১৩ মে ২০১৯, সোমবার, ১১:৪১

যানজটে নাকাল নগরবাসী গরমে হাঁসফাঁস

একদিকে প্রচন্ড তাপমাত্রা অন্যদিকে যানজটে নাকাল মানুষ। রোজা রেখে গরমে হাঁসফাঁস তার উপর যানজটে মানুষের দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছেনা। যানজট রাজধানীবাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। তবে কখনো কখনো সেই যানজট ছাড়িয়ে যায় অসহনীয়তার মাত্রায়, তাতে নিত্য যানজটে অভ্যস্ত রাজধানীবাসীকেও হিমশিম খেতে হয়। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে তেমনই যানজটের কবলে পড়ে নাকাল হতে হলো ঢাকাবাসীকে। দিনের শুরু থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যানজট দেখা দেয়। বেলা গড়াতে তা অনেক এলাকাতেই অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে যায়।

গতকাল রোববার সকাল থেকেই রাজধানীর তেজগাঁও, আজিমপুর, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, বাংলামোটর, শাহবাগ, মিরপুর এলাকাগুলোয় যানজট শুরু হতে দেখা গেছে।

দুপুর ১টার দিকে সংসদ ভবনের সামনে খামার বাড়ি এলাকায় কথা হয় এক বাসযাত্রীর সঙ্গে। তিনি জানান, সকাল ১১টায় রওনা দিয়েছেন আজিমপুর থেকে, গন্তব্য আগারগাঁও। ঘণ্টা দুয়েকেও তিনি খামার বাড়ি পার হতে পারেননি।

আরেক বাসযাত্রী আব্দুল সাইয়িদ জানান, শেওড়াপাড়ায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। থাকেন লালবাগে। সকাল ৮টার দিকে আজিমপুর থেকে রওনা দিয়ে অফিসে পৌঁছেছেন ১১টারও পর! তিনি বলেন, ‘অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারব কি না, বলা মুশকিল।’

একই ধরনের চিত্র সকাল থেকেই ছিল তেজগাঁও-মগবাজার সড়কেও। সকাল ১০টা নাগাদ নাবিস্কো বাস স্টপ থেকে শুরু করে তিব্বত হয়ে সাত রাস্তা পর্যন্ত তো বটেই, মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর-নিচ দিয়েও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি। এদিকে, মালিবাগ-মৌচাক থেকে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশেই ছিল গাড়ির তীব্র চাপ। এসময় বাসে করে শান্তিনগর থেকে পল্টন পৌঁছাতেই সময় লেগেছে এক- দেড় ঘণ্টা। আবার একইভাবে পল্টন থেকে মালিবাগ পৌঁছাতেই সময় লেগেছে ঘণ্টা দুয়েক!

রাজধানীর শাহবাগ হয়ে বাংলামোটর-কারওয়ান বাজার ও কাটাবন-সায়েন্স ল্যাব সড়কেও ছিল একই রকমের চাপ। বাড়তি চাপ দেখা গেছে মিরপুর রোডে কলাবাগান-ধানমন্ডি ৩২-আসাদ গেট এলাকাতেও। কেবল যানজট নয়, কড়া রোদও এদিন সঙ্গী হয়েছে। তাতে নাভিশ্বাস উঠেছে নগরবাসীর।

যানজট নিয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা জোনের ট্রাফিক সার্জেন্ট শামসুজ্জামান বলেন, সপ্তাহের প্রথম দিন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে সড়কে যানবাহনের চাপ ছিল। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে।

রাজধানীর কলেজগেট, পুরো রাস্তায় থেমে থেমে চলছে গাড়ি। একটার সঙ্গে আরেকটা গাড়ি প্রায় লাগানো। কলেজগেট থেকে পান্থপথ স্বাভাবিক সময়ে বাসে ২০ মিনিট লাগলেও শনিবার দুপুর ১২টায় এই রাস্তাটুকু পার হতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। তার সঙ্গে রয়েছে অসহনীয় গরম। রোজার মাঝামাঝি থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত রাজধানীবাসীর অনেকটা সময় রাস্তায় কাটে। এ বছর রোজার শুরু থেকেই এই ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী। সঙ্গে যোগ হয়েছে মেট্রোরেলের কারণে রাস্তা সরু হওয়ার দুর্ভোগ।

যানজটের শহর হিসেবে বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ঢাকা শহর। শুধু তাই নয়, সময় অপচয় ও ট্রাফিক অদক্ষতা সূচকেও শীর্ষে রয়েছে ঢাকা।

গত ফেব্রুয়ারিতে বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশ করা ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯তে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৮ ও ২০১৭ সালে যানজটে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।

