৭ মে ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:৩৫

গণিত আর মানবিকে খারাপ ফলের প্রভাব সর্বত্র

ফল বিশ্লেষণ

এবারের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার ফলাফলের সব কয়টি সূচক ঊর্ধ্বমুখী। একমাত্র জিপিএ ৫ ছাড়া। চারটি বোর্ডে গণিত ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ফল খারাপ করেছে। এ ছাড়া শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান এবং শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠান কমেছে। এতদিন ছেলেরা এগিয়ে থাকলেও এবার মেধা ও গড় পাসে মেয়েরা এগিয়ে গেছে। রাজশাহী ও যশোর বোর্ড ছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ চারটি বোর্ডের ফলাফল এবার নিম্নমুখী হওয়ায় প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে।

গত দুই বছরের নিম্নমুখী প্রবণতা কাটিয়ে এবার আগের ধারায় অর্থাৎ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ফিরে এসেছে। এ ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা ও কৃতিত্বের পুরোটাই শিক্ষার্থী-পরীক্ষকদের বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। এবার মাধ্যমিকে সব বোর্ডে গড় পাসের হার ৮২.৮০ শতাংশ। গত বছর ছিল তার আগের ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

আন্তঃবোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হকসহ একাধিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নয়া দিগন্তকে বলেছেন, যেসব বোর্ডে পরীক্ষার্থীরা গণিতে বেশি ফেল করেছে, সে সব বোর্ডের ফলাফল খারাপ হয়েছে। অন্য দিকে রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও মাদরাসা বোর্ডে গণিতে ভালো করায় সামগ্রিক বোর্ডের ফলাফল ভালো হয়েছে। আবার সবচেয়ে কম পাস করা সিলেট বোর্ডে গণিতে ফেল করেছে ৩০ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী। গণিতে এই বোর্ডে পাসের হার ৭৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। শুধু গণিত বিষয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এ ছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতি এ বোর্ডের শিক্ষকেরা রপ্ত করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুছ। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলে আরো যে কারণ তা হচ্ছে প্রশ্ন কঠিন হওয়া এবং মানবিকের খারাপ ফল। অন্য বোর্ডের চেয়ে শিক্ষকেরা অত বেশি প্রশিক্ষিত নন। এসব কারণ আমাদের ভোগাচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানও রাতারাতি সম্ভব হচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, সাধারণ গণিত ও ইংরেজিতে ফলাফল খারাপ করার কারণে এবার পাসের হার কমেছে। এ কারণেই গত কয়েক বছর যাবৎ ফলাফল ৭০ শতাংশের ঘর অতিক্রম করতে পারছে না।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব বোর্ডে প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী বাংলা বিষয়ে পাস করেছে। ইংরেজি ও গণিতে সর্বাধিক শিক্ষার্থী পাস করেছে রাজশাহী বোর্ডে। এ বোর্ডে এ দুই বিষয়ে যথাক্রমে পাসের হার ৯৮ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং ৯৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্য দিকে গণিতে সর্বনিম্ন শিক্ষার্থী পাস করেছে সিলেট বোর্ডে ৭৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। গণিতে বিপর্যয়ের কারণে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সামগ্রিক পাসের হার কমে গেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৮৮ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ইংরেজিতে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। একাধিক বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, গণিত বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। অভিজ্ঞ গণিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নে দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, সাধারণ গণিত ও ইংরেজিতে ফলাফল খারাপ করার কারণে কোনো কোনো শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার কমেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গণিতে শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করেছে। মোট পরীক্ষার্থীর ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী মানবিক শাখায় পরীক্ষা দিয়েছে। মানবিক শাখার শিক্ষার্থীদের পাসের হার সবচেয়ে কম। এসব কারণে ঢাকা বোর্ডের পাসের হার অন্যান্য বোর্ডের চেয়ে কম।

