১৯ জুন ২০১৯, বুধবার, ৭:২৪

ইসিতে সক্রিয় সিন্ডিকেট: সাজানো টেন্ডারে ১৫শ’ ল্যাপটপ-প্রিন্টার ক্রয়

পণ্য সরবরাহের আগেই মূল্য পরিশোধ করতে হবে * নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও মডেল উল্লেখ করে মাঠপর্যায়ে ইসি সচিবালয়ের চিঠি * এক ঠিকাদার তিন প্রতিষ্ঠানের নামে টেন্ডারের কাগজপত্র পৌঁছে দিচ্ছে নির্বাচন অফিসে

সাজানো টেন্ডারে নির্বাচন কমিশন ১ হাজার ৫৫৭টি ল্যাপটপ, প্রিন্টার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনতে যাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব পণ্য সরবরাহের আগেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করতে হবে।

পরিকল্পিতভাবে তিন প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দেয়া হচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠান কত টাকা দাম দেবে, তা-ও আগেই নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

নির্বাচন অফিসগুলোয় এ তিন কোম্পানির নামে দরপত্রের আলাদা কাগজ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ল্যাপটপ-প্রিন্টারের কোম্পানি, মডেল এবং রং উল্লেখ করে উপজেলা ও থানা নির্বাচন অফিসে চিঠি দিয়েছে কমিশন সচিবালয়।

এমআর কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারি নামের নির্দিষ্ট এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এসব পণ্য কিনতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় ক্রয় সংক্রান্ত কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই ল্যাপটপ ও প্রিন্টার আমদানির কার্যক্রম শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, ৫১৯ উপজেলার জন্য দুটি করে মোট ১ হাজার ৩৮টি ল্যাপটপ ও ৫১৯টি প্রিন্টার কেনা হবে। একই সঙ্গে পোর্টেবল হার্ডড্রাইভ, ক্যামেরার চার্জার, ব্যাটারিসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতিও কেনা হচ্ছে। এগুলো কেনার জন্য ইসি সচিবালয়ের একটি অসাধুচক্র এই ঠিকাদারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য কেনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জনপ্রতি ২০-২২ হাজার টাকা উপহারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, কমিশনের সচিব পদে আমি নতুন। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখতে হবে। নিয়মের বাইরে কিছু হলে আইনগতভাবে সমাধান করা হবে।

ব্র্যান্ড ও মডেল উল্লেখ করে ল্যাপটপ ও প্রিন্টার কেনার জন্য চিঠি পাঠানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদে ব্যবহৃত সব ধরনের সফটওয়্যার টাইগার আইটি নামের প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করে। সব উপজেলা ও থানা অফিসে একই মডেল ও ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ না হলে ওইসব সফটওয়্যার ইনস্টল করতে সমস্যা হয়। সেই বিবেচনায় এ চিঠি দেয়া হয়েছে। অ

পর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে একই ঠিকাদার থেকে এসব পণ্য নিলে ভালো হয়, সেটাই বলেছি। যে কোনো কেনাকাটায় কিছু ত্রুটি থাকে। এটা তেমন কিছু নয়।

জানা গেছে, এ ধরনের কাজ আগেও হয়েছে। ২০১৭ সালের শেষদিকে একইভাবে নির্দিষ্ট একটি কোম্পানির কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ ল্যাপটপ কিনতে বাধ্য করেছিল কমিশন সচিবালয়ের একটি সিন্ডিকেট। ওই ল্যাপটপগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে ২০০৭-০৮ সালে কেনা ল্যাপটপ দিয়ে ভোটার হালনাগাদসহ নির্বাচনের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।

এসব ল্যাপটপ কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক নির্বাচন অফিস অডিট আপত্তির মুখে পড়েছে। এ ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইসি সচিবালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। কাজেই চাকরিতে হয়রানির ভয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা মুখ খুলছেন না।

কয়েকজন থানা নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালে কেনা ল্যাপটপের চেয়ে ২০০৭-০৮ সালে কেনা ল্যাপটপ এখনও অনেক ভালো সার্ভিস দিচ্ছে, সেগুলো দিয়েই কাজ চালাচ্ছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ২১ মে সব আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা/থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়।

ওই চিঠির সংযুক্তিতে ডেল ব্র্যান্ডের ‘ল্যাটিচুড ৭৪৯০’ মডেলের ল্যাপটপ এবং ব্রাদার ব্র্যান্ডের ‘এইচএল-এল৬৪০০ডিডব্লিউ’ মডেলের প্রিন্টার কেনার নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের স্পেসিফিকেশন ও রং উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে।

