১৯ জুন ২০১৯, বুধবার, ৭:৩৬

আমাদের কৃষি ও প্রস্তাবিত বাজেট

ইবনে নূরুল হুদা : আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা কৃষিনির্ভর। এদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% লোকের এবং শহর এলাকায় ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৯.১% এবং কৃষিখাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। ধান, পাট, তুলা, আখ, ফুল ও রেশমগুটির চাষসহ বাগান সম্প্রসারণ, মাছ চাষ, সবজি, পশুসম্পদ উন্নয়ন, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, বীজ উন্নয়ন ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয়সমূহ এ দেশের কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র ও এ বিষয়ে কাজ করছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের দেশের কৃষি বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের অভাবে অপার সম্ভবনার এই খাত ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়ছে।

প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কৃষির জন্য প্রস্তাবিত বরাদ্দ কৃষি ও কৃষকের বর্তমান সংকট মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ করা হয়েছে যে, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার সময় কৃষিকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল আসলে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ অথচ কৃষির জন্য বরাদ্দ কমেছে ০.৪১ শতাংশ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ২.৯৯ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল ৩.৪০ শতাংশ কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ২.৭৮ শতাংশ। তাই এই ২.৯৯ শতাংশও যে শেষ পর্যন্ত কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বার্ষিক কর্মসূচির মাত্র ১.১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা মোটেই পর্যাপ্ত নয়।

বর্তমান অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ১.২ শতাংশ রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা করা হয় ১.০ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস, খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়নের কারণে কৃষি জমি অকৃষি খাতে ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পথে তীব্র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বাজেটে দূরদর্শী বরাদ্দ ও উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তা উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রস্তাবিত বাজেটে চাল আমদানির ওপর শুল্ক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৮ শতাংশ করা হয়েছে। এটা করা উচিত ছিল আরও অনেক আগে। যখন কৃষকের কাছে ধান বা চাল ছিল। কিন্তু এই কাজটা সময়মত না করায় কৃষকরা এবার ধান-চালের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মূলত দীর্ঘদিন ধরেই কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য একটি কমিশন গঠনের দাবি থাকলে সে দাবিও এবার উপেক্ষিত হয়েছে।

আমাদের অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের কারণে আমাদের দেশ তথা বাংলাদেশের মেরুদন্ড কৃষি নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জীবন জীবিকার জন্য এদেশের জনগণ ও অর্থনীতি মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখনও শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ জনসাধারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটলে বা কৃষকরা কৃষিপণ্যের নায্যমূল্য না পেলে দেশের অর্থনীতিই বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পৃথিবীর জনবহুল দেশ আমাদের মাতৃভূমি। দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৭ হাজার নতুন মুখ। বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ লোক। অপরদিকে রাস্তাঘাট, মিল-কারখানা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরিতে চাষযোগ্য জমি থেকে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসেবে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পাল্লা দিয়ে নিবিড়ভাবে চাষ করা হচ্ছে ধান আর ধান। এতে সাফল্যও এসেছে ব্যাপকভাবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ধানের সঙ্গে আনুপাতিক হারে অন্যান্য ফসলের (ডাল, তেল, শাকসবজি, ফল-মূল) চাষও বাড়াতে হচ্ছে। মূলত আমাদের দেশের অর্থনীতি সচল থাকার ক্ষেত্রে কৃষক ও কৃষির অবদানের বিষয়টি অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের কৃষক সমাজ বরাবরই উপেক্ষা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আমাদের দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে দুই স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং পার্কিনসন ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’ নামক এক গবেষণাগ্রন্থে বলেন, ‘যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়, তাহলে বিশ্বের কোথাও উন্নয়ন কোনো সমস্যা হবে না’। এসব স্লেষাত্মক বক্তব্য ছিল সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে লাগামহীন দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই দুষ্টক্ষতে সুমিষ্ট প্রলেপ দিতে সক্ষম হয়েছে আমাদের দেশে কৃষি ও বৈদেশিক রেমিটেন্স। কৃষি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের কারণে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি বলে দাবিও করা হচ্ছে সম্প্রতি। মিলেছে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতিও। বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অগ্রযাত্রায় কৃষি তথা কৃষককুল রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। যেকোনও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। যে কাজটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করে চলেছে এ দেশের কৃষক সমাজ। কিন্তু জাতীয় উন্নয়নে আমাদের কৃষক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও কৃষকদের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি বরং দেশের কৃষক সমাজ বরাবরই অবহেলিত ও উপেক্ষিত থেকেছে। কৃষি ও কৃষক সমাজের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও কাঙ্খিত মানের নয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমাদের জনসংখ্যা ছিল ৭ দশমিক ৫ কোটি। ধান উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন। বিগত প্রায় ৫ দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ দেশের চাষিরা ধান উৎপাদন বাড়িয়েছে তিন গুণেরও বেশি। ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন চাল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ন, শিল্পায়ন ইত্যাদি নানা কারণে কৃষি জমির হ্রাস, সেচের পানির স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন অভিঘাত যেমন বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার মতো বৈরী প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগুতে হয়েছে বাংলাদেশের কৃষক সমাজকে। এসব বৈরি ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার পরও আমাদের দেশের কৃষক সমাজের সাফল্য বেশ ঈশ্বর্নীয় বলা যায়। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষে। ২০১৮ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোতে এই হার ছিল অনেক কম। গণচীনে এই বৃদ্ধিও হার দশমিক ৭৮ শতাংশ, ভারতের ২ শতাংশ। মার্কিন কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস অনুসারে ২০১৯-২০ সালেও আমাদের এই প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কৃষকদের এই অভাবনীয় সাফল্যকে আমরা মূল্যায়ন করতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছি।

