১২ জুন ২০১৯, বুধবার, ৪:৩৬

সমুদ্রযাত্রায় মৃত্যু, দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড!

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রযাত্রার মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে। একশ্রেণীর তরুণেরা অতি লোভে বড় লোক হওয়ার স্বপ্নে সাগরের পানিতে লাশ হয়ে ভাসছে। গত ১০ মে লিবিয়া থেকে নৌকায় চড়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার কাছাকাছি সমুদ্রে নৌকাডুবিতে ৩৯ জন বাংলাদেশির সলিল সমাধি হয়েছে। আরও ১৪ জন বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। লিবিয়া থেকে যাত্রা করা বড় একটি নৌকা থেকে পাচারকারীরা তাদেরকে ছোট নৌকায় গাদাগাদি করে তুলে দেওয়ার পরই অতিরিক্ত যাত্রীর ভারে নৌকাটি ডুবে যায়। এই খবরটি অবশ্যই খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। কারণ ২০১৯ সালের শুরু থেকে মে মাসের ১০ তারিখের মধ্যেই এ রকম নৌকাডুবিতে ভূমধ্যসাগরে ১৭৫ জনের সলিল সমাধি হয়েছে। এই ১৭৫ জনের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক ছিল বাংলাদেশী নাগরিক। এ মৃত্যুর দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। এ মৃত্যু আমাদেরকে শুধু ব্যথিত করে না, ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে। আমরা সবাই উন্নয়নের বাজিমাত করছি। অথচ জীবিকার সন্ধানে হাজারো মানুষ ভিটেবাড়ি বিক্রি করে অবৈধ পথে পা বাড়াতে গিয়ে সাগরের পানিতে মৃত মাছের মতো ভাসছে। আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, জিডিপির কথা বলছি। কিন্তু উন্নয়নের সুফল কারা পাচ্ছে আর কারা পাচ্ছে না তার অংকটা কষে দেখছি না। উন্নয়ন হয়নি সেটা কেউ বলছে না। তবে যেটা হয়েছে সেটা সব মানুষের কাজে আসছে কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দেশজুড়ে অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তার লেন বাড়ানো, উড়ালসেতু নির্মাণ, নদীর নিচ দিয়ে টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মেগা মেগা প্রজেক্ট ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো একটি দেশের উন্নয়নের সব মাপকাঠি তা মোটাদাগে বলা যাবে না। কারণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুধুমাত্র উন্নয়নের একক সূচক নয়।

ভূমধ্যসাগরে মানব পাচারের ঘটনার মৃত্যু নতুন নয়। এর আগেও এ ধরনের ঘটনা বহুবার ঘটেছে-কখনও বড় আকারে আবার কখনও ছোট আকারে। তবে বড় ঘটনাগুলোই কেবল আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মানব পাচারের এই রুটটি কোনোকালেই নিরাপদ ছিল না, এখনও নয়। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট এ রুটে ইতালি যাওয়ার পথে ২৪ জন তরুণ বাংলাদেশির সলিল সমাধি হয়েছিল। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একশ্রেণীর দলকানা সুশীলরা যতই উন্নয়নের কথা বলে জনগণকে বোকা বানাতে চাচ্ছে ততই কেন জানি দেশের আসল চিত্র জাতির সামনে ফুটে উঠছে। বাসন্তীর কথা কেউ মনে রাখেনি। বাসন্তী তার লজ্জাকে ঢাকতে শরীরে মাছ ধরার জাল পড়েছিল। আজ হয়ত কেউ বাসন্তীর মতো জাল পড়ছে না। কিন্তু জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ছুটে চলেছে। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে এই সরকার ঘরে ঘরে প্রত্যেক পরিবারের একজনকে চাকরি দেয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু অদ্যাবধি ঘরে ঘরে চাকরি দেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। সরকারের এই ফাঁকা বুলি শুধু যে আওয়াজই ছিল তার প্রমাণ তো ভূমধ্যসাগরেই পাওয়া গেল। একটু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় বৈধ-অবৈধতার তোয়াক্কা না করেই মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যত ফন্দি করে তার ছিটেফোঁটাও যদি বেকারত্ব দূর করার প্রয়াসে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করত, তাহলে এভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে পাড়ি দিতো না।

