২২ জুন ২০১৯, শনিবার, ১১:৫৬

মানুষের কান্নার সঙ্গে প্রকৃতিও কাঁদে

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : একটি নির্জন কুঁড়েঘর। বলাইরহাট। মল্লিকপুর। পীরগঞ্জ। ঠাকুরগাঁও। হাটের খুব কাছের এ জীর্ণ কুঁড়েঘরটিতেই একা থাকতো বাবা। আমিও ছোটবেলা মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দিন এখানে বাবার সঙ্গে থেকেই স্কুলে পড়েছি; যা অনেকের কাছে ভাবনারও অতীত।

একদিন তামলাইদীঘির কাছে এক আমগাছে ওঠে বাবা শুকনো লাকড়ি ভাঙতে। হঠাৎ পা ফসকে পড়ে যায় গাছ থেকে নিচের শক্ত মাটিতে। ওপর থেকে পড়বার সময়ও ডালে লেগে হয়তো মারাত্মক আঘাত লাগতে পারে।
অজ্ঞান অবস্থায় পড়েই ছিল বাবা। এলাকার কয়েকজন অনেকক্ষণ পর দেখলে বাবাকে ধরাধরি করে নিয়ে কুঁড়েতে রেখে যায়।

কখন জ্ঞান ফেরে কেউ জানে না। তবে বাবা বুঝতে পারে কোমর থেকে নিচটা অবশ হয়ে গেছে। নিরুপায়। পড়ে থাকতে হয় পঙ্গু হয়ে। দয়া করে প্রতিবেশীরা কেউ একটু খাবার কিংবা জল দিলে তা মুখে দেয়। না দিলে নেই। সারা শরীরে তীব্র ব্যথা। কোনও চিকিৎসা-সেবা নেই। এভাবেই কেটে যায় দুই-আড়াই মাস।

আমি তখন রাজশাহীতে থাকি। কেউ বাবার দুর্ঘটনার খবর আমাকে দেয়নি। একদিন ইচ্ছে করেই রাজশাহী থেকে এলাকায় যাই। গিয়ে বাবার মর্মান্তিক অবস্থার কথা শুনি এবং দেখি। তখন বাবা প্রায় শেষই। এক স্থানীয় ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে দেখাই। তিনি বলেন, ‘আর লাভ হবে না। স্থায়ীভাবে কোমর থেকে নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে।’ কিছুদিন সেবাযতœ করি। কিন্তু শেষে বাধ্য হয়ে বাবাকে ওই অবস্থায় রেখে আমাকে রাজশাহী চলে যেতে হয়। কারণ আমি দীর্ঘ তিন বছর ব্রেকের পর রাজশাহীর গোদাগাড়ি হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে আবার এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাই স্বার্থপরের মতো বাবাকে ওভাবে রেখেই রাজশাহী চলে যাই। ১৯৭৪ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের জাবরহাট হেমচন্দ্র হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষাটা দিইনি। তাই রাজশাহী না গেলে আমার আর পরীক্ষাই দেয়া হতো না। স্কুলের শিক্ষক এবং সহপাঠিরাও খুব করে পরীক্ষাটা দিয়ে আসতে বলেছিলেন। এমনকি বাবাও। বলেছিল, ‘একবার পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এবার আমার জন্য জীবনটা নষ্ট করিস না। ভগবান যা করে তাই হবে।’
বাবার মুখে শোনা শেষকথাটা আমার খুব লেগেছিল সেদিন। তাই বাবাকে অসহায় রেখেই আমি রাজশাহী চলে যাই।

বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বুকভরা কান্না নিয়ে আমাকে চলে যেতে হয়। বাবারও এমন ইচ্ছে ছিল। বাবাও কাঁদছিল ডুকরে ডুকরে। আমি আর পেছন ফিরে তাকাইনি। তাকালে যেতে পারতাম না।
বুঝতে পেরেছিলাম বাবার সঙ্গে আমার এটাই শেষদেখা! আমার হৃদয়বিদীর্ণ করা রোদনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সেদিন যেন আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। আমি ছাতা মাথায় দিয়ে সুলতানপুর রেলস্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম একা। আমার পৃথিবীটাকে সেদিন খুব একা এবং নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল!

