২৪ জুন ২০১৯, সোমবার, ১০:৪৩

গবেষণা প্রতিবেদন

বেতন বাড়লেও কমেনি দুর্নীতি : টিআইবি

সম্পদের হিসাব নেয়া হচ্ছে না * দীর্ঘসূত্রতার কারণে ২৩ শতাংশ পদই খালি * পদোন্নতির ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার * বাড়ছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রবণতা * টিআইবি’র ৯ দফা সুপারিশ

রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার চর্চা সঠিকভাবে হচ্ছে না। এ কারণে দুর্নীতি প্রতিরোধ, সুশাসন, জবাবদিহিতা তৈরি হচ্ছে না বলে এক প্রতিবেদন বলেছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির মতে, বিভিন্ন প্রণোদনায় শুদ্ধাচার বৃদ্ধির পথে বাস্তব কোনো অগ্রগতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হলেও দুর্নীতি কমছে না।

সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি সুবিধা বাড়ানো হলেও তারা নিজেদের গাড়ি ব্যবহার না করে পরিবহন পুলের গাড়ি ব্যবহার করছে। ক্যাডার সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য থাকায় তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে।

রোববার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে ‘জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার : নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়। জনপ্রশাসনের শুদ্ধাচার বাস্তবায়নে বিদ্যমান আইনি কাঠামো ও চর্চা পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে ৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরে টিআইবি।

গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মহুয়া রউফ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ট্রাস্টি বোর্ডের মহাসচিব অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, টিআইবির পরিচালক রফিকুল হাসান, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম প্রমুখ।

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার নীতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি বছর সম্পদের হিসাব দেয়ার কথা থাকলেও তারা দিচ্ছেন না। প্রতি বছর নিয়মিতভাবে শূন্যপদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নিশ্চিত করার কথা থাকলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ২৩ শতাংশ পদ খালি থাকছে। প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতার কারণে সিনিয়র সহকারী থেকে সমপর্যায়ের পদে ২৭ শতাংশ এবং সহকারী সচিব বা সমপর্যায়ের পদে ২৯ শতাংশ পদ শূন্য থাকছে। সাম্প্রতিক সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এসব নিয়োগের বেশির ভাগই যোগ্যতার পাশাপাশি ক্ষমতাসীনের ইচ্ছায় হচ্ছে। বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক সিলেকশন বোর্ডের সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে। গোয়েন্দা রিপোর্টকে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, তাতে আর্থিক লেনদেন এবং কে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের রিপোর্টে সেই বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সরকারের বাইরে বিভিন্ন দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী কর্মকর্তাদের ওএসডি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্কোরকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে জনপ্রশাসনের শুদ্ধাচার কিছু কিছু স্থানে বাস্তবায়ন হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা উপেক্ষিত হয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ায় তারা অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছেন। ১১টি শুদ্ধাচার কৌশলের মধ্যে মাত্র ৫টি বাস্তবায়ন হলেও শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে, বাকিগুলোর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮-তে কাউকে আটক করতে হলে তার নিয়োগ প্রদানকারীর অনুমোদন নেয়ার বিষয়টি সংবিধান লঙ্ঘন করে। এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রবণতা বেড়ে যায়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের কথা বলা হয়। সেগুলো হল- প্রতি বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণ প্রদান, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন বাস্তবায়ন, পাবলিক সার্ভিসে অভিযোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তন, বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন পদ্ধতি, প্রণোদনা ও পারিতোষিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রতি বছর নিয়মিতভাবে শূন্য পদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নিশ্চিত করা, সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মকালীন প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, জ্যেষ্ঠতা, কৃতী, জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি, সরকারি সেবায় ই-গভর্নেন্স প্রবর্তন এবং যৌক্তিক বেতন কাঠামো ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান। এর মধ্যে পাঁচটির চর্চা সন্তোষজনক। সেগুলো হল- প্রণোদনা ও পারিতোষিক, প্রশিক্ষণ, সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন, যৌক্তিক বেতন কাঠামো এবং ই-গভর্নেন্স। তিনটি কৌশলের চর্চা শুরুই হয়নি। সেগুলো হল- বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন পদ্ধতি, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন বাস্তবায়ন এবং কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা।

টিআইবির সুপারিশ : প্রতিবেদনে টিআইবি যেসব সুপারিশ তুলে ধরে তা হল- সরকারি কর্মচারী আইন-১৯৭৯ শুদ্ধাচার কৌশলের আলোকে হালনাগাদকরণ, আয়কর প্রদানের বাইরে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রদানে সুনির্দিষ্ট ডিজিটাল কাঠামো তৈরি করে সে অনুযায়ী বার্ষিক সম্পদের হিসাব নিশ্চিতকরণ, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮-এ সংবিধানপরিপন্থী ও ঝুঁকিপূর্ণ ধারা বাতিল, এ আইনে সরকারি ধারাটি পরিবর্তন করে প্রজাতন্ত্র শব্দ যুক্ত, জনপ্রশাসনের উচ্চপদগুলোর শূন্যপদের বিপরীতে অতিরিক্ত নিয়োগ না দিয়ে নিচের পদগুলো পূরণ, পদোন্নতিতে বৈষম্য দূর করে সব ক্যাডারকে সমান সুযোগ দেয়া, প্রশাসন ক্যাডার থেকে টেকনিক্যাল ক্যাডার না দিয়ে টেকনিক্যাল দক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্বে বসানো, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্কোর ও দক্ষতা মূল্যায়ন করে পদোন্নতি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে তা কার্যকারণ ও তথ্য প্রকাশ আইন-২০১১ বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির সুপারিশ পেশ করা হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/191280