মানবপাচার এক মানবিক বিপর্যয়ের নাম। এ সমস্যার প্রধান শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে মানুষ ভিটেবাড়ি বিক্রি করে পাড়ি দিচ্ছে অজানা গন্তব্যে। ২০১৫ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে হাজারো মানুষ মারা যায়। পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে জীবন দান কিংবা ক্রীতদাসের জীবনবরণ করার ঘটনাও কম নয়। সাগরপথে মানবপাচারের ঘটনা বেড়েই চলছে। ভূমধ্যসাগরের সলিল সমাধিসহ নৌকা ডুবিতে বাংলাদেশি তরুণদের মর্মান্তিক খবর সত্যিই বেদনাদায়ক। এবারই প্রথম তা কিন্তু নয়! বাংলাদেশি তরুণেরা এ ধরনের ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার এর আগেও ২০১৮ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোর দুর্গম গহীন জঙ্গলে ২০০ জনের বেশি বাংলাদেশি আটক হয়েছিল। চাকরির সন্ধানে অবৈধ পথে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মেক্সিকোর জঙ্গলের পথে পাড়ি দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি ১৭ হাজার অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে। এ যাত্রাপথে প্রায় ৫০০ অভিবাসীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ইউএনএইচসিআরের ভাষ্য অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রা পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে ১৬৪ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্টে সমুদ্রপথে লিবিয়া যাওয়ার পথে ২৪ জন বাংলাদেশিসহ ১১৮ জনের মৃত্যু হয়। সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ২০১৫ সালে সিরীয় শিশু আয়লানের নিথর ছবি বিশ^বাসীকে কাঁদিয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন মারফত জানা গেছে যে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ মারা গেছে। গত ৬ বছরে ৫৬ টি দেশ থেকে ১৪ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে। তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে (প্রথম আলো ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।

বাংলাদেশের তরুণ সমাজ বেকারত্ব ও দারিদ্র্র্যের কশাঘাত থেকে রেহাই পেতে এভাবে জীবনের তোয়াক্কা না করে বিশ্বের সব মহাদেশে ছুটে চলেছে এবং সাগর-মহাসাগড় পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত লাশ হয়ে সাগরে ভাসছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান আমরা সৃষ্টি করতে পারছি না বলেই দেশ থেকে তরুণ কর্মপ্রত্যাশীরা পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে। বেকারত্ব জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। কর্মসংস্থান ও জীবনের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় মানুষগুলো পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটছে। বৈধ-অবৈধতার পার্থক্য মাপতে পারছে না। কিন্তু তাঁদের অনেকে লাশ হয়ে ফিরছে পরিবারের কাছে। কর্মসংস্থান না পেয়ে যখন এই তরুণেরা ছুটতে থাকে বিদেশের পানে তখন দেশের উন্নয়নের জোয়ারের দাবি আছড়ে পড়লেও সেই জোয়ার তাঁদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি বলেই তারা ছুটে যান মৃত্যুর দুয়ারে। সরকার আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সনদ অর্জন করলেও এখানকার সম্ভাবনাময় তরুণেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশত্যাগ করছে। কিন্তু কেন তরুণেরা মৃত্যুকূপের দিকে ধাবিত হচ্ছে সে বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। তবে অনেকে মনে করেন মানুষের আয়বৈষম্য ও উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সমস্যার সমাধান করতে পারলে এ প্রবনতা রোধ করা কিছুটা হলেও সম্ভব হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সরকার একদিকে যেমন মানব পাচারের রুটগুলো বন্ধ করতে পারছে না তেমনিভাবে উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে পারছে না।

একটি আধুনিক রাষ্ট্রে যখন নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমুল্য দিতে পারে না, কলকারখানার শ্রমিকদের শ্রমের প্রকৃত মজুরি ও নিরাপত্তার কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে না, শিক্ষিত যুবকদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে না তখনই কেবল অবৈধ পথে পাড়ি জমায় মানুষ। যাদের ঘাম আর রক্তে উপার্জিত রেমিটেন্সে দেশীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, সেই অর্থনীতির সোনার ডিম দেয়া প্রবাসীরা যখন দেশে আসে লাশ হয়ে,তখন প্রতিকার ও প্রতিরোধহীন নির্বিকার অকৃতজ্ঞ রাষ্ট্রকে ধিক্কার জানায় বিমানবন্দরের কফিনের সারিগুলো। দালাল চক্রের শিকড় মূলোউৎপাটন করতে না পারলে সমুদ্রে বা মরুপথে মানুষের মৃত্যুস্রোত ঠেকানো যাবে না। আমরা সমুদ্রযাত্রায় আর কোন মানুষের লাশের মিছিল দেখতে চায় না। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে,এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

http://www.dailysangram.com/post/378708