দেশের কৃষক সমাজের এই সাফল্যে আমাদের দেশের কৃষিজ অর্থনীতি চাকা যখন ক্রমেই গতিশীল হয়ে উঠছে, তখন এর নেপথ্যের কারিগর কৃষকদের জন্য আমরা স্বস্তিদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি। দেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমান ও কৃষিতে উৎপাদন খরচ বাড়লেও ধানসহ কৃষিপণ্যের মূল্য ক্রমেই নি¤œমুখী। সাম্প্রতিক সময়ে ধানের ক্ষেত্রে এই সঙ্কটটা আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এক কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় ২৪ টাকা। বর্তমান বাজার দরে এই ধান বিক্রি হচ্ছে ১২-১৩ টাকা কেজি দরে! অথচ সরকার নির্ধারিত ধানের ক্রয় মূল্য কেজি প্রতি ২৬ টাকা। শুধু তাই নয়, সরকার যে পরিমাণ ধান বা চাল ক্রয় করে তা উৎপাদনের তুলনায় একেবারেই নগন্য। গত বোরো মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু সরকার ক্রয় করেছে মাত্র দেড় লাখ টন ধান আর নয় লাখ টন চাল! স্বাভাবিকভাবে সিংহভাগ ধান কৃষককে বিক্রি করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের কাছে। যেখানে মুনাফাই মুখ্য এবং দাম নির্ধারণ হয় চাহিদা ও জোগানের হিসেবের উপর! ফলে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে নিঃসন্দেহে বঞ্চিত হয়েছেন।

২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে ধানের দামের ব্যাপক পতন ঘটে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতেই বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয়। চাল আমদানির উপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে বোরো মৌসুমে হাওর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকারি হিসেবে এই ক্ষতির পরিমান প্রাক্কলিত হয় ১০ লাখ টন। সম্ভাব্য ঘাটতি মোকাবিলায় চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং পূর্বে আরোপিত ২৮ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয় অবাধ চাল আমদানি। গত দেড় বছরে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এদিকে দেশে ধান উৎপাদন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলেও চাল অমদানীতে ভাটা পড়েনি। এমনকি দেশে এবার ধানের বাম্পার ফলন ও অব্যাহত দরপতনের পরও দেশে চাল আমদানির অপেক্ষায় আছে প্রায় ০৪ লক্ষ টন। বিষয়টিকে অন্যেকেই রহস্যজনকই মনে করছেন।

