১৩ মে ২০১৯, সোমবার, ১১:৫২

জমে উঠেছে ডেমরার জামদানি হাট

ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তাঁতিরা * ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসনে সংকটে এ শিল্প

ঈদ সামনে রেখে জমে উঠেছে প্রায় ৩শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা ঢাকার ডেমরা এলাকার ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক জামদানি হাট। জামদানির হাট বা আড়ং বলতে এক সময় রূপগঞ্জকে বোঝানো হলেও সেই হাটের বর্তমান অবস্থান শীতলক্ষ্যা বিধৌত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা ঘেঁষে গড়ে উঠা ঢাকার ডেমরা এলাকা।

সুলতানা কামাল সেতুর পাশ দিয়ে নোয়াপাড়ার দিকে যেতেই চোখে পড়ে জামদানির হাট। এখানে শুধু পাইকারি ব্যবসায়ীরাই নন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ভিড় করছেন সাধারণ ক্রেতারা। বছরজুড়ে জামদানির চাহিদা থাকলেও লাভের মুখ দেখছেন না তাঁতিরা। কারণ ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসন ও ন্যায্য দাম না পাওয়া। ফলে অনেকেই বংশানুক্রমে চলা ঐতিহ্যবাহী এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।

জানা গেছে, বেনারসি শাড়ির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই এক সময় জামদানির প্রচলন হয়েছিল। মসলিন শাড়ির তাঁতিরাই আঠারশ’ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শুরু করেন জামদানি বোনা। মিহি জমিনে সূক্ষ্ম নকশাদার কাজ- এ হলো জামদানির মূল বৈশিষ্ট্য। প্রতি বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকেই এ হাটে জড়ো হতে থাকেন তাঁতি, ফড়িয়া, দালাল, পাইকারসহ খুচরা ক্রেতারা। দোকান করার সুব্যবস্থা না থাকায় চট, মাদুর বিছিয়ে বসে বেচাবিক্রি করেন তাঁতিরা। সবাইকে দেখা যায় দাঁড়িয়ে দুই হাতে শাড়ি উঁচিয়ে ধরে হাঁক দেন ‘এই জামদানি, শেষ দুইটা আছে।’ এ দুটো বিক্রি হয়ে গেলে আরও দুটো হাতে ওঠে। ‘দুইটা’ আর যেন শেষ হয় না। এভাবে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চলে। হাঁকডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে বেচাকেনা। হাট চলে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত।

ডেমরায় জামদানি তৈরি না হলেও পার্শ্ববর্তী নোয়াপাড়া, রূপগঞ্জের রূপসী, মৈকুলী, খাদুন, পবনকুল, কাজীপাড়া, মোগরাকুল, সোনারগাঁ এবং আড়াইহাজারের তাঁতিদের তৈরি জামদানি সংগ্রহ করতে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সেখান থেকে জামদানি চলে যাচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। যাচ্ছে নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরুমে। একেকটি শাড়ি দেড় হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। জামদানি শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো কাপড় কিংবা পণ্য এ হাটে পাওয়া যায় না। জানা যায়, প্রতি হাটে ৫-৭ হাজার পিস শাড়ি বেচাবিক্রি হয়। টাকার হিসাবে ১ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয় হাটে। শাড়িপিছু ইজারা দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

জানা গেছে, রূপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জামদানি পল্লীতে প্রায় চারশ’ তাঁত মালিক রয়েছেন। ওই পল্লীতে পা রাখলেই কানে মাকুসহ তাঁতের আওয়াজ শোনা যায়। তারপরের গল্প তাঁত, তাঁতি আর জামদানির। রোজগার একটু বেশি হলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের আনন্দটাও একটু উপভোগ্য হবে এমন আশায় কাজের উদ্যম যেন বেড়ে গেছে তাদের। জামদানির কারিগররা ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১৪ ঘণ্টা কাজ করে চলছে। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়াতে তাদের ভাগ্য বদলাচ্ছে না।

এ হাটে প্রায় ৫০ বছর ধরে আসা তাঁতি নূর হোসেন জানান, ভারতীয় জামদানির আগ্রাসনে আমাদের অবস্থা অনেকটাই করুণ। দেশীয় জামদানির চাহিদা থাকলেও আমরা দাম পাচ্ছি না। আরেক তাঁতি গোলজার হোসেন বলেন, আমরা ৭ দিনে যে শাড়িটি বানাই সেটি সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করি। অথচ এ শাড়িটি ভারতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা অথবা দেশের কোনো মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। আমাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি।

পাইকারি ব্যবসায়ী হাজী ইমান আলী জানান, বাংলাদেশের জামদানি শাড়ির চাহিদা বিদেশেও রয়েছে। ভারত, আমেরিকা, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছ নারায়ণগঞ্জের জামদানি শাড়ি, থ্রিপিস ও পাঞ্জাবির কাপড়। কিন্তু ভারতীয় জামদানির আগ্রাসনে পথে বসতে শুরু করেছেন দেশীয় জামদানি উৎপাদকরা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/news/176762