিশীল। আর সরকার তো এ অভিযোগ অস্বীকার করেই দায়িত্ব শেষ করছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। মূলত, গুম বা অপহরণ উভয়টিই গুরতর ফৌজদারি অপরাধ। সরকার পক্ষে অবশ্য এসব ঘটনাকে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ বলে দাবি করা হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। কিন্তু কেউ স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হলে তাদেরকে খুঁজে বের করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ভিকটিমের পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানানোর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনভাবেই এড়াতে পারে না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের নিলির্প্ততা জনমনের সন্দেহ-সংশয়কে আরও জোরালো করেছে। অভিযোগ করা হচ্ছে যে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা মদদেই দেশে এসব অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে। তাই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা এসব নিয়ে একেবারেই উদাসীন। অভিযোগটি সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে।

মূলত রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর তা করতে হবে সম্পূর্ণ আইনানুগ ও সাংবিধানিক পন্থায়। কিন্তু এভাবে হত্যা, গুম ও অপহরণ করে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সমাধান করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। দেশের বিচারব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সন্ত্রাসী বের হয়ে যাবে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মহোৎসব চলছে সারাদেশে বলে অভিযোগ। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, অপরাধী যত ভয়ঙ্করই হোক আইনী আশ্রয় ও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার সকলেরই আছে। আর এ অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। কিন্তু বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী না করে এভাবে মানুষ হত্যার মহড়া কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বরং তা রাষ্ট্রের কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদেরকে এই বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।

আসলে রাষ্ট্র বা ক্ষমতার প্রয়োজনে এমন হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বলে মনে করছেন আত্মসচেতন মানুষ। এটা রাষ্ট্রের চরিত্র, কোনো গোষ্ঠীর বিষয় নয়। কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রেও ঘাটতি থাকলে এই ধরনের হত্যাকান্ড হয়ে থাকে বলেই মনে করে অভিজ্ঞমহল। শুধু নির্বাচন থাকলেই যে দেশে গণতন্ত্র বহাল থাকে বিষয়টা এমন নয়। যার প্রমাণ গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। মূলত রাষ্ট্র উদারনৈতিক জনকল্যাণমূলক হলেই তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে। আর গণতন্ত্রের এই ধরনের চর্চা না করার কারণে কিংবা কার্যকর করতে না পেরে রাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব হবে দীর্ঘ মেয়াদি। যা কারো জন্যই কল্যাণকর হবে বলে মনে হয় না।

মূলত চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে হঠকারিতা ও উদাসীনতার অভিযোগটাও বেশ জোরালো। এসব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগও কম নয়। অথচ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকের নিরাপত্তাসহ সকল অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার একদিকে যেমন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করতে পারছে না। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই জীবন-ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে’। কিন্তু রাষ্ট্র এসব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না।

অনুচ্ছেদ ৭ এ বলা হয়েছে, ‘আইনের কাছে সকলেরই সমান এবং কোনরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সকলেরই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের লঙ্ঘনজনিত বৈষম্য বা এরূপ বৈষম্যের উস্কানির বিরুদ্ধে সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার সকলেরই আছে’।

যেকোন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সাময়িক সুবিধা অর্জন করা গেলেও তা কোন সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনে না বরং প্রতিহিংসা প্রতিহিংসারই জন্ম দেয়। তাই যেকোন সমস্যা সমাধানে সরকারকে বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী হওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। জনগণও সরকারের কাছে এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করছে।

মূলত প্রত্যেক মানুষের রয়েছে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা, ভোট প্রদান, চিন্তার ও বাক-স্বাধীনতার অধিকার। প্রতিটি মানুষেরই চায় সামাজিক নিরাপত্তা, বিশ্রাম, বিনোদন ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কর্মসৃষ্টি, কর্মের অনুকূল পরিবেশ ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার। ভোটের অধিকার, রাজনীতি করার অধিকার, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকারসহ নানাবিধ মৌলিক অধিকারই একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য মানবাধিকার। রাষ্ট্র থাকলে নাগরিক থাকবে, রাজনীতি ও রাজনীতিক থাকবে, সরকার গঠনের পদ্ধতি থাকবে, মতবাদ থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে; রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত এসব বিষয়ে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ থাকবে। মানুষ স্বাধীনভাবে যার যার অবস্থান থেকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এসব করতে পারার নাম গণতন্ত্র। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান খুবই ভঙ্গুর ও হতাশাব্যঞ্জক।

বস্তুত, আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হচ্ছে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি উদাসীন হওয়ার কারণে রাশিয়া ভেঙেছে। একই কারণে বহু নগর রাষ্ট্র ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়েছে। বর্তমান বিশ্বেও মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত না থাকায় বিশ্বপরিস্থিতিও আজ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল ভূখন্ড মানবাধিকারহীন অগণতান্ত্রিক হিংসার আগুনে পুড়ে ছাই হতে চলেছে। এ ছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো গণতন্ত্রহীন স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসবাদের চক্রান্তে জড়িয়ে যাচ্ছে। যা বিশ্ব পরিস্থিতিকে ক্রমেই আশান্ত ও অস্থির করে তুলছে।

মূলত রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে নাগরিকদের সকল ধরনের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। আর মানবাধিকার ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র হরণ ও গণমানুষের অধিকার ক্ষুন্নের অভিযোগটা বেশ জোরালো। সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এখনও মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও বিকশিত হয়নি। মানবাধিকারের বিষয়টিও এখনও প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে। আমাদের মূল সঙ্কট ও সমস্যা সেখানেই। তাই রাষ্ট্রও পুরোপুরি সফল ও সফল হয়ে উঠতে পারেনি। গণমানুষের অধিকারও নিশ্চিত হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য তো সেখানেই।

inhuda71@gmail.com

https://www.dailysangram.com/post/380472