২২ জুন ২০১৯, শনিবার, ১২:০৩

অপরাধ যখন অপ্রতিরোধ্য

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

যখন রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব হয়নি, তখন সভ্যতাও ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। কারণ, রাষ্ট্র নামক সংঘের মাধ্যমেই মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। প্রাগৈতিহাসিককালে মানুষের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ ছিল না। পেশিশক্তিই ছিল সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। মূল্যবোধের বিষয়টিও ছিল অচিন্তনীয়। শক্তি-সামর্থ্যরে যথেচ্ছ অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতাকে অপরাধ বা অন্যায় মনে করা হতো না। ফলে দুর্বল ও পশ্চাৎপদরা ছিল নিগৃহীত ও অধিকার বঞ্চিত।

বস্তুত, সভ্যতাপূর্ব সময়ে অপরাধই ছিল না। কারণ, অপরাধ কী তা তখনো সংজ্ঞায়িতই হয়নি। কিন্তু মানবচিন্তা-চেতনার ক্রমবিবর্তনের ফলেই মানুষের কিছু কাজকে অপরাধ বা গর্হিত বলে মনে করা শুরু হয়েছে। সূচনালগ্নে তা সীমিত পরিসরে থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা আরো পরিশীতিল হয় এবং অপরাধের পরিধিও বাড়ে। ফলে অপরাধ প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। আর তা প্রতিবিধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও শুরু হয়। এসব প্রক্রিয়ার ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে তা এখন আধুনিকতা-উত্তর পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং আমরা এর রীতিমতো সুবিধাভোগী।

তাই আইনের পরিভাষায় অপরাধকে ‘সভ্যতার অবদান’ বলা হয়। কারণ, সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথেই অপরাধকে সংবিধিবদ্ধ করা হয়েছে। আর অপরাধ যখন সংজ্ঞায়িত হলো তখন অপরাধপ্রবণতাকে সীমিত পর্যায়ে রাখা বা প্রতিবিধানের আবশ্যকতাও দেখা দেয়। এই আবশ্যকতা থেকেই রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ। কালের বিবর্তন ও সময়ের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয়ে এখন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হয়েছে। বর্তমান সময়ে তা অনেকটা সফলতাও পেয়েছে বলা যায়। যদিও তা পরিপূর্ণ নয়।

যেসব দেশে জনজীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রে সহযোগী অঙ্গগুলো ক্রিয়াশীল থাকে, সেসব দেশে অপরাধপ্রবণতা সীমিত ও সহনীয় পর্যায়ে রাখা খুবই সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে অপরাধপ্রবণতা একেবারেই লাগামহীন। এতে প্রতীয়মান হয়, আমাদের দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও রাষ্ট্রযন্ত্র যথাযথভাবে ক্রিয়াশীল ও কার্যকর নয়। আর রাষ্ট্রের এই নির্লিপ্ত ও উদাসীনতার সুযোগে দেশে অপরাধপ্রবণতা ফুলে-ফলে একেবারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে বলা যায়। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অপরাধীর শাস্তিÍ না হওয়ায় আমাদের দেশের অপরাধপ্রবণতা ক্রমবর্ধমানই বলতে হবে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীদের শাস্তি হয় না, বরং ক্ষেত্রেবিশেষে চিহ্নিত অপরাধীরা বিভিন্নভাবে আনুকূল্যও পেয়ে থাকে।

আমাদের দেশে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চা ও সংস্কৃতি চালু না থাকায় এর জন্য প্রধানত দায়ী রাজনীতিকেরা। দেশে রাজনীতি এখনো জনবান্ধব হয়ে উঠেনি, বরং তা শ্রেণিবিশেষ ও গোষ্ঠী বিশেষের উচ্চাভিলাস চরিতার্থের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে প্রচলিত রাজনীতি থেকে নাগরিকরা যেভাবে উপকৃত হওয়ার কথা, সেভাবে উপকৃত না হয়ে রাজনৈতিক কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রচলিত রাজনীতি শ্রেণিবিশেষের জন্য মনোরঞ্জিকা হলেও সাধারণ মানুষের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। উপকৃত হচ্ছে এক শ্রেণীর টাউট-বাটপার ও রাজনৈতিক ফড়িয়ারা।

সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক শক্তিগুলো সাধারণ মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। ক্ষমতাসীনেরাও জনগণের স্বার্থে কাজ করার পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য তাদের সব মেধা, মনন, মনোযোগ ও শক্তি কাজে লাগাচ্ছে। যারা ক্ষমতার বাইরে তাদেরও ধ্যান-জ্ঞান ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। ফলে একদিকে সরকার জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে, অন্য দিকে অপরাপর রাজনৈতিক শক্তিগুলোও জনগণের কল্যাণে তেমন কিছুই করতে পারছে না। কিন্তু এ অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করা যাদের দায়িত্ব তারা সঠিক কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে অপরাধপ্রবণতা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্যই। এ বিষয়ে কোনো পক্ষকে ত্রাতার ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না, বরং একটা অনাকাক্সিক্ষত উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গণসচেতনতার অভাবও উপেক্ষা করার মতো নয়।
সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশ এখন অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে বলা যায়। দেশে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, রাজনৈতিক নিপীড়ন, গুপ্তহত্যা, গুম ও অপহরণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। রাষ্ট্র তার প্রতিকার বা প্রতিবিধান করতে পারছে না। এমনকি জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অধিক স্বেচ্ছাচারী, অনিয়ম প্রবণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতিমুক্ত নয় বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই পৃথিবীজুড়ে শান্তি বাড়লেও বৈশ্বিক শান্তি সূচকে বাংলাদেশের বড় ধরনের অবনমন ঘটেছে। এ জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ক্রমবর্ধমান অপরাধ ও অপরাধপ্রবণতাকে দায়ী করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকনোমিকস অ্যান্ড পিস প্রকাশিত বৈশ্বিক শান্তি সূচক ২০১৯ অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবনতি হয়েছে আমাদের। সিডনিভিত্তিক এ সংস্থাটি সম্প্রতি তাদের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এবার গতবারের তুলনায় ৯ ধাপ পিছিয়ে ১০১তম অবস্থানে রয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৩তম।

দেশে যে অপরাধ ও অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণহীন পড়েছে, তা চলতি বছরের ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান থেকে উপলব্ধি করা যায়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম সাড়ে তিন মাসে ৩৯৬ জন নারী-শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। খোদ পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের মামলা হয়েছে এক হাজার ১৩৯টি এবং হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫১টি। বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ৪৭ শিশুর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৩৯ জন। শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

উপরের আলোচনা থেকে দেশে অপরাধপ্রবণতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্রই ফুটে উঠেছে। যা একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দেশে যত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এর নজির বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিবিধানে রাষ্ট্র বা সরকারের কার্যকর কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি। কোথাও কোথাও ছোটখাটো তৎপরতা লক্ষ করা গেলেও সেসব ক্ষেত্রে সাফল্য একেবারে নেই বললেই চলে। মূলত রাষ্ট্র বা সরকার এ বিষয়ে সক্রিয় থাকলে অপরাধপ্রবণতার এই লাগামহীন জয়জয়কার কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।

আসলে জাতি হিসেবে আমরা কোনো পাপের প্রায়শ্চিত্য করছি কি না তা কোনোভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সেন্ট অগাস্টিন মনে করেন, রাষ্ট্র হলো মানুষের আদি পাপের ফল। রাষ্ট্রীয় জীবনের মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্য সম্পন্ন হলে মানুষ আবার স্বর্গরাজ্যের যোগ্য হয়ে ওঠে। তাই আমাদের এই প্রায়শ্চিত্যটা কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলার খুব একটা সুযোগ থাকছে না। তাই আমাদের পক্ষে স্বর্গরাজ্যের আশা করাটা সঙ্গত হবে না, বরং আমাদের অনাদিকাল পর্যন্ত নরকরাজ্যের যন্ত্রণা ভোগ করতে হবেÑ সার্বিক পরিস্থিতি সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছে।

সেন্ট টমাস অক্যুনাসের ভাষায়, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে নৈতিক মানের ঔজ্জ্বল্যে। তাই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হবে সীমিত এবং তা আইনের সীমারেখায় হবে আবর্তিত। যে সরকার আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয় না, তা অবৈধ ও পীড়নমূলক। অবশ্য সরকারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আর তেমন কিছুই তিনি বলেননি। তিনি রোমান আইনের সাথে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু আইনের ওপরও সার্বভৌমের ক্ষমতা বিস্তৃত হতে পারে সে সম্পর্কে কিছুই বলেননি। পোপ ও রাজকীয় শক্তির দ্বন্দ্ব সম্পর্কে তৎকালীন সাহিত্যে যা লেখা হয়েছিল, সে সম্পর্কেও তিনি অবহিত ছিলেন। তথাপি তিনি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সঠিক ভিত্তি সম্পর্কে বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হননি।

মূলত শাসকগোষ্ঠী ও দেশের রাজনৈতিক শক্তি দেশের মানুষকে বন্ধু মনে করতে পারছে না, বরং তাদের বরাবরই প্রতিপক্ষই ভাবা হচ্ছে। তাই আমাদের দেশের রাজনীতি এখনো গণমুখী হয়ে উঠেনি। উপর্যুপরি রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই জনগণ ক্রমেই রাজনীতিবিমুখ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আর দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে রাজনীতিবিমুখ রেখে কোনোভাবেই জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়।

মূলত জনগণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের এমন ভ্রষ্ট ও অযৌক্তিক মূল্যায়ন আমাদের জাতিসত্তাকে হীনবল করে ফেলেছে। তাই জনজীবনে সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণকে আস্থায় এনে গণমুখী রাজনীতির সূচনা করতে হবে। লাগাম টেনে ধরতে হবে অপরাধ ও অপরাধসংশ্লিষ্টদের। আর এভাবেই রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। অন্যথায় আমাদের সব অর্জনই ব্যর্থ হতে বাধ্য।

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/419338