২৬ জুন ২০১৯, বুধবার, ১০:৪৬

বাজেট কার্যকর এখনও হয়নি ॥ ভ্যাটের আগুনে জ্বলছে বাজার

এইচ এম আকতার: বাজেট মানে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। একদিকে ভ্যাটের বোঝা জনগণের ঘাড়ে। অন্যদিকে জীবনযাত্রায় ব্যয়বৃদ্ধি। ৯ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট উপস্থাপনের পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠতে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের বাজার। ভ্যাটের আগুনে জ্বলছে বাজার। নিয়মানুয়ায়ী ১ জুলাই থেকে বাজেট কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সরকারের মনিটরিং না থাকায় অস্থির বাজার। এতে তৎপর হয়ে উঠেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরকার ব্যস্ত রয়েছে বাজেট আলোচনা নিয়ে।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুড়া দুধ, সিগারেটসহ বাজেটে যেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে তা পর দিন থেকেই প্রস্তাবিত দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু যেসব পণ্যের দাম কমার প্রস্তাব করা হয়েছে সে সব পণ্যের দাম এখনও কমানো হয়নি। তা ১ জুলাই থেকেই কার্যকর করা হবে। এ নিয়ে সরকারের কোন বাজার মনিটরিং নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র।

নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন। এতে ঘোষণা করা সম্পূরক শুল্ক, আমদানি পর্যায়ে সব কর, শুল্ক ও ভ্যাট সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাটের নতুন হার কার্যকর হবে আগামী মাস, অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে। যদিও অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমরা ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটটিতে দেশের জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে, তেমন কোনো উপকরণ অন্তর্ভুক্ত করি নাই।

বাজেট ঘোষণার পর বাজারে চিনির দাম প্রায় ৩ টাকা ও ভোজ্যতেলের দাম প্রায় আড়াই টাকা বেড়েছে। বাড়বে শিশুখাদ্যের দামও। গুঁড়া মসলা, ভালো মানের বিস্কুট, কেক, ফলের রস, আচার ও আইসক্রিম থাকতে পারে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায়। খাবার খাওয়ার জন্য তৈজসপত্র কিনতে বাড়তি টাকা লাগবে। পোশাকেও আগের চেয়ে বেশি হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) দিতে হবে। যাতায়াতেও আগের চেয়ে কিছুটা খরচ বাড়তে পারে।
এসব ব্যয়ের কথা স্বজনকে জানাবেন, সেখানেও বাড়তি কর চেপেছে। মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করেছে অপারেটরেরা। ফলে এখন থেকে মুঠোফোনে কথা বলার ওপর কর দাঁড়াল মোট ২৭ শতাংশ। এর মানে হলো, আপনি যদি ১০০ টাকা রিচার্জ করেন, তাহলে ২২ টাকার মতো যাবে সরকারের কোষাগারে। যারা ফিচার ফোন থেকে স্মার্টফোনে উন্নীত হয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চান, তাদের স্মার্টফোন কেনার খরচ অনেক বেশি বাড়বে।

এসব গেল কর-ভ্যাটের কারণে প্রত্যক্ষভাবে বাড়তি ব্যয়ের হিসাব। আরও কয়েকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে শুরুতেই আসবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। এ খাতে যে বিপুল ভর্তুকি লাগবে, তা বাজেটে রাখা হয়নি। অবশ্য দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাজেটের আগেই এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

দ্বিতীয় আরেকটি উপায়ে চাপ আসতে পারে। সেটি হলো, ঢাকার পাইকারি ও বড় খুচরা বিক্রেতারা আগে বছরে ২৮ হাজার টাকা প্যাকেজ ভ্যাট দিয়ে মুক্তি পেতেন। তারা গ্রাহকের কাছ থেকে আলাদাভাবে ভ্যাট আদায় করতেন না। এখন তাঁদের ৪ শতাংশ লেনদেন কর দিতে হবে। যেসব দোকানে দৈনিক ২০ হাজার টাকা বিক্রি, তার লেনদেন কর আসে মাসে ২৪ হাজার টাকা। এ টাকাটা আর তিনি পকেট থেকে না দিয়ে গ্রাহকের ওপর চাপাবেন। এতে পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে।

মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় অনেক পণ্য থাকলেও কমার তালিকায় উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। গরিবের রুটি-বিস্কুট, কৃষিযন্ত্র, বজ্রপাত সুরক্ষাসামগ্রী, ক্যানসারের ওষুধ ও গাড়ির ব্রেকের দামে ইতিবাচক কিছু প্রভাব ফেলতে পারে এবারের বাজেট।

তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে সরকারের নজরদারি রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অপারেশন চলছে। কোনও অনিয়ম চোখে পড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা বলছেন, বাজেট পাসের আগে বাড়তি শুল্কের দোহাই দিয়ে পণ্যের দাম বাড়তে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজেট ঘোষণার পর থেকেই বাজারে বাড়তে শুরু করেছে আটা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গুঁড়ো দুধ, চিনি, মসুর ডাল, ডিম ও মসলার দাম। বেড়েছে সিগারেটের দাম। বাদ যায়নি চালের দামও। এসব পণ্যের মধ্যে দেশীয় শিল্প রক্ষায় আমদানি করা অপরিশোধিত চিনি, গুঁড়ো দুধের ওপর শুল্ক বাড়ালেও কোনও ধরনের ট্যাক্স আরোপ করা হয়নি পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আটা ও চালের ওপর। এরপরও এসব পণ্যের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ১৫ টাকা। ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, বাড়তি শুল্কে আনা কোনও পণ্যই তো বাজারে আসেনি। বাজেটও কার্যকর হয়নি, হবে ১ জুলাই থেকে। বাজারে যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে তা আগের শুল্কে আনা। অথচ বাজেট অনুমোদনের আগেই নানা অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়েছে।

তারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে পারে। আরোপিত শুল্কের হার কমতে বা বাড়তে পারে। চাল, আটা, ডিম ইত্যাদির দামও বেড়েছে, যেগুলোর ওপর কোনও শুল্ক নেই।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৫ টাকা। মোটা চালের দাম ৩৫ থেকে বেড়ে ৩৭ টাকা হয়েছে। নাজির শাইল ও মিনিকেট নামের সরু চালের দাম ৫৫-৫৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। নামিদামি কোম্পানির প্যাকেটজাত সরু চালের কেজি ৭০ টাকা ছুঁয়েছে।

বাজেটের সঙ্গে কোনও যোগসূত্র না থাকলেও ৩৩ টাকা কেজি দরের প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। ৮০ টাকার আদা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা দরে। ৬০ টাকা কেজিদরের রসুন হয়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। একইভাবে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। ৪৭ টাকা কেজিদরের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৬ টাকায়। হালিতে ডিমের দাম বেড়েছে ৬ টাকা। মহল্লা বিশেষে এ দাম আরও বেশি।

এবারের বাজেটে নতুন করে চিনির যে করহার বাড়ানো হয়েছে, তাতে চিনির দাম বাড়বে ৫ টাকা। এতে চিনির ওপর মোট করভার দাঁড়াচ্ছে ২১ টাকা (এখনকার মূল্যে)। নতুন বাজেটের কারণে সয়াবিন তেলের ওপরও ৩ টাকার মতো বাড়তি কর দাঁড়াবে। পাইকারি বাজারের পর বড় খুচরা বাজারে চিনির দাম বাড়তে শুরু করেছে। কারওয়ান বাজারে গতকাল মঙ্গলবার প্রতি কেজি চিনি ৫৪-৫৫ টাকা চান বিক্রেতারা, যা আগে ৫২-৫৩ টাকা ছিল।

একইভাবে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে কেজিপ্রতি ৮০ টাকায় উঠেছে, যা আগের চেয়ে ২ টাকা বেশি।
বাজেটে গুঁড়া দুধ আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বিদেশ থেকে আমদানি করা গুঁড়া দুধের দাম বাড়তে পারে। আইসক্রিমের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অলিভ অয়েলের দাম বাড়বে শুল্ক হারের কারণে।

গুঁড়া মসলা, বিস্কুট, কেক, ফলের রস, আচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভ্যাটের বোঝা বাড়বে। যেমন মরিচ, ধনিয়া ও হলুদের গুঁড়ার দাম আগে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা ধরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসত। এতে গুঁড়া মসলার ওপর ভ্যাট দাঁড়াত কেজিতে ৬ টাকা। এখন এর প্রকৃত মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসবে। এতে ৩০০ টাকা কেজি হলে ভ্যাট আসবে ১৫ টাকা। এভাবে একটু বেশি দামি বিস্কুট, কেক, ফলের রস, সরিষার তেল, সস ইত্যাদির ওপর ভ্যাটের চাপ বাড়তে পারে।

যেমন শরীরের দুর্গন্ধ দূর করতে খরচ বাড়বে। ব্যক্তিগত ডিওডরেন্টের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। বোতল, ফ্লাস্ক, জার, পট ইত্যাদির ওপর নতুন করে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি তৈজসপত্রের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।

ওভেন, কুকার, কুকিং প্লেট, গ্রিলার, রোস্টার ইত্যাদির ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে রান্নার তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দামও বাড়ছে। আগে এতে ভ্যাটের ভার ছিল ৯ টাকা। এখন মোট ৫০ টাকার মতো বাড়তি কর ভার দাঁড়াচ্ছে। কারণ, এলপি ১২ কেজির সিলিন্ডারের গ্যাসের দাম ৬০ টাকা ধরে আগে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হতো। এখন প্রকৃত মূল্য, অর্থাৎ ৯০০ টাকার ওপর ভ্যাট হবে ৫ শতাংশ। এ ছাড়া সরবরাহ ও খুচরা বিক্রেতা পর্যায়েও লেনদেনে কর বসবে।

এবারের বাজেটে কর কাঠামোর কারণে মানুষের ওপর চাপ পড়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, আমরা চাইছিলাম এর উল্টো। আমদানি শুল্ক ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা যেত। সীমিত আয়ের মানুষকে আয়করেও কিছু ছাড় দেওয়া যেত। তিনি বলেন, এনবিআরকে সরকার যখন বাড়তি রাজস্বের লক্ষ্য দেয়, তখন কোনো ধরনের প্রভাব সমীক্ষা ছাড়া কর আরোপ করতে দেখা যায়। এটা হওয়া উচিত নয়।

জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সহসভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বাজেট পাসের আগে অতিরিক্ত দাম আদায় করা অনৈতিক। যে পণ্যে শুল্ক আরোপ করাই হয়নি, সেটি শুল্কের দোহাই দিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা পুরোপুরি অনৈতিক। এটি ঠিক নয়। যদি কেউ করে থাকে তাহলে সে আইনের চোখে অপরাধী।

তিনি বলেন, যে পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বা ডিউটি বেড়েছে, সেসব পণ্য নতুন শুল্কহারে আমদানি না হওয়া পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে না। মোট কথা, বেশি দামে আনলে বেশি দামে বিক্রি করবেন, কম দামে আনলে কম দামে বিক্রি করবেন। এর ব্যতিক্রম রীতিমতো অন্যায়।

https://www.dailysangram.com/post/380475