২০ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:২০

অসহিষ্ণু সরকার ও অবাঞ্ছিত পরিণতি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডি সি মাটজ অসহিষ্ণুতাকে নাগরিক অধিকারের প্রতিবন্ধক এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মূল কারণ বলে বর্ণনা করেছেন (সামাজিক ও ব্যবহারিক বিশ্বকোষ : ২০০১)। সাম্প্রতিক বিশ্বের রাজনৈতিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করেন, অসহিষ্ণুতা কিছু সরকারের অনুসৃত দর্শনে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে পরিচালিত সরকারগুলোতে অসহিষ্ণুতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সংসদীয় রাজনীতির কথিত রাষ্ট্রীয় বিরোধী দলের ধারণা লোপ পেতে বসেছে। অথচ রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা দীর্ঘকাল ধরে বিরোধী বা অপছন্দের দল বা গোষ্ঠীকে ধারণ ও গ্রহণ করে আসছে।

গত ৬ দশক ধরে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্রের মূল অনুষঙ্গ- বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে ভোটের স্বাধীনতা মূলত সরকারের সহনশীল আচরণের ওপর নির্ভরশীল। ক্রমেই উন্নত এবং দীর্ঘকাল ধরে অনুশীলনকারী দেশগুলো অসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক ভারতের নির্বাচন এর একটি বড় উদাহরণ। প্রতিষ্ঠিত ও অপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এই বিভেদ চিন্তা ও বাস্তবের মধ্যে মারাত্মক ব্যবধান সৃষ্টি করেছে (মার্কওয়ার্ট-পিয়ট, পেক্সটন : ২০০৭)। অসহিষ্ণুতা পরিমাপ করে একদল সমাজবিজ্ঞানী বলছেন- যেকোনো রাষ্ট্রে এর মাত্রা একই রকম, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে (সাফের এন্ড শ: ২০০৯, সলিভান এবং হেন্ড্রিক্স : ২০০৯, গিবসন : ২০১৩)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ এর ঘটনাবলির পর মৌলিক নাগরিক অধিকার খর্বকরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য অতীতেও কথিত স্বাধীনতার প্রবক্তা পাশ্চাত্যে এবং কমিউনিস্টদের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন একই আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে ‘ইসলামিস্ট’দের প্রতি।

বাংলাদেশ গণতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই অসহিষ্ণুতা এখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে নির্বাচন প্রকৌশলের মাধ্যমে পরাজিত করা হয়। তখন ৩০০ জনের জাতীয় সংসদে মাত্র আটজনের বিরোধী পরিচয় মেনে নেয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে প্রায় ১০০ জন বিরোধীদলীয় প্রার্থী জয় লাভ করতেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা অতদিনে খুব বেশি হ্রাস পায়নি, সরকারে তারাই থেকে যেতেন। কিন্তু সামান্য বিরোধিতাও তারা সহ্য করতে পারেননি। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ’। মানে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ‘নিশীথ নির্বাচন’ কে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি মনে করেন অনেকে; সময় ও কৌশলের পার্থক্য যদিও রয়েছে। ১৯৭৩ সালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছিল। আর এই সাম্প্রতিক নির্বাচনে শুধুই প্রহসন হয়েছে। নির্বাচনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এতে ছিল না। আর একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে- সমগ্র জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকারের বল প্রয়োগ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বল প্রয়োগের চেয়ে কলা-কৌশলের প্রাধান্য ছিল বেশি। কারণ তখন পর্যন্ত লজ্জা-শরমের বালাই ছিল। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, যার দু’কান কাটা সে রাস্তার মাঝখান দিয়েই হাঁটে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তার ইতিহাসের প্রথম ধারায়ই অসহিষ্ণুতা ছড়ানোর মাধ্যমে বিভেদ উসকে দেয়া হয়েছে। মুজিব নগরীয়-অমুজিব নগরীয়, পাকিস্তান ফেরত বনাম মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক- অদেশপ্রেমিক প্রভৃতি বিভাজনের মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে। এবার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একই দল পুরনো প্রবণতায় ফিরে গেছে। এখন তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ নামে দু’ধারী শানিত তরবারির মতো হাতিয়ার ব্যবহার করছেন সমাজে। যারাই তাদের বিরোধিতা করছেন, তারা পাইকারিভাবে ‘রাজাকার’ অভিধায় অভিযুক্ত হচ্ছেন।

