২৩ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:৫০

জায়গা ছোট হলেও চাঁদার অঙ্ক বড়

বাদামতলী-বাবুবাজার। এলাকাটি ছোট্ট হলেও রাজধানীর অন্যতম ব্যবসায় কেন্দ্র। ফলের প্রধান আড়তটি এই এলাকায়। কাগজের ব্যবসায়, চালের ব্যবসায়, ওষুধ-প্রসাধনী থেকে শুরু করে অনেক কিছুরই ব্যবসায় এই বাবুবাজারকেন্দ্রিক। যে কারণে অপরাধীরাও এই এলাকায় বেশ তৎপর। এখানে অন্যতম অপরাধ হলো চাঁদাবাজি। বছরজুড়ে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলে বাবু বাজার এলাকায়। দিনে কম হলেও তিন-চার লাখ টাকা উত্তোলন হয় বাবুবাজার ও এর আশপাশের এলাকা থেকে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, ফল ভর্তি ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যান চলাচল করলে তা আটকিয়ে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। আবার এসব পরিবহন মালামাল ভর্তি অবস্থায় পার্কিং করলে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট থানার কিছু পুলিশ ও স্থানীয় এক কাউন্সিলরের নামে এ চাঁদা তোলা হয়।

সূত্র জানায়, দেশের প্রধান ফল মার্কেটটি রাজধানীর কোতোয়ালি থানা এলাকার বাদামতলী। প্রতিথদিন শতাধিক ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যানে ফল লোড আনলোড করে এখানে। আবার কোনো কোনো পরিবহন মালামাল টানতে পার্কিং করে ব্রিজের নিচে। তাছাড়া এসব পরিবহন বাবুবাজার ব্রিজের নিচ দিয়ে চলাচল করে। যে কারণে প্রতিদিন যানযট লেগেই থাকে। এই রাস্তার পশ্চিম পাশেই মিটফোর্ড হাসপাতাল। তাই যানজটের কারণে রোগীদের চরম ভোগান্তি হচ্ছে এখানে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ব্রায়ন বঙ্কিম হালদার নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি হাসপাতালের পঞ্চাশ গজের মধ্যে বাসস্ট্যান্ড থাকার কথা নয়।

ভুক্তভোগীরা বলেন, বাদামতলী থেকে বের হওয়া ফল কিংবা মালামাল ভর্তি পরিবহন ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যান থেকে বুড়িগঙ্গার পার্শ্বে ব্রিজের নিচে চাঁদা তুলছে দু’টি গ্রুপ। তার মধ্যে সকালে হাজি পিন্সুর নেতৃত্বে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা চাঁদা তোলে ফয়েজ, মোস্তফা ও মনির। আর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত একই হারে হাফিজ উদ্দিন ও আনসার উদ্দিনের নেতৃত্বে আলেক, রহমান, জামাল ও মজিবর চাঁদা তোলে। কোনো চালক টাকা দিতে দেরি করলে তাকে মারধর করা হয়।

ঢাকা মেট্রো ন ১১- ২১৫৯ পিকআপ ভ্যানচালক রুবেল জানান, বাদামতলী থেকে বিদেশী বিভিন্ন ফল ভর্তি গাড়ি নিয়ে বের হতে নদীর কিনারে ব্রিজের নিচে লাঠি হাতে দু’জন আটক করে ভ্যান। কোনো বৈধতার কাগজ না দিয়ে ৬০০ টাকা দাবি করে। দিতে না চাইলে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। পাশে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। তারা দেখেও না দেখার ভান করে। এক পুলিশ সদস্য ৪০০ টাকা দিয়ে যেতে বলে। পরে টাকা দিয়ে ওখান থেকে ছাড় পাই। আনসার উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, ওখান থেকে যত টাকা কালেকশন করা হয় তা পুলিশ ও স্থানীয় কাউন্সিলর বিল্লাল শাহকে দেয়া হয়। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমরা পার্সেনটিস নেই।

অন্য দিকে, বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ১২টি ট্রান্সপোর্ট স্পট, ২০টি ভাতের হোটেল ও ৪০টি চায়ের দোকান রয়েছে। এসব স্পট থেকে অর্ধলাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে প্রতিদিন।