যানজটে নাকাল নগরবাসী শাহিদুর রহমান মিরপুর থেকে বেলা ১১টায় রওনা দিয়ে সোবহানবাগ পৌঁছান বেলা ১টায়। সায়েন্সল্যাব যাওয়ার কথা থাকলেও বাসের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি নেমে পড়েছেন সোবহানবাগে। রাস্তা পার হয়ে ফিরতি গাড়িতে বাসায় ফিরবেন। তিনি বলেন, ‘পুরো পথেই রাস্তার দু’পাশে যানবাহন থেমে থেমে চলছে। ঈদের কেনাকাটা অনেকেই রোজার শুরুতেই সেরে ফেলতে চান। তাই বলে এই অবস্থা হবে কে ভেবেছিল?’

বিলকিস আখতার থাকেন কলাবাগান। বাসা থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে ৪০ মিনিটেও পান্থপথে উঠতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘ মেইন রাস্তার এত বাজে অবস্থা যে আমি গলির মুখ থেকেই বের হতে পারলাম না। তাকিয়ে তাকিয়ে বাইরে হেঁটে যাওয়া খেটে খাওয়া মানুষদের দেখছিলাম আর ভাবছিলাম রোজা রেখে কী ভয়াবহ কষ্টে পড়েছেন।’ তার সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু রুমানা হক।

তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন ওয়ারী থেকে বের হয়ে বসুন্ধরা সিটিতে আসি। কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ট্রাফিকের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার মোটামুটি দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে আসতে। বেশিরভাগ সময় গুলিস্তান, পল্টন ও শাহবাগ এলাকায় যানজটে আটকা পড়ে মানুষ। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে কী পরিস্থিতি হবে কে জানে।’

রিকশাচালক রুক মিয়া মোহাম্মদপুর থেকে রিকশা নিয়ে বের হন সকাল ৭টার ভেতর। প্রতিদিন কমপক্ষে ১২টি গন্তব্যে যেতে হয়, না হলে পোষায় না তার। তিনি বলেন, ‘এখন ৭টার বেশি পারা যায় না। জ্যামে বসে থাকি, অনেক সময় যাত্রী বিরক্ত হয়ে অর্ধেক টাকা দিয়ে চলে যায়।’

ঠিক কবে নাগাদ স্বস্তির বৃষ্টি আসবে সেই আগাম বার্তা দিতে পারেনি আবহাওয়া অধিদফতর। তারা বলছে, রাজধানীসহ দেশের অনেক অঞ্চলে তাপপ্রবাহ চলছে। গত চার দিন ধরে দেশে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম। তাদের হিসেবে ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু, ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মাঝারি এবং ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ।

এদিকে গত কয়েক দিন ধরেই দাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ। আর গরমের প্রভাবে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগবালাই। অসুস্থ হয়ে মানুষ ছুটছে হাসপাতালে। পথেঘাটেও মানুষ চলাচলের ক্ষেত্রে শিকার হচ্ছে অসহনীয় গরমের। ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া মানুষ হাঁসফাঁস করে তাপের যন্ত্রণায়। একটু ছায়া একটু বাতাসের দিকে তাকিয়ে থাকে ভুক্ত ভোগীরা। স্বস্তির জন্য শহর তলীর শিশুরা নদীতে কিংবা পুকুরে গোসল করতে নামে। অনেকে আইস ব্যাগ মাথায় দিয়ে একটু স্বস্তি খুঁজছেন। তবে দুর্ভোগে পড়া মানুষের মুখে একটা কথা কবে আসবে স্বস্তির বৃষ্টি।

এদিকে প্রচন্ড গরমের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মানুষ। হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। আক্রান্ত হচ্ছে নানা রকম পেটের পীড়া, ডায়রিয়ায়। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ভীড় বেড়েছে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের। একদিকে রোজা অন্যদিকে দাবদাহ সব মিলেয়ে মানুষ চরম কষ্টই হচ্ছে। তবে এ গরমে সর্তক থাকার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তাররা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম বড়ুয়া বলেন, এমন গরমে স্বাভাবিকভাবেই অনেকে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। সেই সঙ্গে জন্ডিসের প্রবণতাও দেখা যায়। এ হাসপাতালে কয়েক দিন ধরে জ্বর ও ডায়রিয়ার রোগীও বেড়ে গেছে। ঘামের সঙ্গে ময়লা-জীবাণু আটকে থেকে ত্বকে ঢুকে পড়ে। গত কয়েক দিনে এ হাসপাতালে চর্মরোগীদের ভিড়ও বেশি দেখা যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/375355