২০ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:২২

মানুষের সমাজে মানুষের আর্তনাদ!

মানুষ মানুষ না হলে, সমাজ মানবিক না হলে মানুষের বসবাস সুন্দর হয় না- এমনকি কখনও কখনও হয়ে পড়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ ও বীভৎস। তেমনি এক বীভৎস জীবনের উদাহরণ হয়ে আছে কাশ্মীরের আসিফা। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কাঠুয়ার এক মন্দিরে আট বছর বয়সী মুসলিম শিশু আসিফাকে গত বছরের ১০ জানুয়ারি ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় ভারতের সচেতন ও বিবেকবান নাগরিকরা হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদমুখর। ঘটনার ব্যাপারে মামলা হয়েছিল এবং গত ১০ জুন পাঠানকোটের একটি বিশেষ আদালত ওই ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় প্রদান করে। রায়ে মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সঞ্জিরামসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন আদালত। ভারতের রাজস্ব বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা সঞ্জিরামকে ওই ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী বলে মনে করা হয়। যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশপ্রাপ্ত বাকি দুই আসামী হলেন সঞ্জিরামের ভাতিজার বন্ধু পারভেশ কুমার ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া। মামলার নথি অনুসারে ওই দু’জনের মধ্যে পারভেশ কুমার শিশুটিকে অপহরণে সহায়তা ছাড়াও একাধিকবার ধর্ষণ করেছিল। আর শিশুটিকে শ্বাসরোধ করে ও পাথরের আঘাতে হত্যার আগে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া শেষবারের মতো ধর্ষণ করতে চেয়েছিল।

শিশুহত্যার ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর সচেতন নাগরিকদের প্রতিবাদের মুখে এর তদন্তভার দেওয়া হয় পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চকে। মামলার প্রমাণাদি নষ্ট করার অপরাধে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ আরও তিনজনকে পাঁচ বছর করে কারাদ- ও জরিমানা করেছেন আদালত। এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ বলেছে, এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার নেপথ্যে আরও একটি বিষয় রয়েছে। আর তা হলো, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকদের ভয় দেখাতেই ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। পাঠানকোট থেকে এনডিটিভি ও রয়টার্স পরিবেশিত এই প্রতিবেদন থেকে উপলব্ধি করা যায়, ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও বিদ্বেষ এখনও কতটা প্রবল। মোদির বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িক হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি দূর করতে এগিয়ে আসে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আমরা জেনেছি, আট বছর বয়সী কাশ্মীরের মুসলিম শিশু আসিফাকে ধর্ষণ ও নির্মম হত্যার রায় দিয়েছে পাঠানকোর্টের একটি বিশেষ আদালত। ১০ জুনের এই রায়ে মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সঞ্জিরামসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে। আর মামলার প্রমাণাদি নষ্ট করার অপরাধে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ আরও তিনজনকে পাঁচ বছর করে কারাদ- ও জরিমানা করেছেন আদালত। আমরা জানি, কাশ্মীর নিয়ে ভারতে সংকট রয়েছে। কাশ্মীরের জনগণের সাথে ভারত সরকারের দ্বন্দ্ব রয়েছে, আর কাশ্মীর ইস্যুকে নিয়ে তো ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাব সম্পর্কে পুরো বিশ্বই অবগত আছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের ব্লেমগেম তো পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হয়ে ওঠে। তবে ব্লেম গেমে কোন সমস্যা বা সংকটের সমাধান হয় না। কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও তা লক্ষ্য করা গেছে। কাশ্মীর সংকট আমাদের উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়। বিষয়টি উপমহাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ যেভাবে উপলব্ধি করেনÑ রাজনীতিবিদরা সেভাবে উপলব্ধি করেন কিনা সেই প্রশ্ন করাই যায়।

কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী ও বিশ্লেষকদেরও মাঝে মাঝে মুখ খুলতে দেখা যায়। এবার মুখ খুলেছেন ভারতের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। গত ৯ জুন ইন্ডিয়া টুডে অমর্ত্য সেনের বক্তব্য প্রকাশ করে। তিনি বলেছেন, কাশ্মীরে ভারত যে নৃশংসতা ও বর্বরতা চালাচ্ছে তা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হয়ে থাকবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি আরও বলেন, ভারতের এই কলঙ্কের জন্য দায়ী বেশকিছু লোক। তাছাড়া কাশ্মীরে চালানো বর্বরতা নিয়ে কেবল ভারতে নয়, বিদেশেও অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ অবস্থা যে একটি কলঙ্ক তার অনেক প্রমাণ আছে। বিদেশের আলোচনাতেও কাশ্মীর গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন আরও বলেন, আমরা কাশ্মীর ও কাশ্মীরের মানুষের সাথে সঠিক আচরণ করিনি। এখনও পর্যন্ত আমরা কাশ্মীরের অপব্যবহার করছি। এটা আইন ও শৃঙ্খলার সমস্যা নয়। তিনি বলেন, কাশ্মীরের মানুষের সাথে আমরা ভয়াবহ ও সহিংস বর্বর আচরণ করছি। কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করতে আমরা ইন্টারনেট ও সংবাদপত্র বন্ধ করে দিচ্ছি। আর এসব করে আমরা এমনভাবে কাশ্মীরের মানুষদের শাস্তি দিচ্ছি যে, তারা কখনোই ভারতকে আপন ভাবতে পারবে না। অমর্ত্য সেন বলেন, ‘কাশ্মীরের জনগণ তাকিয়ে আছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। বিক্ষোভ দমন করতে ভয়ংকর ও সহিংস ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এতে কাশ্মীরীরা আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।’ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেন, ‘কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতার ওপর সিএনএন-র দীর্ঘ এক প্রতিবেদন আমি দেখেছি। ভারতের বাকি অংশের মানুষের সাথে কাশ্মীরের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আসল কথা হলো, বহু দশক ধরে আমরা একে মিসহ্যান্ডেল করেছি। এখন আরও খারাপ উপায়ে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

অমর্ত্য সেন বললেন, বহু দশক ধরে কাশ্মীর ইস্যুকে নিয়ে ভারত মিসহ্যান্ডেল তথা ভুল করে আসছে। আর এখন আরও খারাপ উপায়ে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতের নীতিনির্ধারকরা কি অমর্ত্য সেনের বিশ্লেষণের সাথে একমত হবেন? একমত না হলে তো কাশ্মীর পরিস্থিতি আরও খারাপভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন তারা। প্রসঙ্গত আসিফা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্তে ক্রাইম ব্রাঞ্চের একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করতে হয়। তারা বলেছেন, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকদের ভয় দেখাতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এমন সমাজচিত্র থেকে উপলব্ধি করা যায়, কাশ্মীর ইস্যু কতটা অমানবিক হয়ে উঠছে। মোদি সরকার এখন কোন্্ পথে হাঁটবেন।

যারা সরকারে আসেন তাদের দায়িত্ব বহুবিধ। সরকারের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি জনমনে প্রভাব ফেলে থাকে। আর এই প্রভাব সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের আচরণে বেশি লক্ষ্য করা যায়। একটি দেশে নানা ধর্ম, বর্ণ ও মতের মানুষ বসবাস করে থাকে। বাস্তব কারণেই কিছু নাগরিক সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব হয়ে পড়ে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধান। অর্থাৎ ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ দর্শনকে লালন করে সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে হয়। সাম্প্রতিককালে এ ক্ষেত্রে বড় ব্যত্যয় লক্ষ্য করা গেছে মিয়ানমারে। সেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দেশটির সরকার, সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী একসাথে হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের মাধ্যমে এমন এক নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে যে, লাখ লাখ রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী ও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। মানবিক কারণে এই লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন সংকটে পতিত হয়েছে।

আমরা জানি, আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্র ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ। ভারত বহু ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার দেশ। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা ভারতের বিঘোষিত নীতি। ‘বৈচিত্র্যের-ঐক্য’ দর্শনকে সমুন্নত রাখার জন্য ভারতের নেতৃবৃন্দ জোর দিয়ে গেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা আচরণ ও গো-রক্ষক গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকা-ে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিমসহ অন্যরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে মার্কিন কূটনীতিকদেরও।

সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত সহকারী সচিব অ্যালিস ওয়েলস ধর্মীয় সহিংসতার দ্রুত নিন্দা জানাতে এবং চরমপন্থীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে ভারতের পুনঃনির্বাচিত মোদি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বানের প্রতি মোদি সরকার কতটা সাড়া দেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

https://www.dailysangram.com/post/379750