গত তিন মৌসুমে দেশে ধানের বাম্পার ফলন অব্যাহত থাকায় সরবারহ পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। চাহিদার তুলনায় দেশে মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সরকারের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে আমন মৌসুমে বাম্পার ফলনের পর মজুদ ও বাজারে চালের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। অধিকাংশ চালকলে বর্তমানে তাদের ক্রয়কৃত পূর্বের মজুদ রয়ে গেছে। যে কারণে বেশিরভাগ চালকল ব্যবসায়ী এখন পর্যন্ত ধান কেনা সংগ্রহ করেন নি। এক হিসেবে দেখা যায়, সাধারণত বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার এই সময় কালে ১৬ হাজার চালকলের প্রায় সবগুলি চালু থাকে। কিন্তু বর্তমানে চালু রয়েছে মাত্র হাজার খানেক। তাই এবারের ধান কাটা পুরোপুরি সম্পন্ন হলে সরবরাহ পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে ধান ক্রয় কার্যক্রম যদি জোরদার না হয় ধানের মূল্য আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। যা আমাদের দেশের কৃষির জন্য অশনিসঙ্কেত বলেই মনে করা হচ্ছে।

মূলত কৃষি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, যুতসই পরিকল্পনা অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও প্রয়োজনীয় ভর্তূকির অভাবেই কৃষকরা কৃষি পণ্যে মূল্য পাচ্ছে না বলে মনে করা হচ্ছে। ধানের অব্যাহত দরপতন রোধে সরকার কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বরং সরকার সংশ্লিষ্টরা ধানের মূল্য নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে কৃষক ও কৃষি পণ্য নিয়ে তিনি তুচ্ছ-তাচ্ছিল প্রদর্শন করেছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, দেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হয়েছে জন্যই ধানের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। দাবি করা হচ্ছে যে, ধান সহ খাদ্যশষ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতার কারণেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় অধিকহারে ধান সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। এটিও সরকারের পক্ষে দায়িত্বশীল কথা নয়। কৃষকদের কৃষি পণ্যের নায্য মূল্য নিশ্চিত করা দায়িত্ব সরকারের। ধান যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উৎপন্ন হয়ে থাকে তাহলে বহিঃর্বিশ্বে তার বাজার অনুসন্ধান ও রপ্তানী করার দায়িত্বও সরকারের। ধান সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় গুদাম নেই এটিও যৌক্তিক কোন কথা নয়। কারণ, অভাব পুরুণের দায়িত্বও রাষ্ট্রের।

যেহেতু কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ ক্রমবর্ধমান। তাই কৃষি পণ্যে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ অনুসরণ করা যেতে পারে। কৃষকরা যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে ভারত সরকার তাদের প্রধান ফসল গম, ধানসহ মোট ২৫টি ফসলের জন্য ন্যূনতম ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এই কাজটি করে কমিশন ফর এগ্রিকালচার কস্ট অ্যান্ড প্রাইসেস (সিএসিপি)। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষকের উৎপাদন খরচ, ঝুঁকি ইত্যাদি সব কিছু বিবেচনায় নেয়া হয়। এ বছর ভারতে গমের জন্য সরকার নির্ধারিত ক্রয় মূল্য প্রতি কুইন্টাল এক হাজার ৪৪০ রুপী। কৃষকের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে প্রতি কুইন্টাল ৮৬৬ রুপি। অর্থাৎ একজন কৃষক তার খরচের উপর ১১২ দশমিক ৫ শতাংশ মুলাফা অর্জন করতে পারবে। বাজারে যাতে নির্ধারিত মূল্যে ফসল বিক্রি হয় সে লক্ষ্যে সরকার মোট উৎপাদনের অন্তত এক তৃতীয়াংশ ক্রয় করে। ২০১৭-১৮ সালে ভারতে মোট গম উৎপাদন হয় ৯৮ দশমিক ৬১ মিলিয়ন টন, এ থেকে সরকার ক্রয় করে ৩৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন যা শতকরা হিসাবে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমরা বেশ উদাসীন।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও কৃষিখাত বরাবরের মতো উপেক্ষিত হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবনসহ কয়েকটি বিষয়ে বরাদ্দ রাখা হলেও ভর্তুকি ও এর আওতা না বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেন দেশের প্রান্তিক কৃষক সমাজ। যা দেশের কৃষি সেক্টর সহ দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই ইতিবাচক নয়।

