২১ জুন ২০১৯, শুক্রবার, ৯:০৯

বাণিজ্য ঘাটতি ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: দেশে আমদানি বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় রফতানি আয় বাড়ছে না। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা অর্থনীতির জন্য বড় উদ্বেগের। এদিকে দেশে আমদানি প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও কমে গেছে এর পরিমাণ। বিশেষ করে গত তিন মাস ধরে আমদানির বাণিজ্যের এই সূচক একেবারেই নিচের দিকে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ার কারণেই আমদানিতে ভাটা পড়েছে। একইসাথে শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ ব্যাপক হারে কমেছে।

জানা গেছে, দেশে আমদানি বাড়ছে। তবে সে অনুযায়ী অর্জিত হয়নি রফতানি আয়। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনে বাংলাদেশের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশের পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ১ হাজার ৩৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনেও ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। এসব বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যোগান দিতেই আমদানি করতে হচ্ছে। এতে আমদানি ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সেই তুলনায় রফতানি আয় বাড়েনি। যার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের এ অবস্থা অর্থনীতির জন্য বড় উদ্বেগের বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, বাণিজ্য ঘাটতির এ হার দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। এটা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১০ মাস শেষে ইপিজেডসহ (রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা) রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩ হাজার ৩৪৩ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে ৪ হাজার ৭১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে এপ্রিল মাস শেষে দেশে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা (বিনিময় হার ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে)। তবে গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যে ঘাটতি আরও বেশি ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাণিজ্য ঘটতি ছিল ১ হাজার ৫২৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

এদিকে আলোচিত সময়ে সেবাখাতে বেতন ভাতা বাবদ বিদেশিদের পরিশোধ করা হয়েছে ৮৬৪ কোটি ডলার। এর বিপরীতে বাংলাদেশ এ খাতে আয় করেছে ৫৬৭ কোটি ডলার। এ হিসাবে সেবাখাতে দেশে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯৬ কোটি ডলার, যা গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৯১ কোটি ডলার। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৩১১ কোটি ডলার, যার প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ১ শতাংশ। পণ্য ও সেবা বাণিজ্যে যে পরিমাণ ঘাটতি হয়েছে, তা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের চলতি হিসাব ঋণাত্মক (-) রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫০৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭৭৯ কোটি ডলার।

আমদানি চাপের কারণে ডলারের দাম বাড়ছে। ফলে চলতি বছরে কয়েক দফা ডলারের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বছরের শুরুর দিন আন্তঃব্যাংক রেটে ডলারের দাম ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। এখন ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত মানে হলো নিয়মিত লেনদেনে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকা মানে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হবে। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচিত সময়ে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ৩১৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার, এর মধ্যে নীট বিদেশি বিনিয়োগ ১৪৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের চেয়ে এফডিআই বেড়েছে ২৬ দশমিক ৬১ শতাংশ আর নীট বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।

এদিকে আলোচিত সময়ে এফডিআই বাড়লেও দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ ব্যাপক হারে কমেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ৫৭ শতাংশের উপরে কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে শেয়ারবাজারে মাত্র ১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে, যা তার আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

সর্বশেষ গত ১২ জুন হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ২৬১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

এদিকে দেশে আমদানি প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও কমে গেছে এর পরিমাণ। বিশেষ করে গত তিন মাস ধরে আমদানির বাণিজ্যের এই সূচক একেবারেই নিচের দিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিল মাসে আমদানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এর আগে, মার্চে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি মাত্র এক শতাংশে আটকে ছিল। আর গত ফেব্রুয়ারিতে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এপ্রিল মাসে আমদানিতে শুধু নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে তা-ই নয়, আমদানির পরিমাণও কমে গেছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৫৪৫ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের এপ্রিলে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৫১২ কোটি ১ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এবারের এপ্রিলে আমদানি ব্যয় কমেছে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খাদ্যশস্য আমদানি কমে যাওয়ার কারণে এবং টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ার কারণে অনেকেই আমদানিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এ কারণে আমদানিতে ভাটা পড়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানিতে বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। এতে অনেকেই আমদানিতে অনুৎসাহিত হচ্ছেন। এমনকি শিল্পের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিও আগের মতো আসছে না। এছাড়া সরকারের বড় বড় প্রকল্পের জন্য আমদানি আগের মতো করতে হচ্ছে না। এসব কারণে আমদানি ব্যয়ও কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় কমেছে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৫০১ কোটি ৯১ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই ব্যয় হয়েছে ৪৭০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আবার ২০১৮ সালের মার্চে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৪৮৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের মার্চে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৪৮৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। যদিও গত জানুয়ারিতে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬১২ কোটি ৮ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে চাল ও গম আমদানির জন্য লেটার অব ক্রেডিট বা এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ৬২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ৫৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। জুলাই থেকে এপ্রিল এই ১০ মাসে শিল্পের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এ সময়ে সার্বিক এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) খাদ্যশস্য আমদানিতে ব্যয় কমেছে ৫৫ শতাংশ। এ সময়ে বিদেশ থেকে ১০৬ কোটি ২৬ লাখ ডলারের খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। যদিও গত বছরের একই সময়ে খাদ্যশস্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছিল ২৪১ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে চাল আমদানি কমেছে ৯৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ সময়ে চাল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে আট কোটি ৯৬ লাখ ডলার। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে চাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছিল ১৩০ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে গম আমদানি কমেছে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ সময়ে গম আমদানিতে খরচ হয়েছে ৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ১১০ কোটি ডলার। দেশে ভোগ্যপণ্য আমদানিও কমেছে আট দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানি কমেছে তিন দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১১৬ কোটি ডলারের ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ভোজ্যতেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ১১৯ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। চিনি আমদানি কমেছে ৩৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। ওষুধশিল্পের কাঁচামাল আমদানি চার দশমিক ৩৯ শতাংশ কমে ১৬ কোটি ১০ লাখ ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ওষুধশিল্পের কাঁচামাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছিল ১৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।

https://www.dailysangram.com/post/379870