বিদায়ের একদিন আগে দুঃসম্পর্কের এক ভাস্তেকে বাবাকে দেখতে অনুরোধ করেছিলাম। দিনে এক-আধবার সে হয়তো দেখেছিলও। কিন্তু পুরোটা দেখভাল করা ওর পক্ষে কি আর সম্ভব ছিল!

আসলে অসহায় অবস্থায় খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে ধুঁকেধুঁকে বাবা শান্তরাম রায় ১৯৭৬ সালে ঐ কুঁড়েঘরেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। ধারেকাছে আত্মীয়স্বজন কেউই ছিল না, এমন নয়। আমার ছোটবোন প্রমও ছিল কাছের গ্রাম মাটিয়ানিতে। তবে বাল্যবিয়ে হয়েছিল বলে ওর পক্ষে বাবার খোঁজখবর নেবার কোনও সুযোগ ছিল না। মল্লিকপুর এবং পাশের গ্রাম কাস্তোর ও সাগুনিতে বাবার রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রা ছিল। তারাও বাবার খোঁজ নেয়নি। নিতে পারেনি। সবার পক্ষে তা সম্ভবও ছিল না। দুঃখজনকভাবে বাবার মৃত্যুর খবরটিও আমাকে কেউ জানায়নি।
উল্লেখ্য, আমার জেঠু মশাই পন্থ রায়ও বাবার মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে পরপারে পাড়ি জমায়। তারও কোনও সন্তানাদি ছিল না। জেঠুও আমাকে তার সন্তানই মনে করতো।

যাই হোক, শেষদিনগুলোতে বাবার খুব কষ্ট হতো। দিনরাত চিৎকার পাড়তো। শেষে কেউ একফোঁটা জলও দিতো না শুনেছি। ছেঁচড়েছেঁচড়ে গিয়ে পাশের খাল-ডোবায় নেমে পিপাসা মেটাতো। আমি পরীক্ষার পর এলাকায় গেলে পাশের এক আত্মীয় বাবার মৃত্যুসংবাদসহ এসব শোনায়। অবশ্য সেসময় এখনকার মতো মোবাইল ছিল না। আমাদের এলাকায় ছিল না চিঠি ব্যতীত অন্য কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা।

আর হ্যাঁ, আমার বাবার বিপন্ন অবস্থার জন্য সিংহভাগ দায়ী আমার মা পার্বতী সিংহরায়। মায়ের খামখেয়ালির জন্য আমাকেও অনেক দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। তবে মায়ের দুধ আমি প্রায় তিন বছর পান করেছি। এ ঋণ শোধ করবার ক্ষমতা আমার নেই। তাই বলে বাবার প্রতি মা যে-জুলুম করেছে সে ব্যাপারে আমি আপস করতে পারিনি। বলা যায়, এজন্যই মায়ের সঙ্গে আমার আজীবন শীতলযুদ্ধ চলেছে। স্থানীয়রাও অনেকে এ বিষয়টি অবহিত। এরপরও দীনগ্রহণের পর অল্প কিছুদিন মায়ের সঙ্গে আমি বসবাস করেছি। কিন্তু বাবার সঙ্গে তার যে-অবিবেচনাপ্রসূত আচরণ ছিল তা আমি কখনই মেনে নিইনি।

আমার ধারণা, বাবা আর কয়েক বছর সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকলে হয়তো তার কালেমা পড়বার সুযোগ হয়েই যেতো। আর এ শঙ্কাতেই ওরা আমার সঙ্গে বৈরী আচরণ করতো বলে মনে হয়েছে। ওদের তখন ধারণা ছিল, ইসলামগ্রহণ করে আমি নষ্ট হয়েছি। বাবাকেও নষ্ট করবো। ওদের এমন ধারণাকে খুব দোষের মনে করি না। কারণ এটা ওদের ধর্মীয় বিশ্বাস।

