১৩ মে ২০১৯, সোমবার, ১১:৪৩

বিদ্যুতের লোডশেডিং হিসাবে নেই, বাস্তবে আছে

গতকাল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ওয়েবসাইটে পিক আওয়ারে (সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১১টা) বিদ্যুতের চাহিদা দেখিয়েছে ১২ হাজার ৪৯৪ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৪৯৪ মেগাওয়াট। এ হিসাবে চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে কোনো ঘাটতি নেই। নেই কোনো লোডশেডিং। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল ঠিক তার উল্লোটা। গতকাল খোদ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় লোড শেডিং করা হয়েছে। বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মের ভয়াবহ তাপদাহের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। পবিত্র রমজানে ইফতারি, কী সাহরি কোনো অবস্থায় রেহাই নেই এ লোডশেডিং। রাজধানী ঢাকায় বেশির ভাগ এলাকায় দিনে রাতে ৪ থেকে ৫ বার বিদ্যুৎ থাকে না। রাজধানীর বাইরের অবস্থাতো আরো ভয়াবহ। তাপদাহের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন দেশবাসী।

বিদ্যুৎ বিভাগের বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ভেঙে রেকর্ড গড়ার সুফল বাস্তবে জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। অন্তত গতকাল রাজধানীবাসী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। একে তো বৃষ্টিহীন বৈশাখের ভয়াবহ তাপদাহ, এর ওপর দিনে কয়েকবার লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণাই জানান দিয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ভাঙার সুফল। এর কোনো সদুত্তরও পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।

পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, দেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। বরং আমাদের হাতে আরো বেশি উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। দেশে উৎপাদনজনিত কোনো ঘাটতি নেই। তবে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ না থাকার কারণ হিসেবে তিনি জানান, ওভারলোড বা বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে এটা হতে পারে।

একই কথা বললেন, পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল হাসান চৌধুরী। তিনি জানান, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদনজনিত কোনো ঘাটতি নেই। দেশে চাহিদা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

তবে পিডিবির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদনজনিত কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু যেভাবে উৎপাদন বেড়েছে, সেইভাবে বিতরণ ব্যবস্থায় কোনো উন্নতি হয়নি। মূলত বিতরণ ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণেই বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। এ কারণে একদিকে যেমন লোডশেডিং নেই, অপর দিকে বিবেচনা করলে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং আছে। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো হলো, কিন্তু বিদ্যুৎ বিতরণ করার সক্ষমতা বাড়ানো হলো না, এটা সঠিক ব্যবস্থাপনা নয়। উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা দুটোই একসাথে বাড়াতে হবে। যেটা আমাদের দেশে কোনো এক রহস্যজনক কারণে হয়নি।

জানা গেছে, সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিদ্যুতের পিক আওয়ার বলা হয়। এ সময়ে বিদ্যুতের ব্যবহার হয় বেশি। কিন্তু আজকাল শেষ রাতে সাহরির সময়েও কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না। রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া হবে বিদ্যুৎ বিভাগের এমন দাবি বাস্তবে চোখে পড়ছে না। রাজধানীসহ দেশের সব জেলার মানুষ রোজার মাসেও দিনভর বিদ্যুৎ নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাবার পরে ইফতারি থেকে তারাবিহ হয়ে সাহরির সময়ও বিদ্যুৎ বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। রোজাদার মুসল্লিগণ বর্ষণহীন বৈশাখের মাঝ রাতে শুধু হাপিত্তেস করেন।

খিলগাঁও এলাকায় বাস করেন মঈনউদ্দিন নামে একজন গ্রাহক। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, মনে হয় এবার রমজান মাসে বেশি বিদ্যুতের লোডশের্ডিং করা হচ্ছে। ইফতারি, তারাবির পাশাপাশি কোনো কোনো দিন সাহরির সময়ও বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। সারা দিন রোজাদাররা রোজ রেখে ঠিকমতো ইফতার করতে পারছেন না কোনো কোনো এলাকায়। বিদ্যুৎ না থাকায় প্রচণ্ড গরমে তারাবির নামাজও আদায় করতে কষ্ট হচ্ছে মুসল্লিদের।