ট্রান্সপোর্ট স্পট : ব্রিজের নিচে ১২টি ট্রান্সপোর্ট স্পট করা হয়েছে। ১০টি স্পট নিয়ন্ত্রই করে একরাম। তাছাড়া ভাতের হোটেল ও চায়ের দোকান থেকেও চাঁদা তোলে একরাম। সে কাউন্সিলার বিল্লাল শাহের লোক। আর ট্রান্সপোর্টের একটি স্পট নিয়ন্ত্রণ করে কথিত সাংবাদিক মেহেদী। এসব স্পটে লোড আনলোড ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যান রাখা হয়। মালামাল ভর্তি পথরিবহন পার্কিং করলে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা দিতে হয়। আর খালি পরিবহন থেকে নেয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। জানা যায়, কথিত সাংবাদিক মেহেদি ব্রিজের নিচে মাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে ভ্যানগাড়ির ওপরে চুলা বসিয়ে লুচি পরোটা বিক্রি করত। পরে পুলিশের সাথে সখ্য করে এলাকার ফুটপাথ থেকে পুলিশের নামে চাঁদা তুলতো। ওই সময়ে এসি বদরুলের গাড়িতে ঘুরে বেড়াত মেহেদি। এ নিয়ে পত্রিকায় নিউজ হয় মেহেদির বিরুদ্ধে। পরে চাঁদাবাজির মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থাকে সে।

এখন ফুটপাতে ১৪টি চায়ের দোকান থেকে ২০০ টাকা করে দৈনিক চাঁদা তোলে মেহেদির বেতনভুক্ত লোক। তার মধ্যে গৌতম অন্যতম। এ ছাড়া প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি পরিবহন রাখে তার স্পটে। খালি ট্রাক রাখা বাবদ চাঁদা নেয়া হয় ৫০০ টাকা। আরা মালামাল ভর্তি ট্রাক রাখলে ১২০০ টাকা এবং লরি রাখলে ১৫০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। তবে পরিবহন রাখা হলে ১০ টাকার একটি রিসিট দেয়া হয়। আর টাকা তোলে মেহেদির ভাগনে সালাম এবং ভাই ইউনুস। প্রতিদিন পরিবহন বাবদ চাঁদা আদায় করা হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর বিল্লাল শাহের নামে দেয়া হয় ২ হাজার টাকা। ১৮ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে মেহেদির স্পটে কুষ্টিয়া ড ১১-০২১৪, কুষ্টিয়া ড ১১-০১৮৬, ঢাকা মেট্রো ট ১১-০৩৩২ ও ঢাকা মেট্রো ড ১৪-২২৪৭ নম্বরের ট্রাকসহ আরো ৮ থেকে ১০টি খালি ট্রাক ছিল। এসব পরিবহন চালকেরা জানান, মালামাল ভর্তি পার্কিং করলে ১২০০ আর খালি রাখলে ৫০০ টাকা দিতে হয়। তবে তাদেরকে ১০ টাকার রিসিট দেয়া হয় বলে জানান তারা।

সূত্র আরো জানায়, বাবুবাজার ব্রিজের ওপর নিচ পুরোটা সড়ক ও জনপদ বিভাগের আওতায়। তবে নিচের অংশটা নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর তাই কাউন্সিলর বিল্লাল শাহের নামে পার্কিং বাবদ লিজ দেয়া হয়েছে ব্রিজের নিচ। এ নিয়ে বহু চিঠি চালাচালি হয়েছে। লিজের কাগজে উল্লেখ রয়েছে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, সিএনথজি থেকে ঘণ্টায় ১০ টাকা ও ১৫ টাকা নেয়া যাবে।

এসব টাকা একরাম ও রানার হাত থেকে ভাগাভাগি হচ্ছে। এ বিষয়ে কাউন্সিল বিল্লাল শাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন ব্রিজের নিচে পার্কিং করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার নেতৃত্বে খাজনা আদায় হচ্ছে। আমি তিনজনকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তারা হলো জন, জাহাঙ্গীর ও মুরাদ। তারা কিভাবে পার্কিংয়ের টাকা আদায় করছে তা জানা নেই। কোতোয়ালি থানার ওসি মশিউর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, বাবুবাজার ব্রিজের নিচে পার্কিং নিয়ে খুব চিন্তিত। কারণ সড়ক ও জনপদ বিভাগ বলছে ব্রিজ তাদের। তাই ব্রিজের নিচ ও তাদের। সিটি করপোরেশন জানায় ওই সম্পত্তি তাদের। তিনি বলেন, পুলিশ টাকা তুলছে কিংবা টাকা নিচ্ছে কথাটি সঠিক নহে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/412335