পরীক্ষা দিয়ে কিছুদিন পর এলাকায় যাই। সেসময় এক আত্মীয় বিস্তারিত জানালে বাবার নিকটাত্মীয়দের ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম আর দুষছিলাম আমার দুর্ভাগ্যকে।

পরে আরও জানতে পারি, বাবার চিৎকার-চেঁচামেচিতে সবাই খুব বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সনাতন ধর্মের প্রথানুসারে শবদেহ দাহ না করে কুঁড়েঘরের কাছে এক বাঁশঝাড়ের তলে কোনওরকমে মাটিচাপা দেয়া হয় বাবাকে।

পরে কয়েকজন আমাকে আরও জানায়, মাটিচাপা দেবার সময় বাবার প্রাণবায়ু পুরোপুরি নাকি বেরোয়নি এবং একবার আমার আগের নাম ধরে ক্ষীণস্বরে ডাকও দিয়েছিল।

বলা বাহুল্য, এ বাবাই আমাকে ১৯৬৪ সালে মল্লিকপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এসে বুড়ো আঙুলে স্ট্যাম্প প্যাডের কালির ছাপ দেখিয়ে বলেছিল, ‘দ্যাখ বেটা, কাল থেকে স্কুল যাস। ভর্তি করে দিয়ে এসেছি।’ পরদিন থেকেই শুরু হয় আমার স্কুল যাওয়া।

এই ছিল আমার বাবা। আমার প্রেরণা। তাই শুধু বাবাদিবসে নয়, সবসময় বাবাকে আমি স্মরণ করি। সন্তানদেরও মাঝেমধ্যে দাদার কথা শোনাই। ওরা কখনও শোনে। কখনও শোনে না। এড়িয়ে যায়। আমার চোখের পাতা উষ্ণ অশ্রুতে প্রায়শ সিক্ত হয়। অব্যক্ত কান্না চেপে রাখবার চেষ্টা করি। কাউকে বুঝতে দিতে চাই না।

গত ১৬ জুন ছিল আন্তর্জাতিক বাবাদিবস। অন্যদের মতো আমারও মনে পড়েছিল বাবার কথা। বাবার কাছ থেকে শেষবিদায়ের ক্ষণটি। সেদিনের আকাশভাঙা মুষলধারে বৃষ্টিঝরার কথা। মানুষের কান্নার সঙ্গে প্রকৃতিও কখনওসখনও একাত্ম হয়। কাঁদেও। এ বোধ আমার সেদিন থেকে। আর মনে হয়েছিল সনাতনধর্মাবলম্বীদের পিতৃভক্তি নিয়ে একটি চমৎকার বাণী। সেটি হচ্ছে:
“পিতাস্বর্গ, পিতাধর্ম, পিতাহি পরমংতপঃ;
পিতরি প্রিতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা।”

বাবার প্রতি সম্মান জানাবার জন্য এর চাইতে কোনও ভালো বাণী আর আছে বলে মনে হয় না। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে বাবাকে অত্যন্ত মর্যাদা দেয়া হয়। সম্মান করা হয়। বলা হয়েছে: পিতা-মাতা যেন সন্তানের আচরণে ‘উহ্’ শব্দটি পর্যন্ত না করে। এমনকি সত্যপথের পথিক হবার সৌভাগ্য যদি তার নাও হয়।

আমি তাই প্রায়শ ভাবি, কালেমা পড়বার সুযোগ না পেয়ে আমার প্রিয় বাবা কি কোনওভাবে আল্লাহর ক্ষমা পেতে পারে? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে: মহান আল্লাহ আর-রাহমান। আর-রাহিম। তাঁর ক্ষমতা অসীম ও অনন্ত। তিনি সবকিছুই পারেন।

https://www.dailysangram.com/post/379990