চিঠিতে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ’ কমিটির একটি সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘...ল্যাপটপ-প্রিন্টার যাতে সব উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসে একই স্পেসিফিকেশন/মডেল ও গুণগত মানসম্পন্ন হয়, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা বিধানের জন্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের স্পেসিফিকেশন অনুমোদন করা হয়েছে। অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ল্যাপটপ ও প্রিন্টার ক্রয় করে উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসাররা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক অপারেশন্স ও পরিচালক প্রশাসন ও অর্থকে অবহিত করবেন।

ইসি সচিবালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ভোলা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলা উদ্দিন আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, কমিশন সচিবালয় থেকে আমাদের একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চিঠিও এসেছে। ফোন করে বলেছে এভাবে করো, ওভাবে করো। তবে কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনব, তা এখনও চূড়ান্ত করিনি। এ বিষয়ে শিগগিরই নির্দেশনা পাব। তখন দেখব কী করা যায়।

সরেজমিন ঢাকা ও গাজীপুরের কয়েকটি থানা নির্বাচন অফিসে গিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকাদারের পাঠানো টেন্ডারের একই ধরনের কাগজপত্র পাওয়া গেছে। এসব থানা নির্বাচন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, একটি ঠিকাদারি কোম্পানির প্রতিনিধিরা তিনটি কোম্পানির প্যাডে কোটেশন জমা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে গেছেন।

কয়েকটি জেলার নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। নাম গোপন রাখার শর্তে তারা বলেন, কমিশন সচিবালয় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ফোনে সবাইকে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে এসব পণ্য কেনার অনুরোধ জানিয়েছেন।

এমআর কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারি নামের এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজর মিজানুর রহমান একাই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কোটেশনের কাগজপত্র দিয়ে তার কোম্পানির নামে কাজ দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

নির্বাচন কর্মকর্তারা বলেন, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও মডেল উল্লেখ করে ল্যাপটপ বা প্রিন্টার কেনার নির্দেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) বহির্ভূত। এটা জানার পরও চাকরিতে হেনস্তার ভয়ে তারা কিনছেন।

গত সপ্তাহে ঢাকা জেলার কয়েকটি থানার নির্বাচন কর্মকর্তা আইডিবিতে ল্যাপটপ ও প্রিন্টার সম্পর্কে খোঁজ নিতে যান। সে খবর জানাজানি হওয়ায় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের একজন পরিচালক ফোন করে তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দেন।

টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, প্রত্যেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার নামে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এমআর কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারি, রয়েল অফিস ইকুইপমেন্ট ও জান ট্রেডার্স কোম্পানির নামে তিনটি কোটেশন পাঠিয়েছি। এর সঙ্গে সব ধরনের সাপোর্টিং কাগজপত্র, বিল, চালানসহ অন্যান্য কাগজপত্র দিয়েছি। সব জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, এমআর কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারির নামে সবচেয়ে কম দর ও জান ট্রেডার্সের নামে বেশি দর উল্লেখ করা হয়েছে। থানা নির্বাচন কর্মকর্তারা এমআর কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারির নামে ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড়াই ৩ লাখ ৪২ হাজার টাকার বিল দেবে। আমরা তিন লাখ ২০ হাজার টাকা রেখে বাকি ২২ হাজার টাকা স্ব স্ব উপজেলা ও থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেব।

ল্যাপটপ ও প্রিন্টার সরবরাহের আগে বিল দিতে হবে জানিয়ে এ কর্মকর্তা আরও বলেন, চলতি জুনের মধ্যে বিল দিতে হবে আর ল্যাপটপ ও প্রিন্টার জুলাইয়ে আসবে। আমরা এরই মধ্যে এসব পণ্য আনার অর্ডার করেছি। ইসি সচিবালয়ের অনুমতিক্রমেই এসব করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে এমআর কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারির মালিক মোবারক হোসেন প্রতিটি থানা নির্বাচন অফিসে তিন প্রতিষ্ঠানের প্যাডে কোটেশন জমা দেয়ার কথা স্বীকার করেন।

তার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার অনুরোধ জানানোর কথাও স্বীকার করেন। তবে প্রত্যেক উপজেলা ও থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে ২২ হাজার টাকা উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ৫ বছর ধরে নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহ করছি। প্রত্যেক সেক্টরে কাজ করতে হলে লবিং করতে হয়।

ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কাজ নেয়ার জন্যও লবিং করেছি। তবে কার সঙ্গে লবিং করেছেন, তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ২০১৮ সালেও ইসিতে ডেল ভসট্রো মডেলের ল্যাপটপ সরবরাহ করেছিলেন। ওইসব ল্যাপটপ সঠিকভাবে কাজ করছে না- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, ভালো কাজ না করলে কি কেউ প্রোডাক্ট নেয়?

এদিকে চিঠিতে এসব পণ্য কেনার বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) মো. আবদুল বাতেন ও পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ আজিজুল ইসলামকে অবহিত করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুই পরিচালকই কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/189325