১২ জুন ২০১৯, বুধবার, ৪:৪১

সিপিডির মূল্যায়ন

দশ বছরে সবচেয়ে বেশি চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি

সরকারের সব পদক্ষেপই ব্যাংকিং খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে

দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় চিড় ধরেছে। গত দশ বছরের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এর মধ্যে অন্যতম হল কর আদায়ে দুর্বলতা।

অর্থনীতির আকার অনুসারে যে পরিমাণ কর আদায় হওয়ার কথা, বাংলাদেশ তার চেয়ে অনেক দূরে। এছাড়া বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এর আগে এত বেশি চাপ ছিল না। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে না পারলে উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হবে না।

মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিপিডি। এতে আরও বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

বক্তারা প্রায় একই সুরে বলেন, দেশের অর্থনীতির অন্যতম সমস্যা ব্যাংকিং খাত। আর এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকিং খাতের ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সবগুলোই এ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এছাড়া অর্থনীতির অন্য সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রবৃদ্ধিতে অসমতা, বিনিয়োগের অভাব এবং প্রশাসনিক সুশাসনে ঘাটতি।

সংবাদ সম্মেলনে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একটি উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের আকাঙ্ক্ষার আলোকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মূল্যায়ন করলে কয়েকটি বিষয় সামনে চলে আসে। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বাংলাদেশ ভালো আছে। এ ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর সঙ্গে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের অমিল রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সীমান্ত রেখায় এসে উপনীত হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তিশালী ছিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা দুর্বল হয়ে চিড় ধরেছে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতি যে কোনো সময়ের চেয়ে চাপে রয়েছে। তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক দুর্বলতার মধ্যে অন্যতম হল কর আদায়। বর্তমানে জিডিপির অনুপাতে কর আদায় ১০ শতাংশের কম।

আর কর আদায় করতে না পারার কারণে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের শেষ তিন মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৪৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে এই বাস্তবায়নের গুণগত মান কেমন হবে, তা ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখে না।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে চাপ রয়েছে, আগে তা কখনও ছিল না। তিনি বলেন, রেমিটেন্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) এবং রফতানি আয় ভালো। এরপর উচ্চ আমদানির কারণে বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বাড়ছে। বৈদেশিক লেনদেনে তিনটি হিসাব থাকে। এগুলো হচ্ছে- চলতি হিসাব, মূলধনী হিসাব এবং আর্থিক হিসাব। এর মধ্যে চলতি হিসাবে ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। অন্য দুটি হিসাবে কিছু উদ্বৃত্ত যোগ করেও চলতি হিসাবের ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুততার সঙ্গে নেমে আসছে। বর্তমানে ৩১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রয়েছে। তা দিয়ে মাত্র ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। এক্ষেত্রে সরকার ডলার বিক্রি করে টাকাকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটি সমাধান নয়।

কারণ ডলারের বিপরীতে টাকা স্থিতিশীল রাখা আর যৌক্তিক পর্যায়ে নেই। বর্তমানে টাকার অবমূল্যায়ন জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও চীন তাদের দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। বাংলাদেশেরও মুদ্রার মান ৩ শতাংশ কমানো উচিত। কিন্তু সরকার মনে করছে টাকার মান কমালে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়বে। কিন্তু বর্তমানে মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে টাকার মান কমানোর এখনই উপযুক্ত সময়।

তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম একটি সমস্যা হল ব্যাংকিং খাত। এটি নিয়ে তিন থেকে চার বছর ধরে আমরা কথা বলে আসছি। অবশেষে জাতীয় অর্থনীতির উপলব্ধিতে ব্যাংকিং খাতের সংকটটি স্থান পেয়েছে।

কিন্তু পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সেই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। আর এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকিং খাতের ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সবগুলোই এ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর বলেছিলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আর ১ টাকাও বাড়বে না। কিন্তু সোমবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তিন মাসে খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ফলে শুধু ঋণের সুদের হার নিয়ে নাড়াচাড়া করে ব্যাংকিং খাতের সমস্যার সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, কিছু ভালো গ্রাহক আছে, এরা অসুবিধায় পড়ে গেছে। এদের যদি সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে আগামীতে কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে ফেরত দেবে। এটি একটি ভুল তত্ত্ব। কাঠামোগতভাবে সুশাসন নিশ্চিত না করে টাকা তসরুপকারীদের শাস্তি দিতে না পারলে ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখতে চাইছে না।