তাদের চোখে বীর উত্তম জিয়াউর রহমান ‘আইএসআই-এর এজেন্ট’, বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকী ‘রাজাকার’ এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ‘দেশদ্রোহী’। আরেকজন বীর উত্তম, বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার সামান্য তথ্যগত বিভ্রান্তির জন্য ‘রাজাকার’ হয়ে গিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে তিনি মাফ চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যাওয়ার কোশেশ করেছেন। শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠজন সুলতানা কামাল সেদিন বলেছেন, প্রশ্ন তুললেই বলা হয় ‘উন্নয়ন বিরোধী’। খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বরাবরই বাজেটের ওপর নিজস্ব মূল্যায়ন পেশ করে থাকে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। সিপিডির গবেষণাসমৃদ্ধ গঠনমূলক সমালোচনাও সরকারের সহ্য হয়নি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এমন ভাব ও ভাষায় সমালোচনা করছেন, যাতে তাদের অসহিষ্ণুতারই প্রকাশ ঘটেছে। তথ্যমন্ত্রী সিপিডিকে ‘বিএনপির সমার্থক’ করে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিশ^ব্যাংক যেখানে বলছে, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে সিপিডি কোনো কল্যাণই দেখে না। সিপিডি কি বিশ^ব্যাংকের চেয়েও বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেল?’ এর আগের তথ্যমন্ত্রী একই ভাষায় সিপিডির সমালোচনা করেছেন।

অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটছে নিশীথ ভোটের সংসদে। বিএনপি যখন সংসদে যোগদানের ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই উপদেশ প্রদান করছিলেন, তাদের যোগদান করা উচিত। তাদের সংসদে কথা বলতে দেয়া হবে। গত কয়েক দিনে সংসদে বিএনপির সদস্যদের সাথে কী রকম ব্যবহার করা হয়েছে, সংসদের কার্যবিবরণী দেখলেই তা স্পষ্ট হবে। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা কথা শুরু করার মাত্র এক মিনিটের মাথায় সরকারদলীয় লোকেরা হইচই শুরু করেন। তিন মিনিটের মাথায় ডেপুটি স্পিকার হস্তক্ষেপ করেন। অন্যান্যের ক্ষেত্রে মাইক বন্ধ করে দেয়া ও আপত্তিকর ব্যবহারের প্রকাশ ঘটে। কবিগুরু বলেছেন, ‘রাজা যা বলে পারিষদ বলে তার শতগুণ’। এ রকম কলাম লিখেছেন কোনো কোনো প্রবীণ সাংবাদিকপ্রবর।

তারা ক্ষেপেছেন প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকের ওপর। তার কারণ জার্মানিতে গিয়ে তিনি সরকারের সমালোচনা করেছেন। জার্মান বেতারে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘লিখছি না এমন অনেক ইস্যু রয়েছে। অনেক ইস্যুতেই লেখা উচিত, যেমন ধরুন গত সাধারণ নির্বাচন। এ ছাড়া, আরো ছোট নির্বাচনগুলো নিয়ে লেখা উচিত, যা লিখছি না। বলা উচিত, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লিখতে পারছি না’। প্রকারান্তরে তিনি বুঝিয়েছেন, বাংলাদেশে কথা বলার স্বাধীনতা নেই। এর বিরুদ্ধে একজন প্রবীণ সাংবাদিক বলেছেন, ‘এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়েছেন’। ওই সম্পাদক কেন এই সমালোচনা করলেন? উল্লেখ্য প্রধানমন্ত্রী তিন দেশ সফর শেষে আয়োজিত সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে সে সম্পাদক প্রসঙ্গে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এ জন্য প্রবাসী কলামিস্ট তার ধারালো কলম দ্বারা তাকে ভোঁতা করতে চেয়েছেন। কিন্তু এতে প্রমাণিত হলো যে, সরকারপ্রধান এবং তার ভক্তরা অসহিষ্ণু। ইতঃপূর্বে বেশ কয়েকবার টকশোওয়ালাদের তীব্র সমালোচনা করে তাদের তিনি নিশাচরদের সাথে তুলনা করেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা সরকারের সমালোচনা করছেন তাদের ‘শত্রু’ বলে গণ্য করা হচ্ছে।

অসহিষ্ণুতা সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ এবং সহিংসতা বৃদ্ধি করে। রাজনৈতিক সরকার যখন রাজনৈতিক উপায়ে সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে অসত্যকথন, নিপীড়ন এবং শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমননীতি গ্রহণ করে- তখন সমাজে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। অসহিষ্ণুতা কেবল অসহিষ্ণুতাই ডেকে আনে। সরকার যখন নিজ জনগণের একজনকে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়, তখন তারা আপাত স্বস্তি লাভ করলেও প্রকারান্তরে অবাঞ্ছিত পরিণতির দিকে এগিয়ে যান। সময়-সুযোগ বুঝে সমাজে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অ্যারিস্টটল প্রত্যক্ষ করেছিলেন, প্রতিটি শাসনপদ্ধতি অবশেষে যখন চরমপন্থী হয়ে ওঠে, তখনই বিস্ফোরণ বা বিপ্লব ঘটে। বিপ্লবের জন্য সেসব অনুক্ত অনুভূতি এবং কার্যাবলি দায়ী তা রাষ্ট্রীয় জীবনকে এর কাঠামোর মধ্যে সুপ্তভাবে বিভক্ত করে এবং পরিশেষে বিরাট পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নেয়। বাংলাদেশী সমাজের গতিপ্রকৃতি কি সে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

http://www.dailynayadiganta.com/sub-editorial/418774