২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। টাকার অংকে ১৪ হাজার ৫৩ কোটি। আগের বছরের চেয়ে পরিমাণ বাড়লেও আনুপাতিক হারে তা কমেছে উল্লেখ করে কৃষিখাত নিয়ে হতাশার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

সংশ্লিষ্টরা আমরা আশা করেছিলাম এবারের বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দটা বেশি আসবে। কিন্তু না হওয়ায় কৃষক সমাজকে আশাহতই হতে হয়েছে। বাজেটের ১১ ভাগ কৃষিখাতে বরাদ্দ করা উচিত ছিল মনে করেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। তাহলে দেশের কৃষি সেক্টর একটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু ঘোষিত বাজেটে আমাদেরকে আশাহতই হতে হয়েছে। বিশেষ করে কৃষির ৭০ ভাগ কাঁচামাল ও ৪০ ভাগ খাদ্য সরবরাহকারী অঞ্চল হলেও বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরের জন্য আলাদা কোন প্রস্তাবনা না থাকাকে দুঃখজনক বলছেন স্থানীয়রা।
বাণিজ্যিক কৃষির যে নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে তাতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটকে ভয়ঙ্কর বলে অবিহিত করে উৎপাদক ও ভোক্তা পর্যায়ে সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং উৎপাদিত পণ্যের মজুদ বৃদ্ধি ও এর পুরো নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রাখার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। রংপুর মেট্রো চেম্বারের পক্ষে বলা হয়েছে, এই এলাকায় কৃষিখাতে উন্নতি করার জন্য যদি প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা হতো তবে গোটা দেশই উপকৃত হতো। কৃষি নির্ভর অর্থনীতির এই অঞ্চলে কৃষি খাতে বরাদ্দের অপর্যাপ্ততা কাটাতে অবকাঠামো, নদীভাঙ্গন, জলবায়ু পরিবর্তন, গ্রাম ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতের উল্লেখযোগ্য অংশের বরাদ্দ এই অঞ্চলের জন্য খরচের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ঘোষিত বাজেটে এক্ষেত্রে কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। কৃষি ও কৃষকরা আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলেও ধানের অব্যাহত দরপতন দেশের পুরো কৃষি সেক্টরে হতাশার সৃষ্টি করেছে। ফলে দেশের কৃষক সমাজ কৃষি উৎসাহ হারাতে বসেছেন। ধানের নায্যমূল্য না থাকায় ধানক্ষেত্রে আগুন দিয়ে এবং রাস্তায় ধান ছিটিয়ে অভিনব প্রতিবাদের ঘটনাও ঘটেছে আমাদের দেশেই। অথচ সরকার ও সংশ্লিষ্টরা কৃষকের মূল সমস্যার সমাধান ও ধান সহ কৃষকদের কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

ধানের মূল্য নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ও সরকার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যও অনেকটাই দায়সারা গোছের। ঘোষিত বাজেটে কৃষির জন্য তেমন সুখবর পাওয়া যাচ্ছে না বরং কেউ কেউ ঘোষিত বাজেটকে কৃষক মারার বাজেট বলেই উল্লেখ করছেন। ঘোষিত বাজেটে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অথচ কৃষকসহ আত্মসচেতন মানুষের দাবি হলো কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু একটি ছাত্রসংগঠন ও পুলিশ কর্তৃক কৃষকদের ধান কেটে দেয়ার নামে যে ফটো সেশনের মহড়া প্রদর্শন করা হচ্ছে তা কৃষক সমাজের প্রতি নির্মম পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। কৃষকদের ধান মাড়ায় কোন সমস্যা নয় বরং ন্যায্য মূল্যই আসল সমস্যা। কিন্তু গোড়ায় হাত না দিয়ে চমক সৃষ্টির লৌকিকতা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একথা সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলদ্ধি করবেন ততই কল্যাণ।

https://www.dailysangram.com/post/379613