আর টাকা যারা নিচ্ছে, তারাও ফেরত দিচ্ছে না। ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বিনিয়োগের জন্য পুঁজির সংকট তৈরি হয়েছে। এটা কোনো দেশ ও জাতির জন্য ভালো কথা নয়। এর উত্তরণ জরুরি। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে হুকুমের অর্থনীতি কায়েম করা ঠিক হবে না।

সিপিডির সম্মানিত ফেলো বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হল রাষ্টায়ত্ত বিভিন্ন কর্পোরেশন। এই খাতগুলোকে ঠিক না করে অর্থনীতি স্থিতিশীল করা যাবে না। বর্তমানে এসব কারখানায় বাজেট থেকে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিতে হয়, তা কৃষককে দেয়া ভর্তুকির চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে অব্যাহত ভর্তুকি চলতে পারে না। এদের প্রতিযোগিতা সক্ষম করে তুলতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল কৃষি খাত। কৃষকের সঙ্গে এক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্যায় করা হয়েছে। তিনি বলেন, ভুল আমদানিনীতির কারণে গ্রাম থেকে অর্থ শহরে চলে আসছে। আবার শহর থেকে এই অর্থ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ কৃষি খাতের মতো অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা কোনো খাতে নেই। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামীতে কৃষকের টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে। ফলে সিপিডির পক্ষ থেকে আমরা বলছি, প্রত্যেক কৃষককে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা করে ভর্তুকি দিতে হবে। এক্ষেত্রে ১ কোটি ৮০ লাখ কার্ডধারী কৃষককে কম সুদে ৯ হাজার ১শ’ কোটি টাকা দিতে হবে।

তিনি বলেন, বাজেটের আকার এত বেশি বৃদ্ধির পর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। বর্তমানে পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে খরচ অত্যন্ত বেশি। কিন্তু এ সবকিছু আড়াল করার জন্য সরকার ধর্মীয় খাতের ব্যয়কে শিক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে বড় করে দেখায়। এটা এক ধরনের লজ্জাজনক স্বীকৃতি। অর্থাৎ সমস্যা স্বীকার করছে, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছে না। বিভিন্নভাবে তা আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এ সবকিছু মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি, বিনিয়োগের অভাব, প্রবৃদ্ধিতে অসমতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা।

অর্থনীতিতে এসব সমস্যার কারণ কী- এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, মোটা দাগে এর কারণ দুটি। প্রথমত, ব্যাংকের সুদের হার কমানো কিংবা মুদ্রার মূল্যায়ন অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কাজ। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে ছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তা দুর্বল হয়েছে। এর ফলে নীতিমালা তৈরিতে সামঞ্জস্য বিধান করে স্বাধীনভাবে মন্ত্রিপরিষদ পর্যায়ে যেভাবে এগোনোর কথা, সেভাবে এগোচ্ছে না।

সাধারণত অর্থমন্ত্রীরা এই নীতির পক্ষে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে অনেক সুবিধাভোগী মহল এর বিপক্ষে অবস্থান নিলেও রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা পরিস্থিতির মোকাবেলা করে। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি সাবেক অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া এবং সাইফুর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছি। সে সময়ে লক্ষ্য করেছি, কিভাবে তারা বিষয়গুলো মোকাবেলা করেছে।

আশা করি বর্তমান অর্থমন্ত্রীও সেই নেতৃত্বমূলক ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। দ্বিতীয় বিষয় হল, প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাব। এক্ষেত্রে অপশাসনের সুবিধাভোগীরা সংস্কারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কারণ সংস্কার হলে এরা হেরে যাবে।

তিনি বলেন, এই মহলটি অনেক বেশি শক্তিশালী। এরা ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও বলেন, শোনা যাচ্ছে আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আর এ ধরনের কার্যক্রম আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পরিপন্থী। নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, ঘুষ, অবৈধভাবে উপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারের অপকৌশল ও পেশিশক্তির ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/186620