এবার মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। মাদরাসা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফউল্যানয়া দিগন্তকে বলেন, শিক্ষার্থীরা গণিত, ইংরেজি বিষয়ে এবার ভালো করেছে। এই দুই বিষয়ে ফল পুরো বোর্ডের পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে।

মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞানে পড়তে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ বছর মাধ্যমিকের ফলাফলেও এই চিত্রটি উঠে এসেছে। এ বছর এসএসসিতে বিজ্ঞান শাখায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি উত্তীর্ণের হারও বেড়েছে। এ বছর বিজ্ঞান শাখা থেকে ৫ লাখ ৪১ হাজার ৩২৩ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করেছে ৫ লাখ ১২ হাজার ৭১৫ জন। পাসের হার ৯৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর জিপিএ ৫ পেয়েছে ৯১ হাজার ৩৩ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর বিজ্ঞান শাখায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, পাসের হার ও জিপিএ ৫ বেড়েছে।

বিগত বছরগুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমতে থাকে। গ্রামাঞ্চলের স্কুলে এ সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। কিছু অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া শহরেও বিজ্ঞানের গণ্ডি ছোট হয়ে আসছিল। এ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিজ্ঞান শাখায় পরীক্ষার্থী বেড়েছে ৩৭ হাজার ৮১৭ জন। গত বছরের চেয়ে পাসের হারও বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, এবার ছাত্রীদের পাসের হার ৮৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। অন্য দিকে ছাত্রদের পাসের হার ৮১ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের পাসের হার ২ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া ছাত্রদের তুলনায় জিপিএ ৫ বেশি পেয়েছে ১ হাজার ৩৭৪ জন ছাত্রী। ৫২ হাজার ১১০ জন ছাত্র জিপিএ ৫ পেয়েছে। অন্য দিকে ৫৩ হাজার ৪৮৪ জন ছাত্রী জিপিত্র ৫ পেয়েছে। এবারের পরীক্ষায় অংশ নেয় ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৫২৭ জন ছাত্র। পাস করেছে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৯৪১ জন। অন্য দিকে ১০ লাখ ৫৯ হাজার ২৮৮ জন ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮ লাখ ৮২ হাজার ২২৪ জন। অর্থাৎ ছাত্রদের তুলনায় কম ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করেছে বেশি।

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এ বছর দেশের ১০৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। গত বছর ১০৯টি প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী ফেল করেছিল। সেই হিসেবে এবার শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে দুইটি। অন্য দিকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার সারা দেশে ২ হাজার ৫৮৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। ২৮ হাজার ৬৭৩টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। গত বছর এসএসসিতে এক হাজার ৫৭৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। এই হিসাবে এবার শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে ১ হাজার ৯টি। ফেল করা বেশির ভাগ স্কুল ও মাদরাসা গ্রামের। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভালো মানের শিক্ষার পরিবেশ নেই। বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ শিক্ষকও নেই। এমনো রয়েছে যে, বাংলার শিক্ষক ক্লাস নেন ইংরেজি কিংবা ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার। অনেক স্কুলে নেই ইংরেজি ও বিজ্ঞানের শিক্ষক। ফলে ওই স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ফলে পিছিয়ে থাকছে। মফস্বলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ততটা সচেতন নন।

বেশ কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ফাঁস হলেও এবার প্রশ্ন ফাঁসের কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই মাধ্যমিকের সব পরীক্ষা শেষ হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধন, মুদ্রণ, প্যাকেটজাতকরণ, ট্রাঙ্কজাতকরণ, কেন্দ্রে প্রেরণসহ প্রতিটি স্তরেই কঠোর নজরদারি, সতর্কতা ও বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষা কক্ষে তার নির্ধারিত আসনে বসতে হয় পরীক্ষার্থীকে। পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে এসএমএসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের সেট কোড জানিয়ে দেয়া হয়। কেন্দ্র সচিব ছাড়া অন্য কেউ মোবাইল ফোন বা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে উপরি উক্ত বিষয়গুলোর প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/408166