বিদ্যুতের এ লোডশেডিং শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই এ চিত্র আরো ভয়াবহ। আমাদের রংপুর প্রতিনিধি সরকার মাযহারুল মান্নান গতকাল জানিয়েছেন, রংপুর ও এর আশপাশ এলাকায় গড়ে ৫ থেকে ৬ বার বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। আর একবার লোডশেডিং এক ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, গড়ে ৬-৭ বার বিদ্যুৎ থাকে না ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায়। তিনি জানিয়েছেন, কী ইফতারি, বা তারাবিহ এমনকি সাহরির সময়ও কোনো কোনো দিন বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। আর সামান্য ঝড়োহাওয়া হলেই বিদ্যুৎ থাকে না একটানা দুই তিন ঘণ্টা।
আমাদের নোয়াখালী প্রতিনিধি হানিফ ভুইয়া বলেন, সারা দিনই বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। একটানা দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে আধা ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ চলে যায়। এভাবে দিনে ৫-৬ বার বিদ্যুৎ যাওয়া আসা করে। এতে এ রমজান মাসে প্রচণ্ড তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি আব্দুল আউয়াল বলেন, রাজশাহী ও এর আশপাশ এলাকায় দিনে রাতে ৬-৭ বার বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। আর একবার বিদ্যুৎ গেলে এলাকাভেদে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকে না। একে তো ভয়াবহ তাপদাহ, এরওপর লোডশেডিংয়ের কারণে জনদুর্ভোগ বেড়ে গেছে।

বরিশাল থেকে আমাদের প্রতিনিধি আজাদ আলাউদ্দিন জানান, মাহে রমজানেও বিদ্যুৎ বিভাগের অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তি মেলেনি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর। নরবড়ে বিতরণ ব্যবস্থার পাশাপাশি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির কিছু কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার কাছে অসহায় দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষ। ‘রমজানে কোনো বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে না’ বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দাবি সত্যি প্রমাণিত করেও বিদ্যুৎ বিভাগ তাদের ভঙ্গুর বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থার কারণে গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দুর্ভোগকে এবার নতুন মাত্রা দিয়েছেন। দক্ষিণের ছয়টি জেলার কোটি মানুষ রোজার মাসেও দিনভর বিদ্যুৎ নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহায়। এমনিতেই প্রচণ্ড তাপদাহ, এরওপর সারা দিন রোজা রেখে তারাবির নামাজ আদায় করতেও কষ্ট হয় মুসল্লিদের।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাড়ানোর দিকেই অতিরিক্ত নজর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের দোরগাড়ায় পৌঁছানোর জন্য সঞ্চায়ন ও বিতরণ লাইনের দিকে নজর দেয়া হয়নি। এমনকি সংস্কার কাজও তেমন একটি চোখে পড়ে না। আর এ কারণেই রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবি করা হলেও তার সুফল কিন্তু জনগণ পাচ্ছে না। পিডিবির সাবেক এক চেয়ারম্যান জানান, সাধারণত বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন আগে সংস্কার করা হতো শীতকালে। ঝড় বৃষ্টি আসার আগেই বিতরণ লাইনের ওপর গাছের ডালপালা কেটে ফেলা হতো। বিতরণ লাইন সংস্কার করা হতো। পুরনো তার মেরামত করা হতো। কিন্তু এখন আর সে দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। গুণগত ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাক আর না পাক একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের আমলারা ঢাকায় থাকেন। তাই গ্রামের কথা কেউ জানতে পারেন না। তিনি জানান, কয়েকটি বিশেষ জেলা শহর ছাড়া দেশের প্রায় সব এলাকায়ই বিদ্যুৎ যায় না, বিদ্যুৎ আসে। দিনে রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য তারা বিদ্যুৎ পান। তিনি মনে করেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে গুণগত ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেই সাথে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সংস্কার ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় বিদ্যুৎ সমস্যা তিমিরেই থেকে যাবে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/409664